গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা কাশী যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে পুত্র বৈদ্যনাথ তেলিনীপাড়াতেই অন্নপূর্ণা মন্দির স্থাপন করেন ও সেই মন্দিরের এক কক্ষে মাকে রাখার ব্যবস্থা করেন। গঙ্গার পশ্চিমকূল বারাণসী সমতুল। তেলিনীপাড়া গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে। মন্দিরে পাইপের মাধ্যমে গঙ্গাজল আনার ব্যবস্থাও করেন। অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১২০৮ সালে। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন কাজ শুরু হয়। মন্দির উদ্ঘাটন হয় দোলপূর্ণিমার দিন। কাশীর অন্নপূর্ণা জগতে বিখ্যাত। সেই মূর্তিরই প্রতিরূপ রয়েছে তেলিনীপাড়ার অন্নপূর্ণা মন্দিরে। স্বর্ণনির্মিত দেবী অন্নপূর্ণার মূর্তিতে আছে অষ্টধাতুর প্রলেপ। শিব রুপোর। ধুতি পরা শিবের গলায় উপবীত। ডান হাতে ভিক্ষা চাইছেন, বাঁ হাত উত্তোলিত। শিঙা ধরে আছেন। দেবী অন্নপূর্ণা অন্নভাণ্ড নিয়ে বসে আছেন। কাশীর স্বর্ণনির্মিত অন্নপূর্ণায় শিব একটু কৌণিক রূপে দণ্ডায়মান। তেলিনীপাড়ার শিব সোজা দর্শকদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে।
একবার বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় গঙ্গার ধার থেকে ফিরছেন এমন সময় এক সাধুর মুখোমুখি হলেন। সাধু বৈদ্যনাথকে দেখে অত্যন্ত প্রীত হলেন। বললেন, ‘শোনো, আমার বয়স হয়েছে। আমাকে এবার চলে যেতে হবে। তুমি ব্রাহ্মণ। তোমাকে একটি গুরুদায়িত্ব দেব। না বোলো না।’ সাধু তাঁর নিজের পুজো করা সোনার লক্ষ্মী নারায়ণ বিগ্রহ বৈদ্যনাথের হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘প্রতিদিন এই বিগ্রহের পূজার্চনা করবে। তোমার ভালোই হবে।’ সাধু অন্তর্হিত হলেন।
বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্নপূর্ণা মন্দির স্থাপন করে সেখানে শিব-অন্নপূর্ণার সঙ্গে লক্ষ্মীনারায়ণকেও প্রতিষ্ঠা দেন। শুরু হয় নিত্য পূজার্চনার ব্যবস্থা।
অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য তিথিতে অন্নপূর্ণা মন্দিরের পিতলের রথে চেপে মহাদেব ও অন্নপূর্ণাদেবী নগর পরিক্রমা করেন। মন্দির থেকে কাঙালিবাবুর ঘাট পর্যন্ত দেবী যান। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠার শুভ সূচনা হয়েছিল খননকার্যের মাধ্যমে। তাই মন্দির-প্রতিষ্ঠাতা বৈদ্যনাথ ওই দিনই রথযাত্রার সূচনা করেন। দেবী অন্নপূর্ণা তাঁর পতিকে নিয়ে সকালে রথে চেপে গঙ্গাতীরে কাঙালিবাবুর ঘাটে যাওয়ার পথে ভক্তের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রথেই ভক্তের পূজা গ্রহণ করেন।
রথ পৌঁছে যায় গড়ের ঘাটে। ১০৮ ঘড়া কাঁচা দুধে মায়ের স্নান হয়। সেদিন ওখানেই জনগণের অন্নসেবার ব্যবস্থা থাকে। ভেজানো কাঁচাছোলা,
আখের গুড় ও জল দিয়ে ভক্তবৃন্দ দেবদেবীকে রথে আপ্যায়ন করেন। এই প্রসাদই দেবীকে নিবেদন করা হয় কাঙালিবাবুর ঘাটেও। সেখানে দেবী অন্নপূর্ণা ও মহাদেব মাটির বেদীতে অবস্থান করেন। তাঁদের প্রতি ভোগ নিবেদন করা হয় মাটির পাত্রে। বৈদ্যনাথবাবুর মৃত্যুর পর দেবীমূর্তি মন্দির থেকে চুরি হয়ে যায়। চোর ওই মূর্তি নিয়ে যাওয়ার সময় গড়ের ঘাটে গিয়ে অন্ধ হয়ে যায়। চোর ওই মূর্তি গঙ্গার ধারেই ফেলে রাখে। এক শবর ওই সুন্দর দেবীমূর্তি দেখে বুঝতে পারেন এই মূর্তি বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির অন্নপূর্ণা। তখন তিনি তাঁর সাধ্যমতো মাটির বেদী নির্মাণ করে মাটির থালা বাটি গ্লাসে কাঁচা ছোলা ভেজানো, আখের গুড় ও জল দিয়ে দেবীর অর্চনা করেন। সেই থেকে এই নিয়ম এখনও চলে আসছে।
একবার কাঙালিবাবুর ঘাট থেকে দেবদেবী দিবাবসান হলে মন্দিরের দিকে ফিরছেন। তেলিনীপাড়া অন্নপূর্ণা বারোয়ারি তলায় এসে রথ থেমে গেল। হাজার চেষ্টা করেও রথকে নড়ানো গেল না। অবশেষে মন্দির থেকে লক্ষ্মীনারায়ণকে পালকিতে চাপিয়ে অন্নপূর্ণা বারোয়ারির কাছে আনা হল, লক্ষ্মীনারায়ণ অন্নপূর্ণার মানভঞ্জন করলেন। রথ আবার চলতে শুরু করল। লক্ষ্মীনারায়ণকে নিয়ে পালকি যখন অন্নপূর্ণাকে মান ভাঙিয়ে আনার জন্য যেত, তখন কালোবাবু জীতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি গান গাইতে গাইতে যেত বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যেরা।
সেই গান এখনও গাইতে গাইতে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যেরা এগিয়ে চলেন রথের দিকে।
‘আনতে শিব অন্নপূর্ণা,
চল সবে যাই গো ত্বরা,
অবসান হল দিবা,
উচিত নয় বিলম্ব করা।।
তৃতীয়ার উপলক্ষ্যে,
হরগৌরী অন্তরীক্ষে,
রথেতে গঙ্গা সমক্ষে,
বিরাজিছেন মনোহরা।।
সত্বর পদ সঞ্চারে,
চল যাই জাহ্নবী তীরে,
বুঝি মা রেখেছেন হরে
হয়ে বিরহ কাতরা।।’
রথ ফিরে আসে অন্নপূর্ণা মন্দিরে। দেবী অন্নপূর্ণা ও মহাদেবকে রথ থেকে নামিয়ে মন্দিরের চত্বরে রাখা হয়। সেখানে পুজোর আয়োজন চলে। তারপর সঠিক সময় সিংহাসনে দেবীকে স্থাপন করা হয়। সিংহাসনে দেবীর স্থাপন, সজ্জা ইত্যাদি পরিবারের পুরুষদের দ্বারাই করা হয়। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন একমাত্র, দেবী অন্নপূর্ণা ও মহাদেবকে ভক্তজন স্পর্শ করতে পারে।