সৎসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে মানসিক তৃপ্তি। কাজকর্মের ক্ষেত্রে নতুন কোনও যোগাযোগ থেকে উপকৃত ... বিশদ
রাত পোহালেই বড়দিন। উৎসুক জনতার ভিড়ে জমজমাট গড়ের মাঠ। ছোলা-বাদাম ভাজা খেতে খেতে জমে উঠেছে গল্প। আচমকাই তাল কাটল গোঁ গোঁ শব্দে। মাথায় উপর চক্কর কাটছে আস্ত একটা উড়োজাহাজ! সেই প্রথম বিমান দেখল তিলোত্তমা, ১৯১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর। দুই ফরাসি বিমানচালক— জুল টাইক এবং ব্যারন ডি ক্যাটরসের সৌজন্যে। গড়ের মাঠের উপরে খানিকক্ষণ চক্কর দিয়ে কলকাতাবাসীকে প্রথমবার বিমান দেখালেন তাঁরা।
আমেরিকায় রাইট ভাইদের আকাশে ওড়ার সঙ্গেই শুরু হয় ইতিহাসের এক অধ্যায়ের। সেটা ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর। তারপর থেকেই সারা বিশ্বের ধনী-অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ‘আকাশে ওড়া’ নিয়ে তৈরি হয়েছিল তুমুল আগ্রহ। এক দশকের মধ্যেই সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষে।
গড়ের মাঠের আগেও অবশ্য কলকাতার আকাশে বিমান উড়েছিল। ১৯১০ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার টলি ক্লাব গ্রাউন্ড থেকে উড়েছিল ভারতের প্রথম শখের বিমান। উপমহাদেশের প্রথম নারী বিমানযাত্রী হিসেবে তাতে চড়েন মিস নেলি সেন বা নির্মলা সেন। কেশবচন্দ্র সেনের পুত্রবধূ।
বাঙালি গড়ের মাঠে বিমান দেখলেও কলকাতা শহরে সে অর্থে কোনও এয়ারফিল্ড ছিল না। গড়ের মাঠই তখন অবতরণ ক্ষেত্র। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে রোম থেকে টোকিও উড়ে যাওয়ার সময় একঝাঁক ইতালিয়ান বিমান নেমে পড়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দক্ষিণের খোলা মাঠে। সেটি নিজেদের বিমানঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। ইতিহাস বলছে, এরপর কলকাতা থেকে প্রায় মাইল সাতেক দূরে দমদমার (অধুনা দমদম) ঘাসে ভরা মাঠকে বিমান অবতরণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ ভবিষ্যতে বিমানবন্দরের যে প্রয়োজন পড়বেই, তা বিলক্ষণ বুঝেছিল ব্রিটিশরা।
প্রথমে ‘কলকাতা এরোড্রোম’ হিসেবে এই বিমানবন্দরের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯২২ সালে লন্ডনের ক্রয়ডন শহর থেকে উড়ে এসে দমদমে নামেন মেজর ব্ল্যাক, ক্যাপ্টেন ম্যাকমিলান এবং ক্যাপ্টেন ম্যালিনস। পরে নিজেদের বিমানটি নিলামে বিক্রি করে দেশে ফিরে যান। তারও দু’বছর পর, ১৯২৪ সালের মে মাসে দমদমে নামেন ফরাসি পাইলট ডি’ওয়েসি। সেই মাসেই কলকাতায় আসেন আরও দু’জন পর্তুগিজ পাইলট—ক্যাপ্টেন পিস ও ক্যাপ্টেন বেইয়ের্স। মাসখানেকের মধ্যেই পৃথিবী ঘুরতে বেরনো দু’জন মার্কিন বিমানচালকের সি-প্লেন নামে গঙ্গায়, বারাকপুরের কাছে নবাবগঞ্জে। আরও একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল সেই বছরই। দু’জন ডাচ পাইলট আমস্টারডাম থেকে ব্যাটাভিয়া যাওয়ার পথে রাতের অন্ধকারে দমদমে বিমান অবতরণ করান। সম্বল ছিল স্রেফ মশালের আলো। পরের বছর বড়দিনে ইংরেজদের ছ’টি রাজকীয় সামরিক বিমান অল্প সময়ের জন্য দমদমে নামে।
ধীরে ধীরে বিমানবন্দরের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে। স্পেন, মাদ্রিদ, প্যারিস সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকে বিভিন্ন সময় দমদমে বিমান অবতরণ করতে শুরু করে। এরকম সময়ের ঘটনা—জার্মান পাইলট ওটো কোয়েনকে টোকিও যাওয়ার পথে কলকাতা পৌঁছন। কিন্তু বিমানক্ষেত্রটি ঠিকমতো বুঝতে না পেরে দমদমের পাশ দিয়ে উড়ে যান। এবং শেষ পর্যন্ত সামলাতে না পেরে হাওড়ার সাঁকরাইলে বিমান সহ পড়ে যান। তিনি প্রাণে রক্ষা পেলেও ধ্বংস হয়ে যায় প্লেনটি।
এতক্ষণ যে বৈমানিকদের কথা হচ্ছিল, তাঁরা কেউই কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ-ব্যবস্থা স্থাপন করেননি। তাঁরা নামতেন দমদমের ঘাসে ভরা মাঠে। আর তখন সেটিই ছিল এরোড্রোম। তখনও পর্যন্ত স্থায়ী কোনও বিমানঘাঁটি তৈরি হয়নি। দমদমে প্রথম কবে বিমানবন্দর তৈরি হল, তার সঠিক সন-তারিখ কেউই সেভাবে বলতে পারেন না। গবেষকদের ধারণা, ১৯২৮-২৯ সাল নাগাদ তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। উত্তর-দক্ষিণে রানওয়ে তৈরির পর্ব অবশ্য সেই বছরের শেষ বা পরের বছরের গোড়ার দিকে।
এক বছর পরে ঘটে একাধিক ঘটনা। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ ইম্পিরিয়াল এয়ারওয়েজ ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে করাচি পর্যন্ত নিয়মিত বিমান সার্ভিস শুরু করে। সেই বছরই ইম্পিরিয়াল এয়ারওয়েজ করাচি থেকে দিল্লি পর্যন্ত আঞ্চলিক বিমান পরিবহণের সূচনা। একই বছরে এয়ার ফ্রান্স অর্থাৎ ফ্রান্স থেকে ইন্দো-চায়না সাপ্তাহিক বিমান সার্ভিস আরম্ভ হয়। নিয়মিত পরিবেষা চালু হওয়ার সঙ্গেই আকাশে ওড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমবার একজন সর্বময় অধিকর্তা নিযুক্ত হন বেসামরিক বিমানে। তার সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষণপ্রাপ্ত এরোড্রোম অফিসারও। করাচিতে ডি চক্রবর্তী এবং কলকাতায় কে এম রাহা।
বেঙ্গল এয়ার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ১৯২৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে একটি সার্ভিস চালু করে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত। যদিও সেই সার্ভিস মাত্র এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। তারপর বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মতো ইন্ডিয়ান এয়ারওয়েজ, অম্বিকা এয়ারওয়েজ, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ এয়ারলাইন্স, ভারত এয়ারওয়েজ, ডেকান এয়ারওয়েজ, হিমালয়ান এয়ারওয়েজ, এয়ার সার্ভিসেস অব ইন্ডিয়া, কলিঙ্গ এয়ারলাইন্সের মতো আরও অনেকগুলি বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থা জন্ম নেয়।
এতগুলি সংস্থা বাজারে চলে আসায় চিন্তা বাড়ল ভারত সরকারের। ১৯৪৭ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারত সরকারের অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী সর্দার আবদার রব নিস্তার বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি তৈরি করেন। সেই কমিটিতে পশ্চিম ভারত থেকে প্রতিনিধি ছিলেন জে আর ডি টাটা ও পূর্ব ভারত থেকে বীরেন রায়। আর কংগ্রেসের তরফে চমনলাল। এই কমিটি রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর ১৯৫৩ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে একটি আইন পাশ হয়। এই আইনের বলে সমস্ত বেসরকারি সংস্থাগুলিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করে একটি মাত্র রাষ্ট্রীয় কর্পোরেশনে পরিণত করা হয়। যার নাম হয় ‘ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কর্পোরেশন’ বা সংক্ষেপে, ‘ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স।’
ইংল্যান্ডে বেসরকারি পাইলট প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১৯২৫ সালে। তিন বছরের মধ্যে, ১৯২৮ সালে দমদম বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় ‘বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাব’, যা ছিল এশিয়ার প্রথম বৈমানিক শিক্ষণ-সংস্থা। এই বিমান চালনা শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়েছিল দমদমের মাঠে। এই ‘বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাবে’র প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন দমদম এরোড্রোমে ‘বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাবে’র উদ্বোধন করেন।
১৯২৯ সালে লন্ডন ও দিল্লির মধ্যে বিমানযোগে ডাক পরিবহণ চালু হয়। সে বছরই ভারতে এয়ারমেলের জন্য আলাদা খাম ও টিকিট চালু করে ভারতের ডাক ও তার বিভাগ।
ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজ মানে আজকের ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ১৯৩৩ সালের ১ জুলাই লন্ডন-কলকাতা রুটে বিমান পরিষেবা শুরু করে। রুটটি ছিল—করাচি, যোধপুর, দিল্লি, কানপুর, এলাহাবাদ, কলকাতা। সেই বছর ৯ ডিসেম্বর জুড়ল সিঙ্গাপুর। তবে এই সমস্ত রুটগুলি ছিল মূলত ডাকবিভাগের জন্য।
১৯৩৭ সাল। কলকাতায় অবতরণ করেন অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট। প্রথম মহিলা হিসেবে যিনি বিমানে চড়ে বিশ্ব পরিক্রমা করছিলেন। কলকাতায় তাঁর অবতরণের খবর ছাপা হয়েছিল সংবাদপত্রে। দমদম বিমানবন্দরে অবতরণের ১৬ দিন পর, অতলান্তিক মহাসাগরে তলিয়ে যায় তাঁর বিমান। যদিও এর নেপথ্যে কোনও দুর্ঘটনা ছিল না। অ্যামেলিয়ার বিমানে গুলি করেছিল জাপানিরা।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের শেষ বড় শহর ছিল কলকাতা। সেই কারণে পূর্বদিকে মিলিটারি সাপ্লাই লাইনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি কেন্দ্রের মধ্যে একটি ছিল শহরের বন্দর, অপরটি বিমানবন্দর। মূলত দমদমের রয়্যাল আর্টিলারি অস্ত্রাগারের পাশে বিমানবন্দরের অবস্থান হওয়ার কারণ ব্রিটিশদের কাছে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আর এই কারণেই উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার সঙ্গে সংযোগকারী বিমানগুলি অস্ত্রের কারণে এখানেই থামত।
তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ দৈনিকে কলকাতার আকাশে ‘জাপানি বম্বিং প্লেনে’র হানার খবর প্রকাশিত হয়। হামলায় সেদিন মারা যায় ২৫ জন। সেই বছরেই জাপানিরা দখল করে নেয় রেঙ্গুন ও আন্দামান। যে কারণে কলকাতার উপরে বিমান আক্রমণ ছিল ব্রিটিশদের কাছে অশনি সঙ্কেত। এই আক্রমণ শুধু তাদের নয়, পাশাপাশি ভারতবাসীর জন্যও চিন্তার কারণ ছিল। দুশ্চিন্তা ছিল মিত্রপক্ষের জন্যও। এর জন্য ব্রিটিশরা জারি করল এক বিশেষ ‘নিয়ম’। রাতে শহরের সমস্ত আলো নিভিয়ে ফেলা হবে। ‘ঠুলি’ দিয়ে মুড়ে ফেলা হবে স্ট্রিট লাইট। এমনকী বিমান হানা এড়াতে সন্ধ্যের পর থেকে পরদিন আলো ফোটার আগে পর্যন্ত মৃতদেহ সৎকারে
অগ্নি সংযোগেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইংরেজরা।
জাপানি হানার প্রেক্ষিতে দমদম বিমানবন্দরের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। পাল্টা জবাবের মূল কেন্দ্রও হয়ে ওঠে। আমেরিকার বিখ্যাত ১২ এয়ারফোর্সের ঘাঁটি হল খড়্গপুর। চালু হয় আরও ৩-৪টি নতুন এয়ারস্ট্রিপ। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার জয়পুর সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় আজও সেই সব পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপের দেখা মেলে। ১৯৪১ সালে আসানসোলের জিটি রোডের উপর নিঘায় একটি সামরিক বিমানবন্দর নির্মাণ করে ইংল্যান্ডের রয়্যাল এয়ারফোর্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই বিমানবন্দরটি ব্যবহার করা হয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও সেটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল।
নানা ঘটনার নিরিখে এই বিমানবন্দরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে
পারস্য পাড়ি দেন রবি ঠাকুর। ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ বিমানবন্দরে পৌঁছন কবি। সফরসঙ্গী পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, সেক্রেটারি অমিয় চক্রবর্তী, আর্ট সমালোচক কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত দিনশাহ জে ইরানি। কবির বয়স তখন তিয়াত্তর। অবশ্য শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, আরও বহু দিকপাল মানুষের পাদস্পর্শে ধন্য হয়েছিল এই বিমানবন্দর।
ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ কলকাতা সফরে আসছেন, তখন বাংলার রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা জানাতে দমদম বিমানবন্দরে হাজির হলেন রাজ্যপাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির বিমান দমদমে অবতরণ করল। বিমান থেকে নেমে রাজ্যপালের দিকে এগিয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতি। রাজ্যপাল করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে করমর্দনের পরিবর্তে নত হয়ে রাজ্যপালের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন রাষ্ট্রপতি। এমন দৃশ্য দেখে সবাই তো হতবাক। পরে জানা যায়, ডঃ হরেন মুখোপাধ্যায় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, তখন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন হরেনবাবুর প্রিয় ছাত্র। গুরুকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিয়েছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। এমন অবাক করা ঘটনার সাক্ষী থেকেছে কলকাতা বিমানবন্দর। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজির সেই আলোকচিত্রটি আজও ইতিহাসের এক অধ্যায়ের জ্বলন্ত দলিল।
১৯৫৫ সাল। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। দমদম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকোলাই আলেকজান্দ্রোভিচ বুলগানিন ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি নিকিতা ক্রুশ্চেভ। সন্ধ্যা নেমেছে। বিমানবন্দরে সেভাবে আলো নেই। অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো আলোও পর্যাপ্ত নয়। সেই কারণে প্রতি সেকেন্ডে ফ্ল্যাশগানগুলি জ্বলতে থাকে। আর তাতেই জনগণকে অভিবাদন জানান দুই নেতা। পরে এই দুই জনপ্রিয় নেতা প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অনুরোধে চিত্তরঞ্জন রেলইঞ্জিন কারখানা পরিদর্শনের জন্য নিঘা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এর ঠিক এক বছর পরের ঘটনা। ১৯৫৬ সালে শিল্পপতি রাজেন মুখোপাধ্যায়ের পুত্র বীরেন মুখোপাধ্যায় এক ইঞ্জিনযুক্ত একটি বিমান কেনার পর দমদম বিমানবন্দর হয়ে নিঘায় আসতেন। সেখান থেকে যেতেন বার্নপুর। পরে ১৯৫৮ সাল নাগাদ তিনি বার্নপুরের কালাঝরিয়াতে ইস্কোর নিজস্ব বিমানবন্দর নির্মাণ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দমদম বিমানবন্দরের গুরুত্ব অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। একইসঙ্গে বিমান ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি হয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই বিশ্বজুড়ে যাত্রীবাহী বিমান পরিবহণের জগতে জোয়ার আসে। তখন এই প্রাচীন দমদম বিমানবন্দর হয়ে ওঠে যাত্রীবাহী বিমান পরিবহণের গুরুত্বপূর্ণ একটি ‘গেটওয়ে’। যার জেরে ইউরোপ আর পূর্ব এশিয়ার বিমান চলাচলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে দমদম। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপ যেতে হলে কলকাতায় নামতে হতো। তেল, রসদ সহ সবকিছু মিলত এই কলকাতা বিমানবন্দরে। যে সময়ের কথা বলছি, কলকাতা তখন ছিল ভারতের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। সে সবই অবশ্য এখন ইতিহাস!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতার নিকটবর্তী নদীয়া জেলার ৪৬টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল এক আস্ত মার্কিন উপনিবেশ—‘রুজভেল্ট নগরী’। আর সেই মার্কিন ঘাঁটির নকশা সাজিয়েছিলেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। সেই ঘাঁটি ঘিরে গড়ে উঠেছিল একাধিক বেস ক্যাম্প, অস্থায়ী সেনা বিমানবন্দর, রানওয়ে। এই মার্কিন বিমানঘাঁটির যোগাযোগের হেডকোয়ার্টার ছিল কলকাতা বিমানবন্দর।
১৯৫৯ সালে হাভানা থেকে বিমানে ওঠেন কিউবার জনপ্রিয় নেতা চে গ্যেভারা। প্রথমে মাদ্রিদ, পরে কায়রো হয়ে ভারতে আসেন। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে দেখা করে আসেন কলকাতায়। বিমানবন্দরে নেমে যান বরানগরে, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে। দেখা করেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সঙ্গে। আবার মাদার টেরিজার জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতা বিমানবন্দরে পা রাখেন দালাই লামা।
১৯৮০ সালে ট্রামের সঙ্গে বিমানবন্দরকে সংযুক্ত করার একটি পরিকল্পনা হয়। প্রস্তাবিত রুটটি ছিল—মানিকতলা থেকে বিবেকানন্দ রোড, উল্টোডাঙা হয়ে কাজি নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ হয়ে বিমানবন্দর। ইতিহাস বলছে, ১৯৮৫ সালের মধ্যে এই কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানির আর্থিক ক্ষতির কারণে এই পরিকল্পনাটি শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়।
নয়ের দশকে কলকাতা বিমানবন্দরকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা হয়। ১৯৯৫ সালে একটি নতুন অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল খোলা হয়। নেতাজির সম্মানে বিমানবন্দরটির নামকরণ করা হয়—‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’।
শুধু ঐতিহাসিক চরিত্রের পদার্পন বা ঘটনাই নয়, বেশ কিছু ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে এই বিমানবন্দর। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঘন কুয়াশার কারণে কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণের বদলে বিমান ভুল করে নামে মানিকতলার মাঠে। সেই ঘটনায় একজন বাদে সমস্ত যাত্রীর মৃত্যু হয়। আবার ১৯৫৩ সালে কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে সিঙ্গাপুর-লন্ডন একটি ফ্লাইট ভেঙে পড়ে দমদমের কাছে। মৃত্যু হয় ৪৩ জন যাত্রীর। এটিই সম্ভবত এখানে ঘটা সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা। ১৯৬৮ সালে ব্যাংকক থেকে আসা একটি বিমান ধাক্কা মারে গাছে। ভেঙে পড়ে বিমান। এর দু’বছর পর পূর্ব পাকিস্তানে সাইক্লোনের জন্য রিলিফ দিয়ে ফিরছিল একটি রাশিয়ার বিমান। বিমানে হঠাৎ আগুন ধরে যায়। দমদমে অবতরণের চেষ্টা বিফল হয় এমনকী পানাগড়েও নামতে পারেনি বিমানটি। সেই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ১৭ জন যাত্রীর।
চলতি বছরের অক্টোবর মাসে কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিমান ‘বেলুগা এক্সএল’। পূর্ব ভারতে এত বড় বিমান নামার জন্য একমাত্র যোগ্য বিমানবন্দর ছিল কলকাতা। বিমানের মাথার ফোলা আকৃতির জন্য এর নাম রাখা হয় ‘বেলুগা তিমি’র নামে। বিভিন্ন সময়ে ঘন কুয়াশা, ক্রমাগত বৃষ্টিপাত, সাইক্লোনের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বোমাতঙ্ক, হাইজ্যাকের হুমকি দিয়ে উড়ো ফোন, পাখির আক্রমণ সহ একাধিক সমস্যার মোকাবিলা করেই পরিষেবা দিয়ে চলেছে শতাব্দীপ্রাচীন এই বিমানবন্দরটি। শুধু তাই নয়, প্লেগ থেকে করোনা মহামারী, সবকিছুই সামলে উঠেছে এই বিমানবন্দর।
বিমান আকাশে ওড়ার সময় বিমানের নকশা প্রস্তুতকারী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির একটা কথা বড্ড মনে হয়, ‘আকাশের কোনও সীমা নেই। সেই সীমাহীন আকাশে যদি আপনি একবার ওড়ার স্বাদ পেয়ে যান, চিরকালের জন্য আপনার চোখ আটকে থাকবে আকাশে। সেদিকে চোখ রেখেই পৃথিবীতে হাঁটবেন। কারণ আপনি সেখানে ছিলেন এবং সেখানে আপনি সর্বদা ফিরে যেতে চান।’
তথ্য সৌজন্য: রাহুল চক্রবর্তী
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস