তাঁর ছবির মুক্তি মানে সমালোচকদের দাঁত-নখে শান দেওয়ার সময়। এই হল সেই সময় যখন সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে শুরু হয় ই-ডার্বি। একপক্ষের দাবি, বাংলার সেরা পরিচালক তিনিই। আর এক পক্ষ মনে করে, ছবি পরিচালনা তাঁর কম্ম নয়। ‘শাহজাহান রিজেন্সি’ ছবিটি দেখে মনে হল, সৃজিত মুখোপাধ্যায় একটু নিশ্চিন্ত হবেন। এবার তাঁর সমালোচকরা একটু ব্যাকফুটে যাবেন বলেই মনে হয়। এককথায় বলা যায়, ঝকঝকে মশালা ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। ছবিটি হয়তো ‘আহা কী দেখিলাম’ মার্কা অনুভূতি দেবে না, কিন্তু দৃষ্টিসুখ দেবে নিশ্চিত।
শঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস ‘চৌরঙ্গী’-র উপর আধারিত ‘শাহজাহান রিজেন্সি’। বুদ্ধিমান পরিচালক শুরুতেই সুকৌশলে রুদ্র’র (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) মুখ থেকে বলিয়ে দিয়েছেন এই ছবি মোটেই উত্তমকুমার অভিনীত ‘চৌরঙ্গী’-র রিমেক নয়। বরং শঙ্করের ‘চৌরঙ্গী’-র জাতিস্মর মাত্র। তবে উত্তম-শুভেন্দু-সুপ্রিয়া অভিনীত ছবির সঙ্গে তুলনা যে হবেই তা ভালোই জানেন পরিচালক। তাই কোথাও আগের ছবি থেকে টোকার বদলে আরও জাপ্টে ধরেছেন মূল উপন্যাসটিকে।
সৃজিত জানতেন, এই ছবিতে পারফরম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ। তাই এমন শিল্পী নির্বাচন করেছেন, যাঁদের খারাপ অভিনয় করাটাই বিস্ময়ের। আবির চট্টোপাধ্যায়ের মার্জিত ও পরিশীলিত ইমেজ দারুণ কাজে এসেছে। চরিত্রটি এই মুহূর্তে বাংলার অন্য কোনও অভিনেতা করতে পারতেন বলে মনে হয় না। সোনারপুরের নিম্ন মধ্যবিত্ত যুবক রুদ্রর চরিত্রে পরমব্রতও দারুণ। একদম শেষে লিফ্টে কান্নার দৃশ্যটা বাদ দিলে গোটা ছবিতে তাঁর অভিব্যক্তি অসাধারণ। গায়িকার চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও যথাযথ। অন্যরকম একটি চরিত্রে ঋত্বিকা সেনও ভালোই উতরে দিয়েছেন। সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, মমতাশঙ্করও বেশ ভালো। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের নামের পাশে ভালো, দারুণ বিশেষণ আগেও ব্যবহৃত হয়েছে। এই ছবিতেও তিনি তেমনই। অঞ্জন দত্ত সৃজিতের আস্থার প্রতি মর্যাদা দিয়েছেন। তবে ‘উওম্যান অব দ্য ম্যাচ’ স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভিভিএস লক্ষ্মণ আর সৃজিতের ছবিতে স্বস্তিকা কার্যত সমানুপাতিক। ঔদ্ধত্য হোক কী কান্নায় ভেঙে পড়া, ছবির প্রতিটি ফ্রেমেই স্বস্তিকা ভেরি ভেরি স্পেশাল। স্মার্ট সংলাপ আর ছোট ছোট সিকোয়েন্সে সামাজিক ধ্যাষ্টামোকে থাপ্পড় কষিয়েছেন পরিচালক। নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করতেও ছাড়েননি। ‘ঘুরে তাকাও’ গানের একটি দৃশ্যে ফাঁকা সিনেমা হলে ‘নির্বাক’ দেখতে গিয়ে আবিরের পাশে ঘুমন্ত ঋত্বিকাকে দেখে হাসি পাবেই। শিল্প নির্দেশক শ্রীমন্তকুমার দাস বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন। আবহসঙ্গীতে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত ও সঙ্গীতে অনুপম রায় এবং প্রসেনও চমকপ্রদ। ক্যামেরা, শব্দ যথাযথ হলেও সম্পাদক প্রণয় দাশগুপ্তর আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত ছিল। ছবির দ্বিতীয়ার্ধ কিন্তু বেশ মন্থর।
সবই হল, কিন্তু দু’খানা প্রশ্ন রয়ে গেল! নেগেটিভ চরিত্র বোঝাতে কাঞ্চন মল্লিককে অদ্ভুত পোশাক আর বিকট ফ্রেমের চশমা পরানো আর অবাঙালি শিল্পপতির চরিত্রে বাবুল সুপ্রিয়কে এমন স্টিরিওটিপিক্যাল দেখালেন কেন? এছাড়া পল্লবী চট্টোপাধ্যায়-ঊষসী চক্রবর্তীর চরিত্র এবং আরও টুকরো কয়েকটি শট, সিকোয়েন্স ছবি থেকে বাদ যেতে পারত। এন্ড ক্রেডিটে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে গল্পকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ ও পরিচালনা লেখা হয়েছে। ‘গল্পকার’-এর তকমাটা কোনওভাবে বাদ দেওয়া যেত না কি?
শুভম বসু