সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মক্ষেত্রে বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার ... বিশদ
গানের পাশাপাশি নাচও ছিল বেশ চটুল। সেগুলিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তখনকার রূপোপজীবিনীদের মধ্যে এই নাচ শিখে ‘বাবু’ মজানোর ধুম লেগে গিয়েছিল। পানিহাটির মোহন মুখোপাধ্যায়ের তখন খুব কদর। তিনি কলকাতার বারবনিতাদের পল্লিতে ঘুরে ঘুরে নাচ শেখাতেন। উৎকট শরীরী প্রকাশের সেই নাচের আমদানি করেছিলেন গোপাল উড়েই।
বউবাজারের রাধামোহনের শখের দলকে গোপাল পেশাদারী দলে রূপ দেন। তখন তাঁকে নানাদিক দেখতে হতো। তাই তিনি নিজে মালিনী অভিনয় থেকে সরে এলেন। তাঁর দলেই একটি ছেলে সখির নাচ করত। তার নাম কাশীনাথ। গোপালের নজরে পড়ল ছেলেটি। তাঁকে নতুন ঢংয়ে মালিনীর অভিনয় শেখাতে লাগলেন গোপাল। তাঁর অভিনয় মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। লোকে তাঁকে বলত ‘কেশে মালিনী’। গোপালের দলে তখন তখন বিদ্যা সাজতেন ভুলো বৈষ্ণব। তাঁর আসল নাম ভোলানাথ। সুন্দর সাজতেন উমেশ মিত্র। সেই আমোদে ডুবে গিয়েছিল বাংলার মানুষ। ছেলে, বুড়ো, মহিলা থেকে জমিদাররা পর্যন্ত। হুতোম প্যাঁচার নকশায় এ নিয়ে অসাধারণ একটি চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। ‘‘একবার শহরের শ্যামবাজার অঞ্চলের এক বনিদী বড় মানুষের বাড়িতে বিদ্যাসুন্দর যাত্রা হচ্ছিলো, বাড়ির মেজবাবু পাচো ইয়ার নিয়ে যাত্রা শুনতে বসেচেন; সাম্নে মালিনী ও বিদ্যে ‘‘মদন আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ কল্লে কি গুণ ঐ বিদেশী’’ গান করে মুটো মুটো প্যালা পাচ্চে—বছর ষোলো বয়সের দুটো (স্টড্ ব্রেড) ছোকরা সখী সেজে ঘুরে খেমটা নাচ্চে। মজ্লিসে রূপোর গ্লাসে ব্র্যান্ডি চলচে—বাড়ির টিক্টিকী ও সালগ্রাম ঠাকুর পর্য্যন্ত নেশায় চুরচুর ও ভো! ক্রমে মিলনের মন্ত্রণা, বিদ্যার গর্ভ, রাণীর তিরস্কার, চোর ধরা ও মালিনীর যন্ত্রণার পালা এসে পড়্লো; কোটাল মালিনীকে বেঁধে মাত্তে আরম্ভ কল্লে— মালিনী বাবুদের ‘দোহাই’ দিয়ে কেঁদে বাড়ী সরগরম করে তুল্লে— বাবুর চম্কা ভেঙ্গে গ্যালো; দেখ্লেন কোটাল মালিনীকে মাচ্চে, মালিনী বাবুর দোহাই দিচ্চে অথচ পার পাচ্চে না। এতে বাবু বড় রাগত হলেন ‘‘কোন বেটার সাধ্যি আমার কাছ থেকে মালিনীকে নিয়ে যায়’’ এই বলে সাম্নের রূপোর গেলাসটি কোটালের রগ ত্যেগে ছুড়ে মাল্লেন—গেলাসটী কোটালের রগে লাগ্বামাত্র কোটাল ‘‘বাপ’’! বলে অম্নি ঘুরে পড়্লো, চারি দিক্ থেকে লোকেরা হাঁ হাঁ করে এসে কোটালকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গ্যালো—মুকে জলের ছিটে মারা হলো ও অন্য অন্য নানা তদ্বির হলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না— কোটালের পো এক ঘাতেই পঞ্চত্ব পেলেন।’’
হুতোমের নকশায় তৎকালীন শহর কলকাতার বাবু-বিনোদনের চিত্র ফুটে উঠেছে। এই নিয়ে তখন তুমুল বিতর্ক। কেউ বলছেন বিদ্যাসুন্দর অসাধারণ এক বিনোদনমূলক পালা। আবার এক দল বলছেন এটি একটি অত্যন্ত স্থূলরুচির পালা। যেমনই হোক না কেন, সেই বিনোদনের রসগ্রহণ থেকে বাদ যাননি ইংরেজরাও। শহুরে এই বিনোদনের ঢেউয়ে গা ভাসিয়েছিলেন কোনও কোনও নাট্যমোদী ইংরেজও। তাঁদের বিনোদনের জন্য ইংরেজি গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল বিদ্যাসুন্দরের গানের অনুবাদ। ‘My Veedya’s beauty fills my head— I study nought beside; / My Veedya’s name I dwell upon from morn till even tide;...’
গোপাল উড়ের সঙ্গে শেষের দিকে তাঁর দলের লোকেদের বিশেষ বনিবনা হচ্ছিল না। কেউ কেউ মনে করেন টাকাপয়সা নিয়ে মতান্তর চলছিল। সেইরকম একটা দিনের ঘটনা ইতিহাসকে অনেকখানি বদলে দিল। সেদিন গোপালের বিদ্যাসুন্দর পালার আসর বসেছে চন্দননগরে গঙ্গাপ্রসাদ ঘোষের বাড়িতে। উপলক্ষ ছিল বাসন্তী পুজো। কুশীলবেরা মেক আপ করে প্রস্তত। আর একটু পরেই পালাগান শুরু হবে। কিন্তু গোপালের আর দেখা নেই। সেদিন সেখানে পৌঁছতে গোপালের বেশ কিছুক্ষণ দেরি হয়েছিল। তাই নিয়ে দলের লোকেরা তাঁর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিছুটা কথা কাটাকাটিও হয়েছিল। এতে গোপালের অভিমান হয়। সেই অভিমান এমন মাত্রায় পৌঁছয় যে, তিনি সেই অবস্থায় তাঁর দলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসেন।
বিদ্যাসুন্দর ছিল একটা যুগ। সেই বিদ্যাসুন্দর নিয়ে তখন কম বিতর্ক হয়নি। তার আঁচড় এসে লেগেছিল স্বয়ং বিদ্যাসাগরের গায়েও। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের সেটা ছিল চৈত্র সংক্রান্তির দিন। কাঁসারীপাড়া থেকে বেরিয়ে এল ‘সঙের দল’। তারা গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলল, ‘শহরে এক নতুন হুজুক উঠেছে রে ভাই,/ অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই, / এর বিদ্যাসাগর জন্মদাতা/ বঙ্গদর্শন এর নেতা।’
বিদ্যাসাগর মহাশয় বিদ্যাসুন্দরের কাব্যগুণের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের নবাগত ইংরেজ সিভিলিয়ানদের পাঠ্য হিসাবে পড়ানো হত বিদ্যাসুন্দর। এটি পড়াতেন বিদ্যাসাগর। তাই তাঁকে নানা ব্যঙ্গের পাত্র হতে হয়েছিল। নিন্দা কিংবা প্রশস্তি যাই হোক না কেন, একটা পরিবর্তিত সময়ের বুকে এক অন্য বিনোদনের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল বিদ্যাসুন্দর।