উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য, ব্যবসায় গোলোযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যের অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত গল্প ‘মহেশ’। ‘মহেশ’-এর বাণী দিয়ে সাজানো শরৎচন্দ্রের বাড়ির প্রাচীর। বাহারি গাছ-গাছালি ভরা এই শরৎবাড়ি হাওড়া সামতাবেড়ের গর্ব। এই বাড়িতে বসেই শরৎচন্দ্র বার্ধক্যের বারাণসীতে লেখেন ‘মহেশ’।
১৯১৬ সাল রেঙ্গুন থেকে স্ত্রী হিরণ্ময়ী বা মোক্ষদাকে নিয়ে পাকাপাকিভাবে শরৎচন্দ্র চলে আসেন বাংলায়। ৬নং বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেন, ওখান থেকে বছরখানেক একটা ভাড়া বাড়ি, তারপর আবার বাজে শিবপুর। এই করে কাটে সাত বছর।
১৯২৩ সাল শরৎচন্দ্র আসেন দিদি অনিলা দেবীর বাড়ি। বাগনান গোবিন্দপুরে। প্রেমে পড়েন শরৎচন্দ্র। পছন্দ হয় সামতা পানিত্রাসের ‘হাঁসুলিবাঁক’। সাধারণ মানুষ জায়গাটাকে বলত ‘মড়াপোতা’ বা ‘চাকাচোরা’। তখন প্লেগ, বসন্ত, ওলাউঠায় গ্রামকে গ্রাম নিমেষে সাবাড়। ওদের ঠাঁই জোটে ওই সামতা-পানিত্রাসের রূপনারায়ণের জলে। তাই জায়গাটার নিসর্গ শোভায় একটা গা-ছমছম ভাব।
১৯২৬ সাল। প্রায় ২৭ বিঘে ধানি জমি নিয়ে সামতা কেনেন শরৎচন্দ্র। পানিত্রাস-গোবিন্দপুর আর সামতার নিজের চৌহদ্দিটুকু বেড়া দেন রাঙচিতা আর ভেরেন্ডা গাছ দিয়ে। বেড় বা বেড়া থেকে সামতাবেড়। ৫০ বছর বয়সে স্ত্রী হিরণ্ময়ী, ১টি পাঁঠা, স্বামীজি, ছোট মিঞা ও বড় মিঞা নামে আরও ২টি ছাগল, অতিথি ভুলো ও বাঘা নামে ২টি প্রভুভক্ত কুকুর নিয়ে শরৎচন্দ্র আসেন তাঁর নিজের বাড়িতে। বাড়ি সাজানো হয় ১টি বারোমেসে আম, ২টি বাতাবিলেবু, ১টি পেয়ারা, ৩টি হাজারি নারকেল, ১২টি শৌখিন বাঁশ আর কয়েকরকম ফুলগাছ দিয়ে। শরৎচন্দ্রের এই বাড়ি বার্ধক্যের বারাণসী। যেখানে শরৎচন্দ্র কাটান জীবনের শেষ ১৩ বছর।
শরৎচন্দ্রের মাটির বাড়িটি দোতলা। প্যানটাইল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। বাড়ির চারপাশে ঢাকা বারান্দা। বাড়িটি মাটির হলেও একতলা, এমনকী দোতলার মেঝে এবং বারান্দা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। বাড়িটি দেখলেই মনে হবে অনেকটা বার্মিজ প্যাটার্নের। মজবুত ও শক্ত। দেওয়াল খুব চওড়া। উলুটি করা মসৃণ। ১৯২৬-১৯৩৮ শরৎচন্দ্র থাকেন সামতাবেড় বাসভবনে। এখানে বসে লেখেন নানা উপন্যাস। শুভদা, শ্রীকান্ত ৪র্থ পর্ব, কেশ, বিপ্রদাস। লেখেন নানা কালজয়ী গল্প— অনুরাধা, সতী, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ ইত্যাদি। লেখেন নানান ছোট প্রবন্ধ— বেতার সঙ্গীত ও শরৎচন্দ্রের উভয়সংকট উল্লেখযোগ্য।
সুন্দর ছিমছাম শরৎবাড়ি সত্তরের দশকে অবহেলায় ভোগে। কিছুটা কৌলীন্য হারায় ১৯৭৮-র ভয়াবহ বন্যায়। দাবি ওঠে বাড়ি সংরক্ষণের। নড়ে বসে প্রশাসন। সংরক্ষিত হয় শরৎচন্দ্রের বই ও পাণ্ডুলিপি। ২০০৭-এ রচিত হয় স্বপ্নপূরণের নতুন ইতিহাস। ‘হেরিটেজ’ ঘোষিত হয় শরৎচন্দ্রের সামতাবেড় বাসভবন। ‘হেরিটেজ’ শরৎ বাসভবন দর্শকদের জন্য খোলা থাকে প্রতিদিন। সকাল ৬-১১টা। বিকাল ৩-৫টা। দেখা যায় শরৎচন্দ্রের লেখার ঘর, ব্যবহৃত বই, আলমারি। দেখা যায় তখনকার চেয়ার-টেবল, প্রাচীন ঘড়ি, জুতো, গড়গড়া। দেখা যায় নানা তৈলচিত্র। সযত্নে রাখা গৃহদেবতা। কোনও গাইড নেই। আছে বাড়ির কেয়ারটেকার। কেয়ারটেকার গড়গড় করে বলে দেয় শরৎচন্দ্রের জানা-অজানা নানা কথা। বাড়ির কাছেই রূপসী রূপনারায়ণ। নদীর চরে পিকনিকের মনোরম ডেস্টিনেশন। কাছেই পানিত্রাস। এখানে আছে শরৎচন্দ্রের নামে উচ্চবিদ্যালয় ও গ্রন্থাগার। প্রতি বছর এই দুই প্রাঙ্গণে বসে ‘শরৎমেলা’। ২১-২৭ জানুয়ারি। এবারে মেলা ৪৬তম। এ এক হাওড়ার প্রাচীন গ্রাম্য মিলন উৎসব। শরৎচন্দ্রকে জানা ও নতুনভাবে খোঁজা।