সৎসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে মানসিক তৃপ্তি। কাজকর্মের ক্ষেত্রে নতুন কোনও যোগাযোগ থেকে উপকৃত ... বিশদ
পুলিস নেই, হাতকড়া নেই, গারদ নেই... স্রেফ ইন্টারনেট যুক্ত কম্পিউটার বা ট্যাবলেট নিদেনপক্ষে একটা স্মার্টফোন থাকলেই ব্যস— ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট থুড়ি ডিজিটাল অ্যারেস্ট! পুলিসের খাতায় গত ১১ মাসে শিকার ৯২,৩২৩ জন। রাতারাতি উবে গিয়েছে ২১৪০ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকা।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চিকিৎসক। আর্থিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। হঠাৎ একদিন তাঁদের কাছে একটি ফোন আসে ‘ট্রাই’(TRAI)-এর নাম করে। বলা হয় ‘আপনার নম্বরটি একাধিক ক্রাইমে ব্যবহার করা হয়েছে। আপনাকে আমরা মুম্বই পুলিশের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’ এরপরেই দেখা যায় মুম্বই পুলিশের উর্দিধারী কিছু লোক তাঁকে ভিডিয়ো কল করে। নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে ওই দম্পতির কাছ থেকে ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা।
এক মুহূর্তের জন্যও ক্যামেরার সামনে থেকে সরা যাবে না। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের ক্যামেরা চালু রাখতে হবে সর্বক্ষণ। নির্দেশমতো অ্যাপ ‘ডাউনলোড’ করে দূর থেকে সেই ক্যামেরায় নজরদারি করতে দিতে হবে। বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকলে জানাতে হবে সেই ক্যামেরার আইডি এবং পাসওয়ার্ড। নিস্তার নেই শৌচাগারেও। সেখানেও চালু করে যেতে হবে ফোনের ক্যামেরা!
টানা দু’দিন। এ ভাবেই এক আইনজীবীকে নিজের বাড়িতে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ (ভয় দেখিয়ে ক্যামেরাবন্দি করা) করে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ। কর্মক্ষেত্রে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাড়িতে বাইরের লোকের আসা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজ বা দুধ এলেও দরজা না খোলার নির্দেশ ছিল। পরিস্থিতি এমন হয় যে, নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিতে হয় তরুণীকে। ভুয়ো গ্রেফতারির অঙ্গ হিসেবেই তাঁকে এর পরে পোশাক খুলিয়ে ভুয়ো ‘নার্কো পরীক্ষা’ও করানো হয় বলে অভিযোগ!
ছটপুজোর দিন বাড়িতে রান্না করছিলেন রুবি মোড়ের কাছে একটি আবাসনের বাসিন্দা অনিতা বাগচি। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে তিনি ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। স্বামী ছিলেন ওএনজিসি–র উচ্চপদস্থ অফিসার। ২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যান। তারপর থেকে ব্যাঙ্কে জমানো টাকা ভাঙিয়েই সংসার চলত অনিতার। তাঁর ছেলে খড়্গপুর আইআইটি’র প্রাক্তনী। বর্তমানে তিনি লন্ডনে চাকরি করেন।
অনিতা জানান, ছট পুজোর দিন সকাল ১০টা নাগাদ এক মহিলা হঠাৎ ভিডিয়ো কল করে হিন্দিতে বলে, দিল্লির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সুরেশ কুটে নামে একজন ব্যক্তির সঙ্গে নাকি অনিতার জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তাতে লক্ষ লক্ষ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। তার জন্য তাঁকে ডিজিটাল অ্যারেস্ট করা হয়েছে। অন্তত ১৪ দিন জেল হেফাজতে থাকতে হবে। ছেলের চাকরিও চলে যাবে। এই ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে দফায় দফায় টাকা আদায় করা হয়।
অনিতার কথায়, ‘গ্রেপ্তারির কথা শুনে আমি প্রচণ্ড ঘাবড়ে যাই। ওরা আমাকে প্রস্তাব দেয়, গ্রেপ্তারি আটকাতে গেলে আমাকে কিছু টাকা খরচ করতে হবে। ওরা আমাকে একটা ফর্ম পাঠায়। তাতে একটা অ্যাকাউন্ট নম্বর দেওয়া ছিল। ওদের কথা মতো গত ১১ নভেম্বর আমি প্রথম আরটিজিএসে ৩০ লক্ষ টাকা পাঠাই।’
তাঁর সংযোজন, ‘কয়েক দিন বাদে আবার ফোন করে আমার কাছ থেকে টাকা চাওয়া হয়। ওদের কথা শুনে গত ১৬ নভেম্বর সিনিয়র সিটিজে়ন স্কিম ভেঙে আমি ফের ১৫ লক্ষ টাকা পাঠাই। কয়েক দিন যেতে না যেতে সুমেধা নামে অন্য একজন নিজেকে আইপিএস পরিচয় দিয়ে ফোন করে আমার কাছ থেকে আবার টাকা চায়। গত ১৯ নভেম্বর আমি ১২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পাঠাই। ব্যাঙ্কে যা জমানো টাকা ছিল সবই দিয়ে দিয়েছি। এখন আমি প্রায় সর্বস্বান্ত।’
ডিজিটাল অ্যারেস্টের কথা শুনে প্রৌঢ়া এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের কিছু জানাননি। ছেলের কাছেও খবরটা গোপন রেখেছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, সর্বস্ব খুইয়ে তিনি থানার দ্বারস্থ হয়েছেন।
কোভিডকালে অফলাইনে ঘরবন্দি সাধারণ মানুষের অনলাইনে উঠে আসার কারণেই বাড়বাড়ন্ত শুরু সাইবার জালিয়াতদের। কিন্তু ডিজিটাল অ্যারেস্ট আসতে আসতে ২০২৩ হয়ে যায়। ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত সাইবার প্রতারণার অঙ্কটা চোখ কপালে তোলার মতো—১৯৮৮৮ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা। ২০২৩ সালে সেটা ছিল ৯২১ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা। তবে এই সংখ্যাটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। কারণ, লোকলজ্জার ভয়ে অভিযোগই দায়ের করতে যান না সিংহভাগ প্রতারিত।
কীভাবে সংগঠিত হয় অপরাধ?
প্রথমে, কোনও ব্যক্তিকে ‘কুরিয়ার সার্ভিস’, ‘এয়ারপোর্ট অথারিটি’ অথবা ‘ট্রাই’ এই ধরনের সংস্থার নাম করে ফোন করা হয়। এর পর হয়তো সেই ব্যক্তিকে বলা হয় আপনার নামে একটি পার্সেল ধরা পড়েছে ‘কাস্টমসে’ যার মধ্যে থেকে ড্রাগস বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কিংবা হয়তো কোনও ব্যক্তি কখনও ‘নীল ছবি’ দেখেছিলেন, তাঁকে ফোন করে বলা হল ট্রাই থেকে বলছি ‘আপনি চাইল্ড পর্ন বা শিশুদের নীল ছবি দেখেছেন, সুতরাং আপনাকে অ্যারেস্ট করা হবে।’ কাউকে ফোন করে বলা হচ্ছে ‘আপনার নামে একাধিক আধার কার্ড বা প্যান কার্ড পাওয়া গিয়েছে, যা বিভিন্ন রকম অপরাধ মূলক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।’
অভিযোগ আনার পরে দ্বিতীয় ধাপে, তাঁকে হয়তো বলা হল আপনাকে ভিডিয়ো কল করছি, বা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। এবার বাইরের দেশে কোথাও থানার মতো বা ইডি, সিবিআইয়ের নকল দফতর তৈরি করে ভিডিয়ো কল করা হয়। নিয়ে ‘এফআইআর’ করা হবে, ‘অ্যারেস্ট’ করা হবে বলে নানা ভাবে ‘টার্গেট’-এর মনে প্রতারকরা ভয় তৈরি করে।
তৃতীয় পর্যায়ে, এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়ার নাম করে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়। এমনকি প্রথমবার টাকা দেওয়ার পরে বলা হয় এই টাকা আপনি ফেরত পেয়ে যাবেন, এটা তদন্তের একটি অংশ বলে, সেই টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য আরও টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা।
অনেক সময় তাঁর পরিজনের নাম করে গুরুতর কোনও অভিযোগের কথা বলা হয়। এমনকি এর সপক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ আছে বলেও দাবি করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতারকদের কাছে অনেক সময় ‘টার্গেটে’-এর ব্যাক্তিগত কিছু তথ্য আগে থেকেই উপলব্ধ থাকে। এর পর ভয় পেয়ে ভিডিয়ো কল করলে, তাঁকে আরও বেশি করে ভয় দেখানো হয়। বাড়িতে ক্যামেরা থাকলে তাঁর ‘অ্যাকসেস’ চেয়ে নেওয়া হয়। প্রতারণার পরিকল্পনাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে, ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট মেমো’ও পাঠানো হয়। শেষে সেই মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার নামে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। এই ফাঁদে পা দিলেই সর্বনাশ।