কর্ম, বিদ্যা ক্ষেত্রে উন্নতির যোগ। আয় ব্যয় ক্ষেত্রে সমতার অভাব। স্বাস্থ্য ভালো থাকলেও আঘাতযোগ থাকায় ... বিশদ
গত বছর জুলাই মাসের শেষ। বাইরে মরশুমি বৃষ্টি। প্রকৃতির ক্যানভাসে সবুজের ভিন্ন শেডের খেলা চলছে সর্বক্ষণ। এমতাবস্থায় মন কি বাড়িতে টেকে? খুব ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে একবার ঘাটশিলা গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সত্যি বলতে তেমন কিছু মনে নেই। তাই এবারে ঠিক করলাম, ঘাটশিলার পাহাড়-হ্রদ দেখেই নস্ট্যালজিয়া কাটাব। তারপর উপরি পাওনা হিসেবে বর্ষায় যদি দেখা যায় সেই গর্জন করে জল পড়ার দৃশ্য। অনেকদিনের ইচ্ছা বৃষ্টিতে পাহাড় দেখার। আগে থেকে বুকিংও নেই। তাই ঠিক করলাম প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডেই যাব একদিনের ট্যুরে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মভূমি ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার ঘাটশিলা। যথারীতি আগস্টের প্রথম শনিবারেই হাওড়া থেকে চেপে বসলাম বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে, ঘাটশিলায় সময় সকাল ৯.৩০ মিনিট। আবহাওয়া খুব ভালো, রোদ একেবারেই নেই, আকাশ মেঘলা। এই গরমেও বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে সকাল থেকেই। চারপাশের সুন্দর দৃশ্য আর অনুচ্চ পাহাড় দেখতে দেখতে ৯টা ৪০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম ঘাটশিলা। দু’-একটা ছবি তুলেই এগিয়ে চললাম হোটেলের দিকে। হোটেল আশ্রয়, স্টেশনের একদম কাছে আগে থেকে বুক করে নিয়েছিলাম। রাস্তার ধারেই ব্যালকনি-সমেত বেশ বড় এসি ঘর। হোটেলের পথে দেখলাম স্টেশন রোড দারুণ জমজমাট। ঘুগনি মুড়ি চপের দোকান থেকে শুরু করে মুদিখানার দোকান যেমন আছে, তেমনই আবার জুতোর দোকান থেকে মানুষের প্রাত্যহিক জিনিসের সম্ভারের পসরাও অনেকই রয়েছে। হোটেলের ব্যালকনি দিয়ে পাহাড়ের মাথায় কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে মনে হচ্ছিল আর বেরব না, এভাবেই কাটিয়ে দেব ব্যালকনিতে বসে সারাটা দিন। কিন্তু পথিকের মন কি আর ঘরে টেকে? চোখে ক্যামেরা লাগাতেই দেখি পাহাড়ের মাথায় বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু এদিকে তেমন বৃষ্টি নেই। কী অপূর্ব যে লাগছিল সেই দৃশ্য! ঘরে চেক ইন করে ব্যাগপত্র রেখে একটু ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে গেলাম তাই। ইডলি-বড়া দিয়ে পেটপুজো সেরে একটা অটো নিয়ে প্রথমেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাটি গৌরীকুঞ্জর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্থানীয় এক সংস্থার পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাড়িটি। তাদের সঙ্গে একটু কথা বলে ছবি তুলে বেরিয়ে পড়লাম। এরপর পাথুরে শহরের মাঝে উঁচু-নিচু ঢালু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম সুবর্ণরেখা নদীর ধারে। পাড়ের নাম রাত মোহনা। দেখি, আট থেকে আশি সবাই নিজেদের হাতের ভেল্কিতে জাল ঘুরিয়ে নদীতে মাছ ধরছেন। পাশে একটা জলধারা কিছুটা উঁচু থেকে লাফ দিয়ে একটা ছোট জলপ্রপাতের রূপ নিয়েছে। এরপরের গন্তব্য একটু দূর। অটো এবার স্টেট হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলল গালুডি ড্যামের দিকে। পথে কাজলমাখা বিক্ষিপ্ত মেঘ আর দারুণ সুন্দর ঠান্ডা বা তাস মনের সব ঘর্মাক্ত বিষাদে মলম লাগিয়ে চলেছে। সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে এই জায়গাটি। একদিকে পাহাড়শ্রেণি আর উপর থেকে বিশাল গর্জন করে জল বেরচ্ছে ড্যামের খোলা দরজা দিয়ে। ইচ্ছেপূরণ হল। সে এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি! খুব ভয়ে ভয়ে ফোনটা একটু বাইরের দিকে বের করে ছবি তুললাম দুটো। উফ যদি একটা বার হাত ফস্কে যায়, ফোনটা যে কোথায় তলিয়ে যাবে কেউ জানে না! অনেকেই সেই জলে দিব্য মাছ ধরছে ড্যামের উপর রাস্তা থেকেই। কেনাবেচাও হচ্ছে। পাশে একটা ওয়াচ টাওয়ার ছিল, কিন্তু সেটা বন্ধ। তাই রাস্তা থেকেই গালুডির শোভা দেখে মন ভরাতে হল। দলমা পাহাড়ে স্থিত শাল-মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা ফুলডুংরি পাহাড় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের সৃষ্টিস্থল। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে ওপরে উঠতে হয়। এরপর গ্রামের ভিতর দিয়ে আধঘণ্টা অটো ছুটে চলল এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে। দুপুর আড়াইটে নাগাদ এসে দাঁড়ালাম বুরুডি লেকে। খিদে তো পেয়েছিলই, রাস্তার ধারের ছোট দোকানগুলোতে দেশি মুরগির ঝোল হচ্ছে দেখে খিদেটা যেন আরও বেড়ে গেল। খাওয়াদাওয়া পর্ব মিটিয়ে নিয়ে লেকের পাড়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। সেদিনের মতো বেড়ানোর পর্ব শেষ করে হোটেলে ফিরে এলাম সন্ধে নাগাদ। একটু ফ্রেশ হয়ে বেরলাম স্টেশন চত্বরটা একবার ঘুরতে আর চা খেতে। চপ ও চা সহযোগে সান্ধ্যকালীন ভোজটা মন্দ হল না। ফেরার পথে একটু ঘুগনিও চেখে দেখলাম। পরদিন সকালে আশপাশ একটু ঘুরে ট্রেন ধরব বাড়ির পথে। ফেরার টিকিট পাইনি, তাই স্টিল এক্সপ্রেসে জেনারেল টিকিট কেটে চলে এলাম হাওড়া। একদিনের বর্ষামুখর দিনের ঘাটশিলা ঘুরে মনটা আবার যেন সতেজ হয়ে উঠল।