হঠাৎ পাওয়া যোগাযোগের মাধ্যমে কর্ম জটিলতার অবসান ও মানসিক চিন্তামুক্তি। আয় ব্যয়ের ক্ষেত্র ঠিক থাকবে ... বিশদ
স্বপ্ন সেটা নয় যেটা ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন হল সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না’—কথাটি বলেছিলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ এ পি জে আব্দুল কালাম। তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে দরিদ্র পরিবারের ছেলেটি ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, তিনি একদিন আকাশ ছোঁবেন। সমুদ্রের তীরে বসে অবিরাম তাকিয়ে থাকতেন আকাশের দিকে। কীভাবে ডানায় ভর দিয়ে উড়ে চলে অসংখ্য পাখি। মানুষের ডানা নেই। কিন্তু বিমানে ভর দিয়ে তো সেও উড়ে যেতে পারে। স্বপ্ন দেখার শুরু সেদিন থেকেই। তারপর জীবনে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিশ্ব দরবারে তিনি পরিচিত হন ‘মিসাইল ম্যান’ নামে।
স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার
সালটা ১৯৫৮। মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেছেন এ পি জে আব্দুল কালাম। বিষয় অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। পদার্থবিজ্ঞান ছেড়ে এই বিষয় নিয়ে পড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়া। তাঁর ছোটবেলার স্বপ্ন। আর সুযোগও পেয়ে গেলেন। একসঙ্গে দু’টি সংস্থা ক্যাম্পাসিংয়ের জন্য হাজির হল। একটি বিমানবাহিনী। আর অন্যটি কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনস্থ ডিরেক্টরেট অব টেকনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রোডাকশন। দুটোতেই আবেদন করলেও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রথমটাই। অর্থাৎ বিমানবাহিনী। যোগ্যতার কোনও খামতি তাঁর ছিল না। কিন্তু বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন শারীরিক দক্ষতা। আর এখানেই পিছিয়ে পড়লেন কালাম। তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেছে নেওয়া হল ৮ জন পাইলটকে। কিন্তু কালাম ছিলেন তালিকায় নবম স্থানে। অবশ্য ‘ডিটিডি অ্যান্ড পি’-তে সফলভাবেই স্থান পেলেন তিনি। কিন্তু ছেলেবেলার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল এক লহমায়। আর এমন অবস্থায় আর সকলের যা হয় তাই হল আব্দুল কালামের। গভীর হতাশা গ্রাস করল তাঁকে। এরপর তিনি ছুটলেন হৃষীকেশ। সেখানে স্বামী শিবানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তাঁর। স্বামী শিবানন্দের কাছেই কালাম শিখেছিলেন জীবনে যা কিছুই আসে, তাকেই ঈশ্বরের দান বলে মাথায় ঠেকিয়ে নিতে হয়। তাই হৃষীকেশ থেকে কালাম সোজা পৌঁছে গেলেন দিল্লিতে। সেখানে যোগ দিলেন ডিটিডি অ্যান্ড পি-তে।
দেশের প্রথম হোভারক্রাফ্ট নির্মাণ
সেখানে বছর তিনেক কাজ করার পরই তৈরি হল স্বদেশি হোভারক্রাফট নির্মাণের সংস্থা অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট। হোভারক্রাফটের নকশা ও বাস্তবায়নের জন্য গঠন করা দলটির দায়িত্ব দেওয়া হয় আব্দুল কালামকে। অথচ দলের কারওরই নেই কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা। নেই কোনও উন্নত যন্ত্রপাতি। আব্দুল কালামের কাছে তাই এই প্রকল্প হয়ে উঠল একটা চ্যালেঞ্জ। পুরো কাজ শেষ করতে সময় দেওয়া হয়েছিল ৩ বছর। কিন্তু কালাম মাত্র ৬ মাসেই তৈরি করে ফেললেন দেশের প্রথম হোভারক্রাফট। নাম দেওয়া হল ‘নন্দী’। নন্দীর সফল উড়ান যেন প্রথম সাফল্যের স্বাদ এনে দিল কালামকে। এর পর ডাক পেলেন টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ থেকে। শুরু করলেন রকেট উৎক্ষেপণের কাজ। এই সময়েই ১৯৬৩ সালে তিনি গেলেন আমেরিকা। উদ্দেশ্য নাসার উন্নত প্রযুক্তি পর্যবেক্ষণ করা।
প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ
ভারতে ১৯৬৩ সালের ২১ নভেম্বর প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয়। সেটি ছিল সাউন্ডিং রকেট। নাসায় তৈরি এই রকেটটির নাম দেওয়া হয়েছিল নাইকি-অ্যাপাচি। সেই সময় রকেটটিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্বল ছিল একটি ট্রাক এবং হস্তচালিত একটি হাইড্রোলিক ক্রেন। নাইকি-অ্যাপাচির প্রথম উৎক্ষেপণের সময় আব্দুল কালামকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। রকেট সংযোজনের দায়িত্বে ছিলেন ঈশ্বরদাস। অরবমুদন ছিলেন রাডার, টেলিমেট্রি ও ভূমি সহায়তার দায়িত্বে। সফলভাবে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর আরও দায়িত্ব বাড়ল কালামের।
রোহিণী সাউন্ডিং রকেট
ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির যাত্রা প্রকৃতপক্ষে আরম্ভ হয়েছিল রোহিণী সাউন্ডিং রকেট কর্মসূচি দিয়ে। উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান (এসএলভি) এবং ক্ষেপণাস্ত্র থেকে একটি সাউন্ডিং রকেটের মধ্যে মূল পার্থক্য হল, মূলত এইগুলি তিন প্রকারের রকেট। সাউন্ডিং রকেট সাধারণত ব্যবহার করা হয় পৃথিবীর নিকটবর্তী পরিবেশ অনুসন্ধানের জন্য, তার মধ্যে বায়ুমণ্ডলের উচ্চতর ভাগও থাকে। যদিও সেগুলি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বিভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সেইসব যন্ত্রপাতিকে পরিক্রমণ কক্ষে স্থাপন করতে পারার মতো গতিশক্তি তারা সঞ্চার করতে পারে না। অন্যদিকে এসএলভি তার শেষ পর্যায়ে উপগ্রহকে কক্ষপথে প্রবেশের মতো গতিদান করে। ভারতে রকেট বিদ্যার অগ্রগতির জন্য যে মানুষটির অবদান সবথেকে বেশি, তিনি বিক্রম সারাভাই। তাঁর দৃষ্টি ছিল পরিষ্কার। তিনি মনে করতেন ভারতকে যদি জগৎসভায় কোনও মূল্যবান ভূমিকা নিতে হয়, তাহলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে কারও থেকে পিছিয়ে থাকলে চলবে না।
এসএলভি ৩
ভারত যখন নিজস্ব স্যাটেলাইট লঞ্চ সিস্টেম তৈরির প্রজেক্ট হাতে নেয়, তার আগে এই সক্ষমতা অর্জন করেছে মাত্র পাঁচটি দেশ। ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশকে মহাকাশ জয়ের এমন দুঃসাহসী স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন ডক্টর বিক্রম সারাভাই। কেবল স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন আব্দুল কালামের মতো অনন্য কয়েকজন ব্যক্তিকে। তাঁর হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র— ‘ইসরো’। ১৯৮০ সালের ১৮ জুলাই এসএলভি-থ্রি মহাকাশে পাঠানো হয় এবং রোহিণী স্যাটেলাইটকে স্থাপন করে পৃথিবীর কক্ষপথে। ষষ্ঠ দেশ হিসেবে নিজস্ব রকেট সিস্টেম দিয়ে কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের গৌরব অর্জন করে ভারত। এসএলভি-৩ প্রকল্পের সফল পরিণতি অগমেন্টেড স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (ASLV), পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (PSLV) এবং জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (GSLV)-এর মতো উন্নত উৎক্ষেপণ ভেহিকেল প্রকল্প।
মিসাইল ম্যান
আজ ভারতের যে সামরিক শক্তি, তার অনেকটাই নির্ভরশীল ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভারের উপর। এই ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভারের অনেকটাই এ পি জে আব্দুল কালামের অবদান। সেই কারণেই তাঁর আরেকটি পরিচয়— ‘মিসাইল ম্যান’। ভারতের তৈরি প্রথম ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল ‘অগ্নি’ লঞ্চ হয় ১৯৮৯ সালে। অগ্নি ও পৃথ্বী মিসাইল তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। ১৯৯৮ সালে পোখরানে ভারতের পরমাণু পরীক্ষার সম্পূর্ণ পরিকল্পনাই ছিল তাঁর। যে ছেলে সমুদ্রের ধারে বসে বসে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, দু’দশক ধরে তিনিই সমুদ্রের তীরে কত না ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছেন।