সৎসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে মানসিক তৃপ্তি। কাজকর্মের ক্ষেত্রে নতুন কোনও যোগাযোগ থেকে উপকৃত ... বিশদ
আমি জানি, এস জয়শঙ্করের অর্থনীতিতে আগ্রহ আছে। হোয়ার্টন বিজনেস স্কুলের স্নাতক হিসেবে অশ্বিনী বৈষ্ণব অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন। তাঁরা উভয়েই ভারতীয় অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সম্প্রতি এনডিটিভির তরফে অনুষ্ঠিত এক কনক্লেভে অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর আলোচনায় তাঁরা অংশ নিয়েছিলেন।
সংখ্যার আতঙ্ক
সেরা মনকে বিভ্রান্ত করার পক্ষে সংখ্যাই যথেষ্ট। প্রথমত, দেশের অর্থনীতির আকার নিয়ে গর্বিত এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, ‘আজ, আমাদের অর্থনীতি ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের। সেখানে আমাদের বাণিজ্যের বহর ৮০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের... এরপর যদি আপনি ভারতে বিদেশিদের বিনিয়োগের দিকে তাকান...।’ কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই আলাদা। আমরা এখনও ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি নই। আমাদের ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতির ‘গোলপোস্ট’ বা লক্ষ্যবস্তু ঠিক করা আছে। সেখানে পৌঁছনোর জন্য এই ৪ ট্রিলিয়ন সংখ্যাটি অতিক্রম করতে নেমে আমরা রীতিমতো হাঁপাচ্ছি। আরও মজার ব্যাপার এই যে, অর্থমন্ত্রী এবং প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গোলপোস্টটিকে গত ছ’বছরে তিন-তিনবার সরিয়েছেন! বাণিজ্য প্রসঙ্গে জানাতে চাই, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের শেষে আমাদের পণ্য রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৪৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ওই একই সময়ে ভারত আমদানি করেছিল ৬৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ গত অর্থবর্ষে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) কমে গিয়েছে! এফডিআইয়ের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ছিল ৮৪.৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ সালে তা কমে ৭০.৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।
‘আমাদের সুবিধা প্রদানের ক্ষমতা... খাদ্য এবং পুষ্টি সহায়তা’র প্রশংসা করেছেন এস জয়শঙ্কর। তিনি যদি বিনামূল্যে মাথাপিছু ৫ কেজি খাদ্যশস্য বণ্টনের কথা উল্লেখ করে থাকেন তবে আমি মনে করব যে সেটি ভয়াবহ দুর্দশা এবং শ্রমিকের কম মজুরির ইঙ্গিত, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। ‘কোভিডকালে ভ্যাকসিনের সবচেয়ে দক্ষ প্রস্তুতকারী এবং উদ্ভাবক’ হয়ে ওঠার জন্যও ভারতের প্রশংসা করেছেন তিনি। ভারতে আবিষ্কৃত একমাত্র ভ্যাকসিন হল কোভ্যাক্সিন। এটির এফেকটিভনেস বা কার্যকারিতা প্রায় ৮০ শতাংশ। তবে কোভিশিল্ড নামক অন্য ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কিন্তু প্রায় ৯০ শতাংশ। এটি অক্সফোর্ড-অস্ট্রাজেনেকা থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত। মহামারীর সময় দেশে যে ২০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে ১৬০ কোটি ছিল কোভিশিল্ড।
মজবুত স্তম্ভ নয়
অশ্বিনী বৈষ্ণব যখন ভারতের ‘৬ থেকে ৮ শতাংশের একটি সুস্থায়ী বৃদ্ধির হার অর্জন’ সম্পর্কে তাঁর মতামত দিচ্ছিলেন, তখন তাঁকে অধিক উৎসাহী দেখাচ্ছিল। তিনি ‘চারটি স্তম্ভ’ চিহ্নিত করেছেন—মূলধন বিনিয়োগ (ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট), উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং), অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধি (ইনক্লুসিভ গ্রোথ) এবং সরলীকরণ (সিমপ্লিফিকেশন)। যাই হোক, তথ্যের দিকে নজর করলে দেখতে পাব যে, ভারতের প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার গত ৬ বছরে গড়ে ৪.৯৯ শতাংশ। তবে তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কোভিড-যন্ত্রণার বছরগুলিও। কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির তরফে মূলধনী ব্যয়ের চিত্রটি কেমন? ২০১৯-২০ সালে ছিল জিডিপির ৪.৭ শতাংশ। ২০২৩-২৪ সালে, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় দফায় তা ৩.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। জিডিপির শতাংশ হিসেবে উৎপাদনেও ধাক্কা লেগেছে। ২০১৪ সালের ১৫.০৭ শতাংশ থেকে ২০১৯-এ তা নেমে এসেছিল ১৩.৪৬ শতাংশে। সেটা ১২.৮৪ শতাংশে নেমে এসেছে ২০২৩ সালে। ইনক্লুসিভ গ্রোথ একটি বিতর্কিত বিষয়। একটি ছোট নিবন্ধে তা প্রমাণিত কিংবা অপ্রমাণিত, কোনোটাই করা সম্ভব নয়। অতএব, এখানে এই প্রসঙ্গের মধ্যে আমি ঢুকছি না। আর সরলীকরণ? সেক্ষেত্রে এখন আরও বেশি নিয়ম ও বিধানের ঘটা! কথাটি বিশেষ করে আসে নিয়ন্ত্রণ আইন (রেগুলেটরি ল’) প্রসঙ্গে। তুলনায় একদশক আগে অবস্থাটি এমন ছিল না। যেকোনও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা কোম্পানি সেক্রেটারি বা আইন চর্চাকারীকে জিজ্ঞাসা করুন, তাঁরা আপনাকে জানাতে পারবেন—আয়কর, জিএসটি, কোম্পানি আইন, আরবিআই রেগুলেশনস, সেবি রেগুলেশনস প্রভৃতি ক্ষেত্রে কী ব্যাপক হারে নতুন নিয়ম ও বিধান যোগ করা হয়েছে এবং তার দরুন জটিলতা বেড়েছে কতটা। আপনি কি সম্প্রতি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন কিংবা বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রি করেছেন অথবা একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন? এসব ক্ষেত্রে স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয় সংখ্যা দেখে তো আমি থ!
বাস্তবটা জানুন
১৯৯১ সালে লিবারালাইজেশন বা উদারীকরণের পর থেকে আমাদের দেশের যে অগ্রগতি হয়েছে, তার জন্য এস জয়শঙ্কর এবং অশ্বিনী বৈষ্ণবও সংগত কারণেই গর্বিত হতে পারেন। সেটি ছিল দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উষাকাল। বিশেষ করে ১৯৯৭ (এশীয় আর্থিক সঙ্কট), ২০০৮ (আন্তর্জাতিক আর্থিক সঙ্কট), ২০১৬ (বিমুদ্রাকরণ) এবং ২০২০ (কোভিড) সালে কিছু বিপত্তি ছিল। তবুও, পূর্ববর্তী সরকারগুলির কাঁধে ভর দিয়ে পরবর্তী সরকারগুলি আরও কিছু সংযোজন করেছে মাত্র। কোনও সরকারকেই নোংরা স্লেট মুছে সাফসুতরো করে নিয়ে লেখা আরম্ভ করতে হয়নি—মোদি সরকার এই ‘সত্য’ আমাদের বিশ্বাস করাতে চায়। তাহলে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের কথাই ভাবা যাক। বিশাল ক্ষমতাসহ সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। ভ্যাকসিনসহ নানাবিধ ‘বায়োলজিক্যাল’ প্রস্তুতে বিস্তর অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছে সংস্থাটি। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ উপস্থিত হলে এই ভারতীয় সংস্থা অস্ট্রাজেনেকা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েছে। আর এইভাবে হয়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির একটি। গালভরা ‘জেএএম’ বা ‘জ্যাম’ কথাটি ধরুন—জন ধন অ্যাকাউন্ট, আধার এবং মোবাইল—এই তিনটি জিনিসের ইংরেজি আদ্যক্ষর থেকে তৈরি অ্যাক্রোনিম (সংক্ষিপ্ত রূপ)। ‘নো-ফ্রিলস’ বা বাহুল্য খরচের বোঝা ছাড়াই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের (‘জিরো ব্যালান্স’) বীজ বুনেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দুই পূর্বতন গভর্নর। তাঁরা হলেন এস রঙ্গরাজন (১৯৯২-১৯৯৭) এবং বিমল জালান (১৯৯৭-২০০৩)। তাঁদের আমলে লক্ষ লক্ষ ‘নো-ফ্রিলস’ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার (ইউআইডিএআই) গাইডেন্সে প্রথম আধার নম্বরটি দেওয়া হয় ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। আর মোবাইল বিপ্লব? সেটি শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, ৩১ জুলাই প্রথম একটি কল চালু করার মধ্য দিয়ে।
আপনি যদি অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা
জানতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই মন্ত্রীদের প্রশংসা শুনতে হবে (এসব আপনাকে আশান্বিত করে তুলবে)। তবে তার পাশে প্রতিমাসের আরবিআই বুলেটিনে অর্থনীতির অবস্থার উপর
প্রকাশিত নিবন্ধটিও (‘স্টেট অফ দি ইকনমি’) পড়তে ভুলবেন না।