বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনাচিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
হুড়মুড় করে ক্লাসে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল ফার্স্ট বেঞ্চে। ঠিক দেখছি তো! আমাদের ধারণা, ফিজিক্স নিয়ে সাধারণত হাই-পাওয়ার চশমা পরা গম্ভীর মেয়েরাই পড়তে আসে। অথচ সেখানে ক্লাসরুম আলো করে বসে আছে এক পরমাসুন্দরী। একঝলক তার দিকে তাকিয়েই আমরা তিনমূর্তি মানে আমি ও আরও দুই ব্যাকবেঞ্চার হুড়মুড় করে উঠে গেলাম গ্যালারির শেষে। ওটাই আমাদের জায়গা। তিনজন। পাশাপাশি। ব্যাক বেঞ্চের সুবিধা অনেক। অন্য স্টুডেন্টদের আড়ালে কথা বলা যায়। গল্প করা যায়। ক্লাসের অনেকেই আড়ালে আমাদের বখাটে বললেও আমরা আদতে আঁতেলমার্কা। সবকিছুতেই একটা বিপ্লব-বিপ্লব ভাব। সবকিছুতেই একটা মানছি না মানব না গোছের হিরোইজম আর কী। পড়াশোনায় যে আমরা নেহাত খারাপ তা নয়। মফস্সল থেকে এসেছি। কাজেই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার কমফোর্ট বা সু্যোগ বড় একটা ছিল না। অস্বস্তি হতো। আর সেটাকেই আমরা নিজেদের পার্সোনালিটি বলে ভাবতাম। ক্লাস বাঙ্ক করে ক্যান্টিন, স্টুডেন্টস ইউনিয়নরুম, টিটি, ক্যারাম এসবের মধ্যেই কেমন একটা বোহেমিয়ান জীবনযাপন করার আনন্দ ছিল। কিন্তু এই মেয়েটিকে আজকে হঠাৎ দেখেই, তিনজনেরই কেমন যেন কিছু একটা ঘটে গেল। আগে ক্লাসের শেষে দুদ্দাড় করে ক্যাম্পাসের বাইরে যাওয়াই ছিল দস্তুর। মাঝেমধ্যে ক্লাস কেটে সিনেমা-নাটক। বৃষ্টির দিনে পরোটা কষা মাংস অভিযান। চায়ের আড্ডায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই ছিল জীবন। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে এই মেয়েটি আসার পরে আমরা তিনজনেই যেন ক্লাসে একটু অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়লাম। ভারী সুন্দর সেজে আসত মেয়েটি। ঠিক যেন গল্পে পড়া নায়িকা।
পুজোর ছুটির পরেই অবশ্য একটা ঘটনা ঘটল। আমাদের ক্লাসের একটি ছেলে, যার নাম ধরা যাক অতনু, সম্ভবত মেয়েটির ভালোবাসায় পড়ল। সম্ভবত বলছি এই কারণে যে, আশ্চর্য মেল-ইগোতে আমাদের কেউই প্রায় ভালোবাসা স্বীকার করতাম না। আর নিজের ক্লাসের কোনও মেয়ের বিষয়ে তো নয়ই। যা হোক, একদিন মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল অতনু। আমরা কান খাড়া করে শুনলাম ওই মেয়েটিকে নিয়ে ওর দুর্বলতার কথা। শুনে যা হওয়ার তাই-ই হল। ওই সুন্দরীর সঙ্গে অতনুর মতো ভোদাই প্রেম করবে, এ কথা তিনজনের কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না। শুধু তাই নয়, অতনুকে নিরীহ গোবেচারা লুঙ্গি পরা ন্যাকা বলে অবজ্ঞা তাচ্ছিল্যও করলাম। আমাদের ব্যবহারে অতনুর মন যে ভেঙে গেল তা বিলক্ষণ টের পেয়েছিলাম। যদিও অনেক সাহস দেখিয়ে অতনু কদিন খুব চেষ্টা চালিয়েছিল সেই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার। জমাতে যে পারেনি, বলাই বাহুল্য। তাতে আমরাও দেঁতো হাসি হেসেছি। ব্যর্থ হয়ে আবার ক্যান্টিনের আড্ডায় ফিরে এল সে। এইসময় হঠাৎ একদিন আমাদের তিনজনের মাথায় একটা প্ল্যান এল। বাংলা ভাষায় যাকে বলে প্রেম-ভাঙানোর ব্লু-প্রিন্ট। এখন ঠিক মনে নেই। কী একটা অছিলায় ক্লাসের অন্য একটি মেয়েকে দিয়ে ওই সুন্দরীকে সাদা কাগজে নাম সই করালাম। একে ঠিক সই বলা চলে না। সাদা কাগজের নীচে মেয়েটি নিজের নাম পুরোটাই লিখল। বাকি খেলা আমাদের তিনজনের। সেই সই করা, কাগজের ওপরের ফাঁকা সাদা অংশে অতনুর সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব লিখলাম জম্পেশ করে। খামে ভরে সে অলৌকিক প্রস্তাব অন্য একটি মেয়ের মারফত সোজা চলে গেল অতনুর কাছে। প্রেমের গন্ধ পেলে সে ডাকে বুদ্ধিমান মানুষও অন্ধ হয়ে যায়। সেই সন্ধ্যায় আমাদের হাতে লেখা প্রেমপত্র পড়ে আকুল প্রেমিকের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিংয়ের নীচে চাঁপাগাছের তলায় অস্থিরভাবে একলা দাঁড়িয়ে রইল অতনু। আর আমরা দূর থেকে মুচকি হেসে দেখতে লাগলাম ওর অস্থির পায়চারি। মেয়েটি যখন এল না, ম্লান মুখে মাথা নিচু করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল অতনু। ক্লাসে দিনকতক চুপচাপ ছিল অতনু। ক্রমশ সুন্দরী মেয়েটির চলন-বলন আমাদের কাছে হয়ে উঠল স্বাভাবিক। শুধু ক্লাসের কেউ মেয়েটির সঙ্গে প্রেম করছে কি না তা দেখা ছাড়া, খোঁজ নেওয়া ছাড়া, মেয়েটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতাম না।
দুদ্দাড় করে এসে গেল পরীক্ষা। তার ঠিক দিন কতক আগে লাইব্রেরির কোণায় বসে আমাদের তিনমূর্তিকে সেই চিঠি খুলে দেখাল অতনু। প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আমরাও দক্ষ অভিনেতা। যেন কিছুই বুঝিনি এমন ভাব করে নিজেদের তৈরি করা চিঠিকেই অপরিচিতের মতো দেখতে দেখতে ওকে সমবেদনা জানালাম। গড়িয়ে গেল দিন। পরীক্ষা হয়ে গেল। রেজাল্ট বেরনোর পর দিন থেকে বোমা ফেটে স্প্লিন্টারের মতো আমরা ছড়িয়ে পড়লাম যে যার পৃথিবীতে। তখন মোবাইল ছিল না। যে টেলিফোনের ঠিকানা এখন জাদুঘর, সেই ফোনে ডায়াল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নম্বর পাওয়া দুষ্কর। চিঠি লেখার অভ্যাস নেই। লিখে পোস্ট করাও বিরক্তিকর। চাকরি পাওয়ার চাপ চেপে বসেছে মাথায়। যে বন্ধুদের ছাড়া একটা সন্ধেও শ্মশান মনে হতো, তাদের খোঁজখবর নেওয়াও ভুলে গেলাম একদিন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। চাকরি জোটানোই হয়ে উঠল একমাত্র লক্ষ্য।
সবার ভাগ্য খারাপ থাকে না। শুরুতেই যা হোক একটা চাকরি জুটে গেল। অন্য দুই বন্ধুও ঢুকে পড়েছে গবেষণায়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তিনজন বড় হচ্ছি। এমন সময় একদিন হঠাৎ আমাদের একমূর্তির ফোন, ‘কী রে, শনিবার রাতে ফ্রি আছিস? আমি কলকাতায় এসেছি।’ যেন এক জীবনের কথা জমে ছিল। ন্যানো সেকেন্ডে পৌঁছে গেলাম সেই ক্লাসরুমে। হাইজেনবার্গস আনসারটেনিটি প্রিন্সিপাল, স্রোয়েডিংগার ইকুয়েকশন। আর অবশ্যই সেই হারিয়ে যাওয়া সুন্দরী। যে আমাদের কোনও চৌহদ্দিতেই এখন আর নেই।
...‘দেখা হচ্ছে তবে।’ রেখে দিলাম ফোন। এখন শুধু শনিবারের সন্ধের অপেক্ষা।
শনিবারের সকাল। তখনও ভালো করে ঘুম ভাঙেনি। বেজে উঠল টেলিফোন। অপর প্রান্তে আরেক মূর্তির গলা। ‘আসছিস তো। চটপট আসিস। সেই অতনুও আসবে।’ অতনুর নাম শুনতেই দু’জনে একসঙ্গে হেসে উঠলাম। ফোনও কেটে গেল, হুট করে।
যদিও এসব ক্যাফেট্যাফেতে আমি বড় একটা যাই না। কাচের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সেই দুই মূর্তি অলরেডি এসে গিয়েছে। নিষ্পলক তাকিয়ে আবেগে কেঁদে ফেললাম তিনজনেই। আগের চেয়ে অনেক স্মার্ট হয়েছে ওরা। কিন্তু আমাদের তিনজনেরই এক জায়গায় ভীষণ মিল। আমাদের এখনও কোনও প্রেমিকা বা বান্ধবী নেই। কফির অর্ডার দিলাম। বাইরে হালকা বৃষ্টি নেমেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাতা হাতে হাজির অতনু। আমরা তিনজন ওকে দেখেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম। নিমেষে আড্ডা জমে উঠল পুরনো দিনের কথায়। শুরুতেই মুখ কাঁচুমাচু করে অতনু বলল, ‘শোন, তোদের একটা কথা বলা হয়নি। আমি বিয়ে করেছি।’
আমরা ফিক করে হেসে উঠলাম। অতনু বলল, ‘যাক গে তোদের আজ আমি খাওয়াব।’
আমরা তিনজনেই সমস্বর, ‘তা কেন। আমরাই তোকে খাওয়াব। তুই বরঞ্চ একদিন তোর বাড়িতে আমাদের ডেকে তোর বউয়ের হাতের রান্না খাওয়াস।’
এক সেকেন্ড পজ নিয়ে অতনু বলল, ‘বউ এখানে আসছে একটু বাদেই। ওর সঙ্গে কথা বলেই না হয় দিন ঠিক করা যাবে।’
আড্ডার, হালকা কথাবার্তার ফাঁকে খুলে গিয়েছে ক্যাফের দরজা। আমরা তিনজনেই বিস্ফারিত চোখে তাকালাম সেইদিকে। দরজা ঠেলে আমাদের দিকেই পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে ফিজিক্স ক্লাসরুমের সেই সুন্দরী। পার্থক্য একটাই। কপালে একটা আগুনে লাল টিপ। মুচকি হেসে, এসে বসল অতনুর ঠিক পাশেই। বাকিটা পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। ‘হৃদয় খুঁড়ে কেই বা আর বেদনা জাগাতে চায়।’