প্রচ্ছদ নিবন্ধ

ইডেনে প্রোটিয়া প্রত্যাবর্তন

সৌরাংশু দেবনাথ: বর্ণবৈষম্যহীন দুনিয়ায় স্বাগত, হে ক্লাইভ রাইস বাহিনী! ১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর একলাখি ইডেনের এটাই ছিল অভ্যর্থনার মূল সুর। কোনওদিন তা ভোলা সম্ভব নয় প্রোটিয়াদের। প্রবল গর্জনের সঙ্গে সেই লগ্নে লাল বল হাতে ছুটে এসেছিলেন কপিল দেব। জিমি কুকের নামটাও একইসঙ্গে খোদিত ইতিহাসে। ফিরে আসার লগ্নে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে প্রথম বল তিনিই খেলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ি পড়েছিল বর্ণবৈষম্যের এক কলঙ্কিত অধ্যায়ে। 
ব্রিটিশ অধ্যুষিত দক্ষিণ আফ্রিকায় সেটাই ছিল রীতি। লোহার হাতকড়ি আর নেকড়ের চেয়েও তীক্ষ্ণ নখ হাতে রামধনুর দেশে এসেছিল মানুষ-ধরার দল। দিনের পর দিন কৃষ্ণাঙ্গদের উপর চলেছে নির্যাতন। সভ্যতার লোভ, বর্বরতায় রক্তাক্ত হয়েছে মানবতা। নিত্যদিন শোষিত হয়েছে সেখানের ভূমিপুত্র ও ভূমিকন্যারা। কবিগুরুর ‘আফ্রিকা’ কবিতা সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জ্বলন্ত দলিল। গায়ের রঙের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের কলুষতা অবশ্যই নতুন নয়। কিন্তু সভ্যতার তকমাধারীরা যখন সেটাই করেন, তখন তা হয়ে ওঠে চরম অপরাধ। কালো চামড়ার প্রতি অবর্ণণীয় অত্যাচার চলেছে বছরের পর বছর। ১৯৭০ সালে সেজন্যই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বহিষ্কৃত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। ফলে গ্রেম পোলক, পিটার পোলক, ব্যারি রিচার্ডসের মতো ক্রিকেট প্রতিভা সর্বোচ্চ মঞ্চে নিজেদের সেভাবে মেলে ধরার সুযোগই পাননি। কেপলার ওয়েসেলসের মতো কেউ কেউ চলে গিয়েছেন অন্য দেশে। রাইসের মতো অনেকের সেরা সময় কেটেছে হতাশায়। 
তিন দশক আগের নভেম্বরের সকাল তাই নিছক একটা তারিখ ছিল না। তা আদতে ছিল সূর্যোদয়ের মুহর্ত। 
রাইসও তাই এই ম্যাচকে ‘চাঁদে পা রাখার অনুভূতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুই দশকেরও বেশি, ঠিক ২১ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। প্রথমবার পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের স্বাদ পাওয়া সেই দলের নেতা ছিলেন রাইস। ইডেনে কেরিয়ারের পড়ন্তবেলায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে গ্যালারির উদ্দেশে দু’হাত জড়ো করে প্রণামে ফুটেছিল সেই কৃতজ্ঞতা।
তথ্যের খাতিরে লেখা যাক, ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। তার পর কোনও দেশ সরকারিভাবে আসেনি ক্রিকেট সফরে। কারণ বর্ণবৈষম্যের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে নির্বাসিত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। মাঝে মাঝে অবশ্য বিদ্রোহী ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া দল আসত দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু তার পরিসংখ্যান ঠাঁই পেত না রেকর্ড বইয়ে। এই সময়ই জগমোহন ডালমিয়ার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরল দক্ষিণ আফ্রিকা। দুই দশকেরও পর সেদেশের ক্রিকেট মহলে জাগল আশা।
ইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, বর্ণবৈষম্যর সঙ্গে আর একটা নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অবধারিতভাবেই তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা। বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের জন্য ২৭ বছর জেলে বন্দি থাকার পর সেই অক্টোবরেই মিলেছিল মুক্তি। তার কিছুদিনের মধ্যেই ভারত সফরের লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়া। তাঁর কাছে যা ছিল তীর্থস্থান দর্শনের মতোই পবিত্র অনুভূতি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও গান্ধীজির আদর্শ অনুপ্রাণিত করেছিল ম্যান্ডেলাকে। তবে নেতাজির বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডই প্রধানত জোগায় মোটিভেশন। সুভাষের শহরে আসতে  সেজন্যও বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। ইডেনে ‘উই শ্যাল ওভারকাম সামডে’ সুরে গলা মেলান তিনি। ভূপেন হাজাারিকা গেয়েছিলেন ‘ম্যান্ডেলা ম্যান্ডেলা’। পুরো অনুষ্ঠান জীবন্ত হয়ে উঠেছিল অজয় বসুর ধারাভাষ্যে। ম্যান্ডেলার জন্য রাজভবনে ছিল বিশেষ নৈশভোজের ব্যবস্থাও। সেদিন ইডেনে থাকা গবেষক শুভ্রাংশু রায়ের মতে, ‘গায়ে কাঁটা দেওয়া মুহূর্ত। ম্যান্ডেলার চোখমুখ থেকে ঝরে পড়ছিল তৃপ্তি। পরবর্তী  লড়াইয়ের রসদ যেন এই সংবর্ধনা থেকেই পাথেয় করে নিয়েছিলেন তিনি।’ ম্যান্ডেলাও তো বলে উঠেছিলেন, ‘ব্যাটারিগুলো যেন রিচার্জ হল!’
ম্যান্ডেলা ঘুরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই গঙ্গাপারের শহর সাক্ষী থাকল আরও এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের। ইডেন আপন করে নিল অ্যালান ডোনাল্ড, ব্রায়ান ম্যাকমালান, কেপলার ওয়েসেলসদের। বাইশ গজের রণভূমিতে অবশ্য ছিল পেশাদারি লড়াই আর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। আবহাওয়া জনিত কারণে ৪৭ ওভারে নেমে আসে ম্যাচ। কপিল দেব ও মনোজ প্রভাকরের দাপটে দু’শোর ওপারে পৌঁছতে পারেনি সফরকারী দল। আট উইকেটে ১৭৭ রানে থামে দক্ষিণ আফ্রিকা। হাফ-সেঞ্চুরি করেন ওয়েসেলস। আড্রিয়ান কুইপারের সংগ্রহ ৪৩। 
সেই পুঁজি নিয়েই অবশ্য হার-না-মানা লড়াই মেলে ধরে তারা। ‘সাদা বিদ্যুত’ অ্যালান ডোনাল্ড নেন পাঁচ উইকেট। ভারতীয় ইনিংসের হাড়ে হাড়ে ধরান কাঁপুনি। প্রবল চাপে পড়ে যাওয়া হোমটিমের ড্রেসিং-রুমকে স্বস্তি জোগান অবশ্য ১৯ বছরের শচীন তেন্ডুলকর। করেন ৬৬। অদম্য প্রভীন আমরের সংগ্রহ ৫৫। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হাসতে হাসতেই ১-০ করে ভারত। ৩৮ বল বাকি থাকতে জয় আসে তিন উইকেটে। তবে ডোনাল্ড নামের কাঁপুনিটা থেকেই গিয়েছিল।  
স্কোরবোর্ড অবশ্য ওই ম্যাচের তাৎপর্যকেই তুলে ধরে না। সাধে নেভিল কার্ডাসের কাছে তা স্রেফ ‘গাধা’। অবশ্য এটাও মানতে হবে যে তা চিরকালের জন্যই সাজিয়ে রাখে পরিসংখ্যান। ইঙ্গিত দেয় ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহেরও। সেজন্যই তো ডোনাল্ডের মধ্যে মহাতারকার ইঙ্গিত ঘোষিত করে স্কোরবই।
সেই স্মৃতি উসকে দিয়ে আজ ইডেনে ফের মুখোমুখি ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। শোনা যায় সিএবি কর্তারাই নাকি আগ্রহ দেখিয়েছেন এই মোকাবিলার জন্য। বিপক্ষের প্রতি সেই আবেগ থাকার কথা নয়, থাকবেও না নির্ঘাত। একলাখি দর্শকাসনই বা কোথায়? এখন তা ৬৬ হাজারের আশেপাশে। কমেছে গঙ্গার হাওয়ায় বিপজ্জনক হয়ে ওঠা সুইংও। আবেগ ছেঁটে আমরাও কি যান্ত্রিক হয়ে উঠিনি?
ম্যান্ডেলা-রাইসের চোখে যে ইডেন ধরা পড়েছিল, কুইন্টন ডি’কক, আইডেন মার্করামরা অবশ্যই তা দেখবেন। এই শহরের জীবনদর্শন চিরকালই আলাদা। হৃদয় দিয়ে বিচার করে বলেই তো বাঙালিরা একটু নয়, অনেকটাই আলাদা। এই শহর বিপক্ষের রক্ত দেখতে চায় না। বরং ভালোবাসায় বরণ করে নেয়। আর তাই কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিডিদের জন্যও তাই থাকবে গাঁদার মালার উপচার। 
রবিবাসরীয় ইডেন অবশ্য সাক্ষী হবে এক সন্ধিক্ষণের। ম্যান্ডেলার স্মৃতিবিজড়িত মাঠে টস করতে নামবেন ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ তেম্বা বাভুমা। একটা বৃত্তই যেন পূর্ণ হয়ে উঠবে। ম্যান্ডেলার সংবর্ধনা যেখানে হয়েছিল, নির্বাসন কাটিয়ে উঠে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেখানে ফিরেছিল, সেখানেই ফের উড়বে বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী পতাকা। বাভুমা তাই নিছক প্রোটিয়া ক্যাপ্টেন নন, হয়ে উঠছেন প্রতীক। ম্যান্ডেলার যথাযথ উত্তরসূরিও। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লবী নায়ক নিশ্চয় কখনও ভাবেননি যে এই মাঠেই একদিন তাঁর দেশের হয়ে টস করতে নামবেন কালো চামড়ার কেউ। এমন চিত্রনাট্য তো বলিউডেও মেলা ভার। ঈশ্বর ছাড়া এ স্ক্রিপ্ট কারও হতেই পারে না যে!
 গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
 সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়
13Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পেশাদারি কাজকর্মে উন্নতি ও আয় বৃদ্ধির যোগ। জ্ঞাতি শত্রুদের থেকে সতর্ক থাকবেন। স্বাস্থ্য খুব একটা...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.৭৩ টাকা৮৫.৪৭ টাকা
পাউন্ড১০৫.৮৫ টাকা১০৯.৬১ টাকা
ইউরো৮৭.৮২ টাকা৯১.২১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা