সৎসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে মানসিক তৃপ্তি। কাজকর্মের ক্ষেত্রে নতুন কোনও যোগাযোগ থেকে উপকৃত ... বিশদ
এই মুহূর্তে ৭টি আঞ্চলিক দল একক ক্ষমতায় বেঁচে আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, তেজস্বী যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, হেমন্ত সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি, ওমর আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং এম কে স্ট্যালিনের ডিএমকে। এই ৭টি আঞ্চলিক দল এখনও পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির সঙ্গে কোনওরকম জোটে যুক্ত হয়নি কিংবা পরোক্ষ সখ্য স্থাপন করেনি। লক্ষণীয় যে, ঠিক এই ৭টি দলই এখনও পর্যন্ত নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব, ভোটব্যাঙ্ক, গুরুত্ব এবং নিজেদের রাজ্যে তথা জাতীয় স্তরেও প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আর বিজেপির সঙ্গে জোট করে কিংবা সরাসরি এনডিএ জোটের শরিক না হলেও বিজেপির সঙ্গে গোপন অথবা প্রকাশ্য বন্ধুত্ব রেখে গিয়েছে যারা, তাদের মধ্যে একঝাঁক দলের এখন অস্তিত্ব রক্ষাই সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, জগনমোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস, সুখবীর সিং বাদলের শিরোমণি অকালি দল, জয়ললিতার রেখে যাওয়া দল এআইএডিএমকে, নীতীশকুমারের সংযুক্ত জনতা দল, মেহবুবা মুফতির পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি, নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দল, কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি, উদ্ধব থ্যাকারের শিবসেনা, দেবেগৌড়ার জনতা দল (সেকুলার)।
এই দলগুলি এখনও রয়েছে। কিন্তু কারও প্রভাব সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ। আবার কেউ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ক্রমেই পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে। চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতীশকুমাররা নিজেদের মোদি সরকারের ভাগ্যনিয়ন্তা ভাবলেও আদতে কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপির উপর তাঁরা অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাঁরা দুজনেই নিজেদের রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্র থেকে অগাধ টাকা দিয়ে তাদের সরকার চালানোয় পরোক্ষ সাহায্য করছেন মোদি। সুতরাং বিজেপির থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে তাঁরা কী করবেন? লাভ কী হবে? তাঁরাও জানেন যে, এই শেষ টার্ম। এরপর তাঁদের রাজ্যে চালকের আসনে আসছে বিজেপি।
ওড়িশা, মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক সময় বিজেপি ছিল ছোট শরিক। আজ তারাই সেইসব রাজ্যে সরকারের প্রধান। যাদের মাধ্যমে বিজেপির উত্থান হয়েছিল, তারা আজ গুরুত্বহীন। অর্থাৎ বিজু জনতা দল অথবা শিবসেনা। বিহারে নীতীশকুমারের এটাই শেষ শাসন। ২০২৫ সালে এনডিএ জোট ক্ষমতাসীন যদি হয়, তাহলেও নীতীশকুমার আর মুখ্যমন্ত্রী হবেন না। হবেন বিজেপির কোনও নেতা। এটাই মোদির ফর্মুলা। আগে বন্ধুত্ব করো। তারপর গ্রাস করে নাও। তারপর ছুড়ে ফেলে দাও। একনাথ সিন্ধে নবতম উদাহরণ।
সমুদ্র অথবা নদীতে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে নেবে। বৃহৎ বৃক্ষ ক্রমেই ক্ষুদ্র উদ্ভিদদের জমি দখল করে নিয়ে শিকড় ও ডালপালা বিস্তার করে দেয়। জঙ্গলে বাঘ কখনও চায় না তার চারণভূমিতে আরও একাধিক বাঘ ঘুরে বেড়াক। তারা চায় তার একটি এলাকা নির্দিষ্ট থাকবে এবং সেখানে সেই রাজা। আফ্রিকায় সিংহদের মধ্যে সংঘাত লেগেই থাকে পরিবার কিংবা গোষ্ঠীর দখল নিয়ে।
অতএব নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি প্রকৃতি ও রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই চাইছে, যে রাজ্যে বিজেপি দুর্বল, সেখানে কোনওভাবে একবার প্রবেশ করে ক্ষুদ্র শিকড় প্রোথিত করার সুযোগ পেতে। সেটা সম্ভব হয় ওইসব রাজ্যে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে জোট করা, বন্ধুত্ব স্থাপন করলে। অর্থাৎ কোনওমতে একবার রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে পা রাখা। তারপর ক্রমেই সেইসব দলের ভোটব্যাঙ্কে বিজেপি থাবা বসায়। জোটের ফলে ওইসব দলের ভোটারদের কাছে টেনে নেওয়া হয়। এবং ক্রমে বিজেপিই হয়ে ওঠে সেইসব জোটের প্রধান চালিকাশক্তি। ধীরে ধীরে ওই আঞ্চলিক দল দুর্বল হয়ে যায়। বিজেপির আর্থিক ও প্রভাবের ক্ষমতার অধীনস্থ থেকে সেইসব দলের রাজনৈতিক ঝাঁঝ কমে যায়। এভাবেই তারা হীনবল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত প্রভাব হারায়। শেষ পর্যন্ত বিজেপির ছোটভাই হয়ে থাকতে হয়।
সর্বশেষ উদাহরণ মহারাষ্ট্রে একনাথ সিন্ধের শিবসেনা। উদ্ধব থ্যাকারের দলকে ভেঙে তিনি বিজেপির কাছে চলে এসেছিলেন। ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই সেই মুখ্যমন্ত্রিত্ব চলে গেল। যিনি নভেম্বর মাসেও ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তিনি ডিসেম্বর মাস থেকে উপ মুখ্যমন্ত্রী। যে পদের কোনও গুরুত্বই নেই।
নবীন পট্টনায়ক, মায়াবতী, কে চন্দ্রশেখর রাও এবং জগনমোহন রেড্ডিরা কোনওদিন প্রকাশ্যে এনডিএ জোটে যুক্ত হননি। তাঁরা মুখে বলতেন কংগ্রেস এবং বিজেপির সঙ্গে সমদূরত্ব নীতি। কিন্তু সংসদের অভ্যন্তরে তাঁরা লাগাতার মোদি সরকারকে সমর্থন পাইয়ে দিয়েছেন। অন্যতম কারণ কেন্দ্রীয় এজেন্সির জুজু। সেই কারণে আজ পর্যন্ত এই চারজনকে এখনও পর্যন্ত হাজারো দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও সিবিআই কিংবা ইডি গ্রেপ্তারও করেনি। বিরক্তও করেনি।
কিন্তু তার জেরে তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষতি নিজেদের অজান্তে চরম হয়েছে। মাটি সরে গিয়েছে পায়ের তলা থেকে। আর তারই পরিণতি মায়াবতীর এখন আর উত্তরপ্রদেশে কোনও গুরুত্বই নেই। এবং নবীন পট্টনায়ক, জগনমোহন রেড্ডি এবং কে চন্দ্রশেখর রাওদের তিনজনই ভোটে পরাস্ত হয়ে সরকার থেকে ক্ষমতাচ্যুত।
অর্থাৎ তাদের বিজেপির সংস্পর্শে আসা কিংবা বিজেপিকে পরোক্ষ সমর্থন জোগানোর কারণে বিজেপি কিংবা মোদি সরকারের অনেক লাভ হয়েছে। কিন্তু এইসব দলের কোনও বৃহত্তর লাভ হলই না। ববং লোকসান হয়েছে অনেক বেশি। ওড়িশায় বিজেপি এককভাবে বিপুল সংখ্যায় আসন জিতে সরকার গড়েছে। তেলেঙ্গানায় কংগ্রেস জয়ী হয়েছে এবং সেখানে বিজেপি অন্যতম প্রধান শক্তি। অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুকে সামনে রেখে বিজেপি জোট সরকার। শিরোমণি অকালি দল পাঞ্জাবে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি ছিল। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে তারা এনডিএ জোটে থাকার পর থেকেই পাঞ্জাবে তাদের রাজনৈতিক মাটি সরে যায়। বিশেষ করে কৃষক আন্দোলন ইস্যুতে তাদের অনিশ্চিত অবস্থান রাজনৈতিকভাবে ক্ষতি করে তাদের।
বাংলা একটি আশ্চর্য ব্যতিক্রম। সিপিএম একটি অভিযোগ করে থাকে। তারা বলে এ রাজ্যে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতে ধরে বিজেপিকে
নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ এভাবে তারা মমতাকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাংলায় বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটব্যাঙ্কের সামান্যতম ক্ষতিও করতে পারেনি। বরং বিজেপির ভোটব্যাঙ্কের ৮০ ভাগই সিপিএমের ভোটার। অর্থাৎ সিপিএম ২০১১ সালে ভোটে পরাজিত হওয়ার পর নিজেদের বেঁচে থাকা ভোটারও আর ধরে রাখতে পারেনি। সিপিএমের ভোটব্যাঙ্ক দলে দলে বিজেপিতে ভোট দেয় এখন। পক্ষান্তরে তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের ভোটশেয়ার ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। ২০১৯ সালে বিজেপি সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছিল লোকসভা ভোটে ১৮ আসন পেয়ে। কিন্তু ২০২৪ সালে তারা সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি।
২০২৫ সালে দিল্লি এবং বিহারে বিধানসভা ভোট। এই দুই রাজ্যে বিজেপির প্রত্যক্ষ ভোটযুদ্ধ দুই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে। দিল্লিতে আম আদমি পার্টি এবং বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল। রাজ্যের ভোট এখন আর জাতীয় ইস্যুতে জয় করা যায় না। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস কাস্ট সেন্সাস কিংবা সংবিধান বাঁচাওয়ের মতো জাতীয় স্তরের ইস্যু নিয়ে ঝাঁপিয়েছিল। কিন্তু আদতে সেসব কাজে দেয়নি। প্রধানত বিজেপি জোটের জয় এসেছে লাডলি বহেনা যোজনার কারণে। অর্থাৎ সরাসরি মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়া। একইভাবে ঝাড়খণ্ডে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার ওই একই প্রকল্প এবং অন্য সরকারি সহায়তায় আকৃষ্ট হয়েই মানুষ হেমন্ত সোরেনকেই জিতিয়েছে। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ফর্মুলা বরাবরই গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ বাংলার উন্নয়ন, হিন্দি বনাম বাঙালিয়ানা, বিভিন্ন আর্থিক অনুদান প্রকল্প ইত্যাদি ইস্যুতে জোর দিয়ে একের পর নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
নিজস্ব একটি রাজনৈতিক জোরদার অভিমুখ না থাকলে এখন আর ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখা কিংবা নতুন ভোটারকে আকর্ষণ করা সম্ভব নয়। বিজেপির একটি নির্দিষ্ট এবং স্থায়ী ইস্যু আছে। হিন্দুত্ব। আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, আম আদমি পার্টির প্রধান ভরসা হল, স্থানীয় ইস্যু, আর্থিক অনুদান ও সামাজিক উন্নয়ন, মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক এবং বিজেপির রাজনীতি বিরোধী সুস্পষ্ট জোরালো অবস্থান। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার কাছে আদিবাসী অস্মিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। সেই তুলনায় উদ্ধব থ্যাকারে এবং শারদ পাওয়ারের ক্ষমতা ক্রমহ্রাসমান। কারণ তাঁদের নিজেদের একচ্ছত্র ভোটব্যাঙ্ক স্থায়ী হতে পারছে না। উদ্ধব থ্যাকারের দলের অন্যতম ভোটব্যাঙ্ক মারাঠি অস্মিতা এবং হিন্দুত্বের সম্মিলিত একটি সংযোগ। সেটি হারিয়ে গিয়েছে উদ্ধব কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করায়।
বঙ্গ সিপিএম, সংযুক্ত জনতা দল, বহুজন সমাজ পার্টি, জনতা দল (সেকুলার), এআইএডিএমকে, ওয়াই এস আর কংগ্রেস, ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতিদের কাছে নতুন করে কোনও অভিনব রাজনীতি উপহার দেওয়ার মতো অস্ত্র নেই। তাই তাদের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছে মানুষের। ঠিক এই ফর্মুলায় বিজেপির জনপ্রিয়তায় একসময় ভাটা পড়বে। কারণ নরেন্দ্র মোদির গ্ল্যামার ও ক্যারিশমা এখন আর আগের মতো নেই। বিজেপিরও নতুন কিছু রাজনীতি উপহার দেওয়ার নেই। জাতীয়স্তরের দল হিসেবে নয়, বিজেপিকে আগামী দিনে ‘আঞ্চলিক বিজেপি’ হয়েই ভোটে লড়াই করতে হবে। অর্থাৎ স্থানীয় ইস্যু কিংবা রাজ্যের স্বার্থ অথবা আর্থিক সাহায্য ইত্যাদি ইস্যুতে ফোকাস করতে হবে। সুতরাং ভবিষ্যতের লড়াই হবে আঞ্চলিক দল বনাম আঞ্চলিক বিজেপি বনাম আঞ্চলিক কংগ্রেস। ন্যাশনাল পার্টিগুলি থাকবে। যুদ্ধ ছাড়া ন্যাশনাল ইস্যু আর থাকবে না। অতি ব্যবহারে সব ন্যাশনাল ইস্যুর কার্যকারিতা হারিয়েছে। ভবিষ্যতে মানুষ ভোট দেওয়ার আগে দেখবে ‘আমার কী লাভ হবে’? ওটাই ম্যাচিওরড ডেমোক্রেসি!