সৎসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে মানসিক তৃপ্তি। কাজকর্মের ক্ষেত্রে নতুন কোনও যোগাযোগ থেকে উপকৃত ... বিশদ
দশমী তিথিটা পড়ে গেল কি না পাঁজিতে দেখে নিয়েই বাবা বলতেন, এবার কলাপাতায় ‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’ লেখো ১০৮ বার। তারপর সব বই একবার করে পড়বে। সকাল সকাল স্নান সেরে, নতুন জামা পরেই বসে যেতাম সেই নিয়ম পালনে। পাশের বাড়িতে আমার সমবয়সিরা আবার শ্লেটে ‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’ লিখত। কেউ কেউ তো খাতাতেও। মা-ঠাকুমারা মণ্ডপে দেবীকে বরণ করার সময় আমার বইগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতেন। মা দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতীর শ্রীচরণের পবিত্র ফুল-দূর্বায় ভরে উঠত পাতার ভাঁজ। পড়াশোনার পর্ব শেষ হলে শুরু হতো শুভ বিজয়ার চিঠি লেখা। হলুদ পোস্টকার্ড কিংবা নীল ইনল্যান্ড লেটারের উপরে একটু বড় করেই লিখতাম ‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’। আর একাদশীর দিন দেবী দুর্গার নাম লেখা কলাপাতাটি ভাসিয়ে দিয়ে আসা হতো পুকুরে বা নদীতে।
বিজয়া কথাটার সঙ্গে যাত্রা বা শুভযাত্রা কথাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল ছোটবেলায়। আর সেই শুভযাত্রার একটাই প্রতীক, পুঁটি মাছ। তখন ষষ্ঠী থেকে নবমীর জীবন ছিল সম্পূর্ণ নিরামিষ। একমাত্র দশমীতে আমিষ ভোজন। ইলিশ কিংবা অন্য যা-ই আসুক, পুঁটি মাছ ছিল বাধ্যতামূলক। ঠাকুমা বলতেন, ‘যাত্রা করে পুঁটি মাছ খেতে হয়। উমা পতিগৃহে যাত্রা করেছেন তো! তাঁর এই যাত্রা পথ শুভ হোক, মঙ্গলময় হোক আমাদের জীবনের চলার পথটিও।’
দশমীর সকালে মা দুর্গার ঘট বিসর্জনের পরেই আর একটি মঙ্গল ঘট স্থাপন করা হতো গেরস্তবাড়িতে। ঠাকুমার কাছে শুনেছি, এই রীতি বরিশালের। কৃষ্ণনগরে আমাদের পাড়ায় মুখার্জিকাকুদের উঠোনের একপাশে ছোট্ট মাটির বেদি ছিল। কাকিমারা সকালে স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে ঘট পাততেন। বেদির উপরে ফুটে উঠত ধানের ছড়া-ফুলের আলপনা, স্বস্তিক চিহ্ন। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পর সেই মঙ্গল ঘটের বিসর্জন।
একবার দশমীতে বাঁকুড়ায় গিয়েছিলাম। আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে বিজয়ার কোলাকুলির বদলে কাদা ছোড়াছুড়ি করে শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহের সময় থেকে চলে আসছে এই প্রথা। খেলাটা ভারী অদ্ভুত! মায়ের মন্দিরের সামনে মাটির বাঁধ দিয়ে এলাকার পুকুরের জল ভরা হয়। তারপর হাঁটু সমান জলে নেমে কাদা ছোড়ার সূচনা। শোনা যায়, মল্লরাজ নাকি যুদ্ধযাত্রার পথে বিশাল বটগাছের নীচে এক বালিকাকে কাদায় খেলা করতে দেখেছিলেন। বারেবারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল সে। তা দেখে রাজার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়, বালিকার বেশে তাঁকে দেখা দিয়েছেন মা দুর্গাই। তিনি ওই স্থানে দুর্গামন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি দশমীতে সেখানে সৈন্য-সামন্তদের সঙ্গে কাদা খেলায় মেতে উঠতেন রাজা। আজও সেই রীতি অমলিন।
এখন ২০২৪। গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। আমার সন্তানকে আজ পর্যন্ত কোনও দশমীতে ‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’ লেখাতে পারিনি। চিঠি লেখা তো উঠেই গিয়েছে! হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে আসা শুভেচ্ছার রেশ প্রাণে লাগে না। আমাদের মন-মানসিকতার মতো ভাষাগুলোও সংকীর্ণতর হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে বড় ভয় হয়! সভ্যতার শিখরে উঠেও সংকীর্ণতার যে গভীরে আমরা ডুব দিয়েছি, সেখান থেকে কি আর ফিরে আসা যাবে কোনওদিন?