মঙ্গলবার, 08 জুলাই 2025
Logo
  • মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

যত পথ তত রথ

রথযাত্রায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই হলেন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব। ভারতীয় পুরাণে আছে, রথের মেলা আসলে ভক্ত-ভগবানের মিলন মেলা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভক্তদের মিলন। বৃন্দাবন নয়, এ কৃষ্ণ দ্বারকার। 

যত পথ তত রথ

সুখেন বিশ্বাস: রথযাত্রায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই হলেন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব। ভারতীয় পুরাণে আছে, রথের মেলা আসলে ভক্ত-ভগবানের মিলন মেলা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভক্তদের মিলন। বৃন্দাবন নয়, এ কৃষ্ণ দ্বারকার। যুদ্ধশেষে কুরুক্ষেত্র থেকে শ্রীকৃষ্ণ ফিরছেন দ্বারকায়, সঙ্গে ভাই বলরাম আর বোন সুভদ্রা। শ্রীকৃষ্ণের রাজবেশ দেখে হতাশ শ্রীরাধিকা সহ গোপীগণ। তাই তাঁরা রশি ধরে রথের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন বৃন্দাবনের দিকে। নীলাচল (পুরীর শ্রীশ্রীজগন্নাথধাম) থেকে গুণ্ডিচা মন্দিরে (পুরীর বৃন্দাবন) যাতায়াতই আসলে রথের শুভযাত্রা। এ যাত্রায় রাজা আসেন প্রজা দর্শনে, প্রজারা দর্শন পায় রাজার। রাজা-প্রজার মিলন মেলাই হল রথের মেলা।
চৈতন্যদেব ও রথযাত্রা
চব্বিশ বছর বয়সে শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তারপরই চলে যান নীলাচলে। বাকি চব্বিশ বছরের মাঝে কখনও দক্ষিণ ভারত, কখনও গৌড় বা বৃন্দাবনে গেলেও শেষ আঠারো বছর কাটিয়েছেন নীলাচলে। এখানকার রাধাকান্ত মঠে (সেই সময়ের কাশী মিশ্রের ছোট্ট একটা কুটির) তিনি সেই সময় অবস্থান করতেন। আর নিয়ম করে প্রতিদিন শ্রীশ্রীজগন্নাথ দর্শন করতেন। পাশাপাশি মগ্ন থাকতেন কৃষ্ণকথা আস্বাদনে। বাঙালিরা পুরী গেলে আজও শ্রীশ্রীজগন্নাথ দর্শনের পাশাপাশি রাধাকান্ত মঠেও পুজো দেয়। চৈতন্যদেবকে স্মরণ করেই পুজো দেন তাঁরা। কেউ বা আবার শ্রীশ্রীজগন্নাথ দেবের সঙ্গে শ্রীচৈতন্যকে মিলিয়ে দেন।
যদুনন্দের পদাবলীতে সুন্দর একটি গল্প আছে। পুরীর রথযাত্রায় হঠাৎই একদিন রথ থেমে গেল। রাজার নির্দেশে হাতি দিয়ে ঠেলেও রথ এগচ্ছে না। তার কারণ চৈতন্যদেব রথের সামনে নৃত্য করছেন। যাঁর উদ্দেশে নৃত্য, সেই শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব নিজেই তা উপভোগ করছেন। তাই নড়তে ইচ্ছে করছে না স্বয়ং তাঁর। অবশেষে চৈতন্যদেব মাথা দিয়ে ঠেলে রথকে নড়াবেন আর কী! ভক্ত-ভগবানের এই পরিপূরক সম্পর্ক রথযাত্রা ছাড়া আর কোথায় বা পাওয়া যায়! যদুনন্দের পদাবলীতে ভক্ত-ভগবানের এই লীলা অনায়াসে বৈষ্ণব-সাহিত্যে নবরূপ পেয়েছে। পদাবলীর শরীরে মিশে গিয়েছে রথের রশি আর রসের ধারা। ‘জগন্নাথ অষ্টক’ স্তোত্রের সপ্তম শ্লোকে শ্রীচৈতন্য বলেছেন, ‘যিনি নীলাদ্রির উপর অনন্তের শিরে পদার্পণ করেন, পরব্রহ্ম হয়েও শ্রীরাধিকার অসময়ে দেহ আলিঙ্গনে সতত সুখী, সেই প্রভু জগন্নাথ আমার নয়নপথগামী হোন... জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে।’
রথের মেলায়
রথের মেলা বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য। শ্রীরামপুরের মাহেশ, হুগলির গুপ্তিপাড়া, কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ি, পুরুলিয়ার পঞ্চকোট, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, মেদিনীপুরের মহিষাদল, নবদ্বীপ-এর মনিপুরী রাজবাড়ি, শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ি, মায়াপুরের ইসকন মন্দির সর্বত্রই মহা সাড়ম্বরে পালিত হয় রথযাত্রা। এক কথায়, বাঙালির পাড়ায় পাড়ায় রথ। যেন যত পথ, তত রথ। রথযাত্রার পাশাপাশি সেখানে বসে মেলা। রথের মেলা মানেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, পাঁপড় ভাজা আর গরম গরম জিলিপি। ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা, ‘তোদের হলুদবরণ গা,/ তোরা রথ দেখতে যা।/ আমরা পয়সা কোথা পাব,/ আমরা উল্টো রথে যাব।’ আসলে রথে যাওয়ার বায়নাক্কা থামাতে এই ধরনের ছড়া গ্রামগঞ্জে আজও প্রচলিত। রথের মেলায় যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে, কিন্তু অর্থনৈতিক দীনতার জন্য সেই ইচ্ছেকে কীভাবে সরিয়ে রাখতে হয়, এই ছড়া তারও একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলার আনাচে-কানাচে এখনও শোনা যায় উল্টো রথের গান। মায়ের অর্থনৈতিক অপ্রতুলতা বুঝতে পেরে সন্তান মাকে বলে থাকে, ‘সোজা রথে যাব না মা/ উল্টো রথে যাব।/ তোমার আমার পয়সা দিয়ে/ মুড়ি মুড়কি কিনে খাব।’
কয়েক দশক আগেও কলকাতার রাসবিহারী মোড় থেকে মৌলালির বিভিন্ন জায়গায় রথের মেলা বসত। কত কী যে সেই মেলায় পাওয়া যেত, তার ইয়ত্তা নেই। গৃহস্থালির সরঞ্জাম, প্লাস্টিকের খেলনা, হাতপাখা, ছুরি-কাঁচি-বঁটি ইত্যাদি। এখনও ই এম বাইপাসের ধারে মুকুন্দপুর, আনন্দপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় বসে রথের মেলা। ইলেকট্রিক নাগরদোলা, ব্রেক ডান্স, ট্রয় ট্রেন ইত্যাদিতে ছয়লাপ থাকে মেলাপ্রাঙ্গণ। দূরদূরান্ত থেকে দোকানিরা আসেন। সপ্তাহভর চলে বিকিকিনি। জামা-কাপড়, স্টিলের বাসন কত কিছু পাওয়া যায়। কথাচিত্রকার দীনেন্দ্রকুমার রায় পল্লি বাংলার রথের মেলা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘অগণ্য মক্ষিকাসমাচ্ছন্ন মোণ্ডা, গোল্লা, মেঠাই, ছোট ছোট জিলিপি... নানা আকার, নানা রঙ্গের পুতুল। স্ত্রী লোকেরা কেহ ছেলেদের জন্য পুতুল কিনিতেছে, কেহ বা হাঁড়ির দর করিয়া তাহা ভাঙ্গা কিনা পরীক্ষা করিবার জন্য বাজাইয়া দেখিতেছে।’
শুধু দীনেন্দ্রকুমারই নন, কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় রথের মেলার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে, ‘সহরে রথ পার্বণে বড় অ্যাকটা ঘটা নাই, কিন্তু কলিকাতায় কিছু ফাঁক যাবার নয়।... মাটীর জগন্নাথ, কাঁঠাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও শোলার পাখি বেধড়ক বিক্রি হচ্চে। ছেলেদের দ্যাখাদেখি বুড়ো মিনসেরাও তালপাতের ভেঁপু নিয়ে বাজাচ্চেন।’
পুরীর জগন্নাথধামের ‘আনন্দবাজার’ থেকে সারা ভারতের মানুষ মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে। প্রতিদিন এখানে ছাপান্ন পদের ভোগ হয়। রান্নাঘরে প্রায় আটশো রাঁধুনি অষ্টপ্রহর কাঠের আগুনে তৈরি করে চলেছে মহাপ্রসাদ। ভাত, ডাল, বিভিন্ন ব্যঞ্জনের পাশাপাশি রয়েছে মালপোয়া ও রাবড়ি ভোগ। গ্রামের রথের মেলায় অল্প হলেও খাওয়ার মজাটা কিন্তু কম নয়। শালপাতার ভেঁপু বাজনার তালে পাঁপড় আর রসে ডোবানো গরম জিলিপি খাওয়ার মজাটাই আলাদা।
রথ ও হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা
বাঙালির ছেলেবেলার সঙ্গে রথের আজন্ম সম্পর্ক। স্কুলে রথযাত্রায় ছুটি থাকে। আর উল্টো রথে হাফ-ছুটি। শৈশব পার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেই শৈশবে কেউ একটা রথ কেনেনি বা রশি ধরে রথ টানেনি, একথা ভাবাই যায় না। লাল, হলুদ বা সবুজ পতাকা ওড়ানো রথ—যার মধ্যে ছোট্ট একটি খোপ—যেখানে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা নিজ-নিজ আসনে বসে। এ ছবি গ্রামগঞ্জেও অহরহ দেখা যায়। বাজারে দেদার বিকোয় ছোটদের রথ। যাদের কেনার সামর্থ্য নেই, তারা চারটে চাকা আর কাঠকুটো দিয়ে কি অনায়াসেই না তৈরি করে ফেলে আস্ত একটি রথ।
বাঙালির সঙ্গে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব আছেন রাজপথ বা মেঠোপথ জুড়ে। যে রথের রশি ধরে আমাদের ছেলেবেলা কাটে, তারই বড়বেলার উন্মাদনা পুরী। সঙ্গে সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর আছড়ে পড়া ঢেউ। বালি, জল, কাদা, রোদ্দুরে মাখা এ যেন আরেক স্বর্গদ্বার।
রথযাত্রায় তালপাতার ভেঁপু বাজানোর কথা বেশ মনে পড়ে। ছেলেবেলায় আধো আধো না-ফোটা বুলি দিয়ে আধো আধো ফুঁ-তে ভেঁপু বাজালে মনে হয় চর্যার যুগ থেকে স্বয়ং কাহ্ন বা ভুসুকুপাদ নেমে এলেন। বড়বেলায় জানলা দিয়ে উঁকি মারলেই চোখে পড়বে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা। যেখানে ছোটরা রঙিন কাগজে মোড়া অল্প-বেঁকা রথ নিয়ে পথে নেমেছে। কোনও রথের চাকা গর্তে পড়ে সুভদ্রা গিয়েছেন উল্টে। কোনও রথে জগন্নাথ বা বলরাম তিনতলায় বসে নড়বড় করছেন। এ এক নস্টালজিয়া! 
রথ দেখা ও কলা বেচা
পুরীর পর ভারতের প্রাচীনতম হল মাহেশের রথযাত্রা। ঐতিহাসিকদের মতে, এই রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল ১৩৯৬ সালে। জনশ্রুতি, সেই সময় থেকে আজও শ্রীরামপুর ও স্থানীয় অঞ্চলের মানুষজন রথযাত্রার দিন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের দিকে কলা ছুঁড়ে দেন। দূরদূরান্ত থেকে কলার জোগান দিতে এবং সরবরাহ বজায় রাখতেই গ্রামের চাষিরা কলা বিক্রি করতে আসেন এই মেলায়। আর সেখান থেকেই রথ দেখার সঙ্গে কলা বেচার সম্পর্কটা একাকার হয়ে গিয়েছে।
নিশ্চিতরূপে এটা একটি বাগধারা। আর এই বাগধারার পিছনেই রয়েছে মাহেশের রথযাত্রার সামাজিক রীতি। আসলে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই ভিন্ন রূপ। বাঙালিরা তাঁকে নিজেদের মতো করে গ্রহণ করার সময়ে বদলে ফেলেছিল। যেমনভাবে বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ মহাকাব্য, কৃত্তিবাসের হাতে পাঁচালির রূপ পেয়েছিল। আসলে বাঙালি গৃহস্থের সন্তানেরা যেমন কোনও আত্মীয়বাড়ি যেতে পথের মধ্যে খিদেয় ক্লান্ত হয়ে যায়— অনুমান, ঠিক তেমনই মাসির বাড়ি যাওয়ার সময় শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবেরও খিদে পায়। বাঙালি লোকাচার অনুযায়ী সেই খিদে নিবারণের জন্যে তিনি কলা খান। তাই ভক্তরা তাঁকে তাঁর পছন্দের ফল উৎসর্গ করেন। শত শত বছর ধরে চলতে থাকা এই রীতি বর্তমানে লোকাচারে রূপান্তরিত হয়েছে।
রথের রাধা-রানি
রথ নিয়ে কতই না গল্প লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। তার মধ্যে অন্যতম বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারাণী’। রবীন্দ্রনাথ ‘রথের রশি’ নাটকে প্রজাদের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর কাছে রথ জীবনদেবতার চলমান সিংহাসন। পুরোহিত, রাজা বা মন্ত্রী নয়— জীবনরথকে চিরদিন সচল রেখেছে প্রজা। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে অথচ পরীক্ষার্থীরা দু’পঙ্‌তির ভাব সম্প্রসারণ করেনি, তা হতে পারে না। যেমন, ‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধূমধাম/ ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।’ কোথাও হঠাৎ প্রচণ্ড ভিড় হলে রথযাত্রার ভিড়ভাট্টার কথা স্মরণে রেখেই মানুষকে বলতে শোনা যায় ‘এখানে কি রথ উঠেছে?’
বঙ্কিমচন্দ্র মাহেশের রথে রাধারানিকে হারিয়ে যাওয়ার কথা লিখেছেন। পুরীর রথযাত্রার আদলেই একসময় তৈরি হয়েছিল মাহেশের রথ। বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ১৮৭৫ সালে লিখেছিলেন, রথের মেলার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার গল্প ‘রাধারাণী’। এই গল্পটির ব্যঞ্জনা দু’দিক থেকে। সেই সময় রথের মেলায় যে প্রচণ্ড ভিড় হতো, তার ইঙ্গিত মেলে। তেমনই রথের রশি ধরে টানতে টানতে জনসাধারণের উল্লাস চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া রাধারানির কান্না সেদিন কারও কানে পৌঁছয়নি। ১৮১৯ সালের ১৯ জুন ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা জানাচ্ছে, ‘জগন্নাথক্ষেত্রে রথযাত্রাতে যেরূপ সমারোহ ও লোকযাত্রা হয়, মাহেশের রথযাত্রাতে তাহার বিস্তর ন্যূন নহে। এখানে প্রথম দিনে অনুমান দুই লক্ষ লোক দর্শনার্থে আসে।’
বঙ্কিমচন্দ্র সূক্ষ্মভাবে জানাননি, রাধারানি সেদিন কী রথ দেখেছিল বা তার কেমন লেগেছিল রথের মেলা। কিন্তু তার হারিয়ে যাওয়া মনে করায় শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী-শক্তি শ্রীরাধিকার যন্ত্রণার কথা। ভারতীয় পুরাণে আছে, কুরুক্ষেত্র থেকে যুদ্ধ শেষে যখন শ্রীকৃষ্ণ ফিরছে তখন তার গায়ে ছিল রাজবেশ। তা দেখে হতাশ হয়েছিলেন শ্রীরাধিকা সহ গোপিণীগণ। হাজার চেষ্টা করেও তারা শ্রীকৃষ্ণকে মধু-বৃন্দাবনে নিয়ে যেতে পারেননি। পরিবর্তে রথের রশি ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন পুরীর বৃন্দাবন গুণ্ডিচা মন্দিরে। সেদিনই শ্রীকৃষ্ণের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন রাধারানি। তাঁর স্থান হয়নি রথ-মন্দিরে। তাই রথযাত্রায় শোভা পায় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারাণী’ গল্পে রথের মেলা থেকে রাধারানির হারিয়ে যাওয়া কী সেই ইঙ্গিতই দেয় না!
রথযাত্রা, শুভযাত্রা 
বাংলায় রথ-সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল সম্ভবত শ্রীচৈতন্যদেবের নীলাচল অর্থাৎ পুরী যাওয়ার পর থেকে। চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। ‘যাত্রা’ শব্দের অর্থ গমন। তাই শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা এবং উল্টো রথ হিন্দু-বাঙালিদের কোনও মাঙ্গলিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সূচনার পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক জায়গায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসবের সূচনাও হয় এই শুভ দিনে। দুর্গা মণ্ডপের খুঁটিপুজো হয়। দুর্গা প্রতিমার কাঠামোয় মাটি পড়ে রথযাত্রায়। সাধারণত পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয় তৃতীয়ায় বাঙালিরা দোকানে দোকানে হালখাতা করে। কিন্তু বর্তমানে বহু দোকানেই হালখাতা অনুষ্ঠিত হয় রথের দিনে। অনেকেই নিজেদের নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ করে রথযাত্রার দিনেই। গৃহের ভিতপুজোতেও এই দিনটি সকলের পছন্দের। বাংলা ছায়াছবির শুভ মহরত অনুষ্ঠানের জন্যও অনেক প্রযোজকের কাছে রথযাত্রা আদর্শ ক্ষণ। শুধু প্রযোজক কেন, প্রকাশকরাও আলাদা নন। বইপাড়ায় নতুন বইয়ের প্রকাশ বা গ্রন্থ উদ্বোধনের জন্য এই দিনটিকে শুভ বলে মনে করা হয়। চিৎপুরের যাত্রা কোম্পানিতে আবার রথযাত্রা মানেই উৎসবের মেজাজ। যাত্রাপালার বাজার বর্তমানে নিম্নমুখী। তবু চিৎপুরের অপেরা হাউসে বায়না শুরু হয় রথযাত্রার দিনে। খবরের কাগজে নতুন যাত্রাপালার বড় বড় বিজ্ঞাপন সেদিনেই বেশি করে চোখে পড়ে।
রথযাত্রা নারী-পুরুষের প্রেমযাত্রারও শুভ সন্ধিক্ষণ। অনেক নতুন প্রেমের অঙ্কুরোদ্গম ঘটে এই দিনেই। এক হাতে প্রেমিকা, অন্য হাতে জিলিপির মিষ্টি রস! মাথার উপর থেকে যদি ছাতাটা উড়ে যায়, তবে দু’জনে একসঙ্গে রথবৃষ্টিতে ভেজার মজাটাই আলাদা! শ্যালিকারা অবশ্য জামাইবাবুর সঙ্গে রথের মেলায় যেতে ইতস্তত করে, ‘আমি যাব না, যাব না, যাব না রথের মেলাতে।’ গোষ্ঠগোপাল দাসের গাওয়া বাউল গানটির সুরে তারা যেন গেয়ে ওঠে, ‘ও জামাইবাবু যাব না রথের মেলাতে...।’
লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
 গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
  সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস

রাশিফল