বিদ্যায় অস্থির মানসিকতা থাকবে। কর্মপ্রার্থীদের কোনও শুভ যোগাযোগ হতে পারে। রাগ বা জেদের বশে কারও ... বিশদ
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী? উদ্ধত? নাকি অহঙ্কারী? ঠিক কোন বিশেষণটা এর জন্য ব্যবহার করা উচিত, বুঝে উঠতে পারছিলেন না ভারতীয় সেনা অফিসার ও গোয়েন্দারা। অনন্তনাগ থেকে ধরা পড়ার পর আট মাস হয়ে গিয়েছে, তখনও দাপটে এতটুকু ঘাটতি নেই! ঘুরেফিরে একটাই কথা, ‘তোমরা আমাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবে না। পাকিস্তান, আর আইএসআইয়ের কাছে আমার গুরুত্ব সম্পর্কে তোমাদের কোনও ধারণা নেই। আমার জনপ্রিয়তাকে অবজ্ঞা করছ তো? এর ফল তোমাদের ভুগতে হবে। আইএসআই যেভাবে হোক আমাকে পাকিস্তানে ফেরাবেই।’
মাসুদ আজহার...। ভারত বিলক্ষণ জানত, কাশ্মীর তথা ভারতে ধর্মের নামে অশান্তি ছড়ানোর পিছনে পাকিস্তানের জমিনে যদি পাঁচটা মাথা থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে অন্যতম এই মৌলানা। কাজেই ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ তারিখটা সত্যিই ছিল ভারতের কাছে জ্যাকপট পাওয়ার দিন। অনন্তনাগের খানাবাল চকের কাছে এসে দাঁড়াল অটোরিকশটা। জম্মু-কাশ্মীর পুলিসের রুটিন তল্লাশি। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! অবাক হয়েছিল মাসুদ আজহার। কাপরানের জঙ্গলে যেখানে সাজ্জাদ আফগানি লুকিয়ে ছিল, সেখান থেকেই ফিরছিল সে। সঙ্গে সাজ্জাদও ছিল। এদেশে মাসুদ আজহারের আসার মূল কারণ ছিল পাকিস্তান সেনা-আইএসআইয়ের দেওয়া একটা গুরুতর বরাত। হরকত-উল-জেহাদ-ই-ইসলামি (হুজি) এবং হরকত-উল-মুজাহিদিন মিলে তৈরি হয়েছে হরকত-উল-আনসার। লক্ষ্য? আরও শক্তিশালী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ভারতের উপর। কাশ্মীরকে ছিনিয়ে নেওয়া নয়াদিল্লির থেকে। কাশ্মীরের প্রত্যেক সন্ত্রাসবাদী কমান্ডারের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, কোনও ঝামেলা চাই না। কিন্তু ওদিক থেকে ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ জাতীয় কোনও উত্তর এসে পৌঁছয়নি। তাই নির্দেশ এসেছিল মাসুদ আজহারের কাছে... যেতে হবে কাশ্মীর। যদি কোনও বিভেদ থাকে, মেটাতে হবে। চাঙ্গা করতে হবে সংগঠনকে। কিন্তু মুশকিল একটাই, এই তার প্রথম কাশ্মীর যাত্রা... কী অবস্থা সেখানকার? সংগঠনের লোকজন অভয় দিল, আরে মৌলানা, চিন্তা করবেন না। কাশ্মীরে তো আজাদি এল বলে! ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী পিছতে শুরু করেছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় মাসুদ আজহার তো এমনও বলেছিল, ‘ওদের কথা শুনে আমি ভেবেছিলাম, কাশ্মীরে বুঝি আফগানিস্তানের মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছে। মুজাহিদিনরা সেখানে যেমন একটা অংশ দখল করে নিয়েছিল, এখানেও তেমন পরিস্থিতি। আফগানিস্তানের ওই ‘আজাদ অংশ’ থেকে পাকিস্তানে যেমন খুশি আসা যাওয়া যেত। ভাবলাম, এখানেও বোধহয়... আরে, আমি তো এলওসি দিয়েই পার হয়ে চলে আসতাম। পারলাম না আমার চেহারার জন্য। তাই তো আমাকে ঢাকা হয়ে নয়াদিল্লি আসতে হল। এখানেও ইমিগ্রেশনে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার দেখছি পর্তুগিজ পাসপোর্ট। কিন্তু দেখতে তো পর্তুগিজ নন! বলেছিলাম, আমার জন্ম গুজরাতে। কনভিন্স করার ক্ষমতা আমার আছে। আপনাদের ওই মহিলা অফিসারও আমার পাসপোর্টে ছাপ্পা মেরে দিয়েছিলেন।’ কাশ্মীর নিয়ে ভুয়ো খবর এবং এখানে ‘বিপ্লব’ সম্পর্কে আকাশকুসুম চিন্তাভাবনার ঠেলাতেই গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল মাসুদকে। পালানোর চেষ্টা সত্ত্বেও মাসুদ আজহার এবং সাজ্জাদ আফগানিকে তাড়া করে গ্রেপ্তার করেছিল সেনাবাহিনী। আফগানি বিশ্বাস করতে পারেনি, মাসুদ আজহার ওখানেই তার আসল পরিচয় ফাঁস করে দেবে... হরকত-উল-মুজাহিদিনের চিফ কমান্ডার! যে কারণে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মাসুদের সঙ্গে সাজ্জাদের সম্পর্কের তিক্ততা ছিল চূড়ান্ত মাত্রায়। গ্রেপ্তারির পর মাসুদ একটা কথা বলেছিল, ‘১২ দেশের ইসলামের যোদ্ধারা এসেছে কাশ্মীরকে স্বাধীন করতে। তোমাদের কার্বাইনের জবাব আমরা রকেট লঞ্চার দিয়ে দেব।’
দেশের সংখ্যাটা ১২ কি না নিশ্চিত নয়। তবে সোমালিয়া এবং ব্রিটেনে কাজ করার সময় নিজের নেটওয়ার্কটা মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে নিয়েছিল মাসুদ আজহার। দেওবন্দ ঘরানার নাক উঁচু মাদ্রাসায় পড়াশোনা, আর চরম মার্কিন বিদ্বেষ তাকে সন্ত্রাসের দুনিয়ায় হিরো বানিয়ে দিয়েছিল। খুব বেশি মার্কিন বিরোধিতা পাকিস্তান অবশ্য পছন্দ করত না। কারণ ওই আমেরিকা থেকেই বছরের শুরুতে টাকা আদায় করতে হয়... তবে দেশটা চলে। বন্ধু রাষ্ট্র বলে কথা! তাও মাসুদ আজহারকে অবজ্ঞা করতে পারেনি ইসলামাবাদ। এমনিতেই আইএসআইয়ের চিরকালীন একটা প্রবণতা আছে, অর্থ ও অস্ত্রের জোগান যেমন চলছে চলুক। কিন্তু কোনও একটি সংগঠনের মধ্যে যদি দেখা যায় একটা অংশ অনেক বেশি প্রভাবশালী আর খতরনাক হয়ে উঠছে, তাকে সরাসরি প্রশ্রয় দাও। মাসুদ আজহার ছিল পাকিস্তানের মস্ত বড় রিসোর্স। শুধু পাকিস্তান কেন, চীনেরও। সে ছিল লোক (পড়ুন জঙ্গি) জোগানের আসল ঠিকাদার। মগজের মধ্যে ঢুকে বেহুঁশ করে দেওয়ার ক্ষমতা তার। অস্ত্র প্রশিক্ষণ তার হয়নি। কারণ শারীরিকভাবে ফিট মাসুদ ছিল না। কিন্তু বুদ্ধি প্রখর এবং কলমের জোর অপরিসীম। হরকত-উল-মুজাহিদিনের আমির মৌলানা ফজল-উল-রহমান খলিল মাসুদকে বলেছিলেন, ৪০ দিনের এই প্রশিক্ষণ তোমাকে নিতে হবে না। তার বদলে তুমি আমাদের হয়ে একটা পত্রিকা বের করো। তাই করেছিল মাসুদ। ওই পুস্তিকার নাম ছিল সদা-ই-মুজাহিদ। ২ হাজার কপি ছাপা হতো। আর পুরোটাই বিলি হতো মূলত শুক্রবারের নমাজের সময়। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে।
মাসুদ একটা বিষয় খুব ভালো জানত, তাকে ছাড়াতে না পারলে পাকিস্তানের বিপদ। আর তাই ১১ ফেব্রুয়ারির পর থেকেই তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল সীমান্তের ওপারে। একের পর এক চেষ্টা। এবং ব্যর্থতা...। প্রথম চেষ্টা করে ওমর সইদ শেখ আর ইলিয়াস কাশ্মীরি। ’৯৪ সালেরই অক্টোবর মাসে দিল্লি থেকে তারা অপহরণ করে তিনজন ব্রিটিশ ও এক আমেরিকানকে। দাবি, মাসুদ আজহারকে ছাড়তে হবে। সঙ্গে সাজ্জাদ কাশ্মীরিকে। এই সেই ওমর সইদ শেখ, যে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যায় মূল অভিযুক্ত। যাই হোক, সেবার জঙ্গিরা সফল হয়নি। পরের বার অপহরণ করে পণবন্দি বানানো হয় দুই ব্রিটিশ, এক মার্কিনি ও এক জার্মান নাগরিককে। অপহরণের দায় নিয়েছিল আল ফারান জঙ্গিগোষ্ঠী। মাসুদের পাশাপাশি তারা অবশ্য হুজির চিফ কমান্ডার নাসারুল্লা মনজুরকে ছেড়ে দেওয়ারও দাবি তুলেছিল। যা মোটেই পছন্দ হয়নি মাসুদের। ‘আমার সঙ্গে এক সারিতে বসবে কি না নাসারুল্লা! এ হয় নাকি?’ আর একবার জঙ্গিরা জেলের মধ্যে সুড়ঙ্গ কেটে দিয়েছিল। চেষ্টা করেও বেরতে পারেনি মাসুদ। আটকে গিয়েছিল ভুঁড়িতে। যদিও একইভাবে পালাতে গিয়ে ১৯৯৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর পুলিসের গুলিতে প্রাণ দিতে হয় সাজ্জাদ আফগানিকে।
ডিসেম্বর, ১৯৯৯। ফ্লাইট আইসি ৮১৪... কাঠমাণ্ডু থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান অপহরণ করল জঙ্গিরা। পণবন্দি যাত্রীদের নিয়ে গেল এমন একটা দেশে, যেখানে অন্তত সরকারি কোনও সমস্যায় তাদের পড়তে হবে না... আফগানিস্তানের কান্দাহার। তালিবান শাসিত। হাইজ্যাকারদের শর্ত? তিন সন্ত্রাসবাদীকে ছাড়তে হবে। তাদের মধ্যে একজন মাসুদ। হাইজ্যাকারদের মধ্যে ছিল মাসুদ আজহারের ভাই ইব্রাহিম আতহারও। আর পরিকল্পনাটা ফেঁদেছিল মাসুদের আর এক ভাই আব্দুল রউফ আসগার। অটলবিহারী বাজপেয়ি সরকার জঙ্গিদের হাতে মাসুদ আজহারকে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কোট বালওয়াল জেল থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসেছিল সে। গন্তব্য, পাকিস্তান। আর ইসলামাবাদ তো আগেই বলে রেখেছিল, পাক জমিনে মাসুদের কোনও সমস্যা নেই। তাকে গ্রেপ্তারও করা হবে না। কারণ, ওই দেশে মাসুদের বিরুদ্ধে কোনও চার্জ নেই।
আর এই মুক্তির পর থেকে মাসুদই ছিল পাকিস্তান তথা আইএসআইয়ের রেসের ঘোড়া। অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলির এতে গোঁসা হলেও মাসুদ বা আইএসআইয়ের তাতে হেলদোল ছিল না। কান্দাহার হাইজ্যাকের প্রতিদান মাসুদ দিয়েছিল আইএসআইকে। ৫ লাখি বাহিনী উপহার দিয়ে। যারা বিনা বাক্যব্যয়ে ভারতের উপর হামলা করার জন্য প্রস্তুত। মাসুদের এক কথায় যারা প্রাণ দেবে। আর এই বাহিনী তৈরির জন্য মাসুদ দখল নিয়েছিল হরকত-উল-মুজাহিদিনের যাবতীয় পরিকাঠামোর। তাদের অফিস, লঞ্চপ্যাড, প্রশিক্ষণ শিবির...। আর তৈরি করেছিল নিজের সংগঠন, জয়েশ-ই-মহম্মদ। মাসুদ আজহার ডাক দিয়েছিল, জয়েশের ছাতার তলায় চলে আসুক সব জঙ্গি গোষ্ঠী। তা হয়নি। মাসুদের উত্থানের জন্য চাপা ক্ষোভ এবং তার প্রতি অবিশ্বাসের কারণে অন্য ‘নামজাদা’ জঙ্গি সংগঠনগুলি সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এই ‘অবজ্ঞা’র পাল্টা মৌলানা দেখিয়েছিল করাচি পৌঁছে। ১০ হাজার মানুষের অস্ত্র মিছিলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল শহর। মাসুদ আজহারের বক্তব্য ছিল, ‘ভারতকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত মুসলিমরা যেন এক মুহূর্ত বিশ্রাম না নেয়।’
মাসুদের এই শক্তির নেপথ্যে ছিল পাকিস্তানের অন্যতম বড় মাদ্রাসা জামিয়া উলুম ইসলামিয়া। বছরের পর বছর ধরে যেখান থেকে শত শত জেহাদির জন্ম হয়েছে। আট বছর বয়স হতে না হতেই যে মাদ্রাসাগুলিতে পৌঁছে দেওয়া হয় শিশুদের। তালিমের জন্য। শুরু হয় গোপনে বাছাই। প্রত্যেকদিন নতুন কোড দেওয়া হয় পড়ুয়াদের। সেই কোড না বলতে পারলে পরদিন নিরাপত্তারক্ষীরা ঢুকতে দেবে না মাদ্রাসা চত্বরে। সঙ্গে চলতে থাকে জেহাদি প্রশিক্ষণ। বাছাই করা ছেলেদের তারপর পাঠানো হয় অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য। তারপর? গন্তব্য কাশ্মীর। কার্গিল যুদ্ধের পর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে পাকিস্তানি জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘আপনাদের কি মনে হয়, লাহোরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে শুধু ক্রিকেট ম্যাচ হয়? ক্লাস এইটে ড্রপআউট হওয়ার পর স্টেডিয়ামে যেতাম, লস্করের অনুষ্ঠানে। শুনতাম... মনে হতো, এরাই তো হিরো! শত্রুদের নিকেশ করতে পারলেই জন্নত নসিব হবে...। আজ বুঝতে পারছি, কীভাবে ভুল বোঝানো হয় আমাদের।’ বক্তা মহম্মদ ইরফান। বয়স ২৩। আত্মঘাতী জঙ্গি। যে প্রায় ১৬ বছর আগে কাশ্মীর উপত্যকায় ধৃত।
পাকিস্তানের টেকনিক এটাই। শিক্ষার থেকে বেশি বরাদ্দ ভারত-বিরোধী কার্যকলাপে। এক এক জন জঙ্গি তৈরিতে পাকিস্তানের খরচ হয় বেশ কয়েক লক্ষ টাকা। অশিক্ষার অন্ধকারে ঢেকে রেখে দেওয়া দেশটাকে। অ্যাম্বিশন, ভারতকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে হবে। আর এই কাজে আইএসআইয়ের প্রধান দুই সেনাপতি হাফিজ সইদ এবং অবশ্যই মাসুদ আজহার।
মানবিকতার এমন অপরাধীকে কেন আন্তর্জাতিক জঙ্গি তকমা দেওয়া হবে না? ভারতের সংসদে হামলা, ২৬/১১ নাশকতা, পাঠানকোট, উরি, পুলওয়ামা... মাসুদ আজহারের জয়েশ একের পর এক আঘাত হেনেছে ভারতের উপর। নয়াদিল্লি থেকে দফায় দফায় তথ্য-প্রমাণ পাঠানো হয়েছে ইসলামাবাদে। হাফিজ সইদ, মাসুদ আজহার নাশকতার ষড়যন্ত্রী, বারবার গলা ফাটানো সত্ত্বেও পাকিস্তান কান বন্ধ রেখেছে। আর মাসুদকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি ঘোষণার জন্য ভারতের পক্ষ থেকে যতবার রাষ্ট্রসঙ্ঘে দরবার করা হয়েছে, ততবারই চীন ভেটো দিয়ে তা আটকে দিয়েছে। এবং তাদের যুক্তি কী ছিল? এ নাকি ভীষণ স্পর্শকাতর বিষয়। অনেক ভেবেচিন্তে, পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আসল কারণটাও কি তাই? নেপথ্যে কিন্তু লুকিয়ে লগ্নির কারবার। শুধু পাকিস্তানে নয়। আফগানিস্তানেও। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা... দেশগুলিকে কার্যত ঋণের বোঝায় ডুবিয়ে দিয়েছে চীন। তৈরি করে চলেছে একের পর এক ইনস্টলেশন। যা সামনে থেকে দেখলে পরিকাঠামো উন্নয়ন বলে মনে হলেও অন্তর্নিহিত স্বার্থ জড়িয়ে বেজিংয়েরই। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়ে গদর বন্দর পর্যন্ত চীনের পরিকাঠামো এবং ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড। ভারত তো বটেই, যা গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। তার উপর যোগ হয়েছে ছাবাহার বন্দরের দখলদারি। কোটি কোটি মার্কিন ডলার শুধু পাকিস্তানেই বিনিয়োগ করে রেখেছে চীন। এর সুদূরপ্রসারী ফল যে চীনের সীমান্তের বাইরেও কমিউনিস্ট সরকারকে সমান তালে শক্তি জোগানো, সে ব্যাপারে কারও সন্দেহের অবকাশ নেই। যদি যুদ্ধ হয়, অন্য দেশ থেকেও তার পরিচালনা করতে পারবে বেজিং। আর ঠিক এই কারণেই পাক সেনাবাহিনী বা আইএসআইয়ের মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলির ব্যাপারেও চোখ বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল জি জিনপিংয়ের দেশ। বিশেষ করে মাসুদ আজহারের ক্ষেত্রে। এমনও শোনা যায়, মাসুদ আজহার এবং তার বাহিনীই রয়েছে চীনের এই বিপুল বিনিয়োগের রক্ষাকর্তার ভূমিকায়। পাকিস্তানের অন্দর-বাহিরের যে কোনও আঘাত থেকে চীনের বিনিয়োগ এবং পরিকাঠামোকে রক্ষা করছে মাসুদ। এমনকী আফগানিস্তানে তালিবানও জানিয়ে দিয়েছে, চীনের কর্মযজ্ঞের দিকে তারা ফিরেও তাকাবে না। অর্থাৎ হামলা চালিয়ে সেগুলি ধ্বংস করবে না। এর নেপথ্যেও মাসুদ। সে-ই সংযোগ রক্ষা করে চলেছে তালিবানের সঙ্গে। কাজেই যেভাবে হোক মাসুদকে বাঁচাতে হবে। তাহলে এবার কেন চীন ঢেঁকি গিলল?
এর বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমেই ভয়ানক আন্তর্জাতিক চাপ। ভারত তো ছিলই, পাশাপাশি যোগ হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। এমনকী মাসুদকে কালো তালিকায় পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে না দিলে পাবলিক ভোটিংয়ের হুমকিও ছিল। পরিস্থিতি সেদিকে ঘুরে গেলে চীনের রীতিমতো নাকে খত দেওয়ার দশা হতো। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে গত বছরের উহান সম্মেলন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের একান্তে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছিল। মাসুদ আজহার ইস্যুতে যে মোদি চেষ্টাচরিত্র করবেন, তা তিনি আগেই স্পষ্ট জানিয়ে গিয়েছিলেন। কাজেই আশা করা যায়, জিনপিংয়ের কাছে বিষয়টি তিনি জোর দিয়ে উত্থাপন করেছিলেন। এখানেও একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। আমেরিকা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি চীনকে ফাঁপরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কারণ, ভারতের বাজার অর্থনীতি। এই বাজার ছাড়তে কেউই রাজি নয়। এছাড়া ভারত এই মুহূর্তে যার সঙ্গে বেশি করে বন্ধুত্ব পাতাবে, সেই অক্ষটি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাই চীন কখনওই একঘরে হতে চাইবে না। এখানে আবার মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। দীর্ঘদিনের খবর, কিডনিজনিত সমস্যায় অসুস্থ মাসুদ পাকিস্তানের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এবং তার সুস্থ হয়ে পুরোদস্তুর জঙ্গি কার্যকলাপে ফেরার আপাতত কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদি তাই হয়, তাহলে এই লোকটি চীনের আর কোনও কাজে লাগবে না। এমন এক জঙ্গির জন্য নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারার কোনও কারণ থাকে কি?
এবার আর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন... রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই পদক্ষেপে ভারতের রাজনীতি তথা ভোটে কোনও প্রভাব কি পড়বে? সম্ভাবনা কিন্তু আছে। মাসুদ আজহার যে কোনও শিক্ষিত ভোটারের কাছে অবশ্যই একটা পরিচিত নাম। তা সেই কান্দাহার কাণ্ডের পর থেকেই। জঙ্গি নাশকতায় ভারত যতবার কেঁপেছে ততবার হাফিজ সইদ, দাউদ ইব্রাহিমদের সঙ্গে নাম এসেছে মাসুদের। ঠিক লোকসভা ভোটের মাঝে রাষ্ট্রসঙ্ঘের এমন একটা সিদ্ধান্ত অবশ্যই ভারতের কূটনৈতিক জয়। প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর যেই স্থাপন করে থাকুন না কেন, উদ্বোধন তো করল মোদি সরকার! ভোটার কিন্তু সেটাই দেখবে। হ্যাঁ, এটা বলা যেতেই পারে, গ্রামের ভোটার বা দিন আনি দিন খাই মানুষের কাছে মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি ঘোষণা করায় কিছুই আসে যায় না। বরং তাঁদের কাছে অনেক বেশি আতঙ্কের নোট বাতিল। দেশের অসংগঠিত সেক্টরটা যার জেরে কার্যত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আর জিএসটি। এটা ঠিক, মানুষ ধীরে ধীরে এসবের গোরো কাটিয়ে বেরতে শুরু করেছেন। ধরে নেওয়া যাক, এই ধরনের ভোটারের সংখ্যা ৭০ কোটি। তা হলেও তো আরও ২০ থেকে ২৫ কোটি ভোটার আছে, যাঁদের মধ্যে মাসুদ এবং সন্ত্রাস বিরোধিতায় মোদি সরকারের ভূমিকার প্রভাব পড়বে! সেই সুযোগটা কিন্তু বিজেপি ছাড়তে চাইছে না।
আর একটা মোক্ষম প্রশ্ন হল, এবার পাকিস্তান কী করবে? নিয়ম অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক জঙ্গি ঘোষণা হওয়ার পর সেই ব্যক্তির একটি নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবে। সেই জঙ্গি, সংগঠন এবং তার পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে। অস্ত্র বা সেই সংক্রান্ত মালমশলা দেওয়া নেওয়া বন্ধ হবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, সংশ্লিষ্ট দেশ তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। উল্লেখযোগ্য বিষয়, এর আগে হাফিজ সইদ, দাউদ ইব্রাহিম এবং জাকিউর রহমান লাকভিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করেছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘ। তারা এখনও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। পাকিস্তানের দ্বিচারিতার কূটনীতি আসলে জঙ্গিদের কাঁধে তুলে নেত্য করা ছাড়া আর কিছু অনুমোদন করে না। আর এই করতে গিয়ে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুলতে বসেছে, মানুষ কিন্তু বেশিদিন সন্ত্রাস এবং অশিক্ষার চাবুক পিঠ পেতে নেবে না। আজ না হয় কাল বিদ্রোহ হবে। আর তা হবে সাধারণের মধ্য থেকে। ঠিক যেভাবে আরব বসন্ত হয়েছিল। ঠিক যেভাবে সুদানে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ২২ বছর বয়সি যুবতী আল সালা। এবং তাঁর সঙ্গে এগিয়ে এসেছিল গোটা দেশ। আজ থেকে পাঁচ বছর, দশ বছর পর যদি ঠিক এমনই কিছু পাকিস্তানে হয়, তখন তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আইএসআই বা সেদেশের সেনাকর্তাদের থাকবে না। সন্ত্রাসের আঁতুড় থেকে নাশকতার জন্মদাতাদের উপড়ে ফেলে দেবে পাকিস্তানের মানুষ। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি হয়তো ঠিক সেদিন প্রতিষ্ঠা পাবে...।
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস