সৎসঙ্গ ও আধ্যাত্মিক ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠে মানসিক তৃপ্তি। কাজকর্মের ক্ষেত্রে নতুন কোনও যোগাযোগ থেকে উপকৃত ... বিশদ
এক দেশ এক নির্বাচনের ঢক্কানিনাদ বেজে গিয়েছে। মোদি-অমিত শাহের উদ্দেশ্য একটাই, বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে এই কৌশলে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়া। যদি সংবিধান সংশোধনের মতো জটিল প্রক্রিয়া সামলে তা উনত্রিশের সম্মিলিত সাধারণ নির্বাচনের আগে কার্যকর হয়, তাহলে দেশের ভোট রাজনীতিতে এক সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। সেই আঘাতের মোকাবিলা বড় সহজ হবে না। পরস্পর বিরোধী স্বার্থের টানাপোড়েনে ফাটল চওড়া হতে বাধ্য। কংগ্রেস বাদে বিরোধীরা, বিশেষ করে আঞ্চলিক দলগুলি সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছে বলেই রাহুল গান্ধীর বদলে কোনও শক্তিশালী অকংগ্রেসি মুখকে নেতৃত্বে বসাতে চাইছে। শক্তিশালী নেতৃত্ব দিতে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব খোঁজার এই দেশব্যাপী অভিযানে বিরোধীদের সামনে একটাই লড়াকু মুখ—বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনি সমালোচনা করতে পারেন, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা তীক্ষ্ণ কটাক্ষ ছুড়ে দিতে পারেন, তাঁর বদনাম করতে দু’শো আষাঢ়ে গল্পের অবতারণা তাও চলতে পারে, কিন্তু বাস্তবের মাটিতে তাঁর বিকল্প মেলে না। আবারও প্রমাণ হয়, গোটা দেশে বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্য সেরা ‘স্ট্রিট ফাইটার’ এখনও সব বিচারে একমাত্র তিনিই, বাংলার ‘অগ্নিকন্যা’। লালু, কেজরিওয়াল, শারদ পাওয়ার, অখিলেশ কার্যত বাধ্য হয়েই বারবার নিঃশর্তভাবে মমতাকেই ইন্ডিয়া জোটের ব্যাটন তুলে নেওয়ার আর্জি জানাচ্ছেন। মমতাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, চেয়ারের জন্য তিনি লালায়িত নন। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্যি, তেইশ সালের জুন মাসে গড়ে ওঠা ইন্ডিয়া জোটের প্রধান স্থপতি তিনিই। সেই কারণেই সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলা তাঁর একমাত্র অগ্রাধিকার। ১৬ মাস বাদে বাংলার বিধানসভা ভোট আপাতত পাখির চোখ হলেও তাঁর আসল লড়াই কেন্দ্রে বিজেপির চতুর্থবার ক্ষমতায় আসা রুখে দেওয়ার। তাই নেত্রীর কাছে লড়াইটা দু’তরফে। একদিকে বাংলায় ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটে জিতে ফিরে আসার, অন্যদিকে পরের লোকসভা নির্বাচনে গোটা দেশে তুল্যমূল্য গেরুয়া বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করা। ইতিমধ্যেই দুই ময়দানেই খেলাটা কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছে।
সামনের বছর থেকে যে রাজ্যগুলিতে বিধানসভা ভোট তাদেরকে পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই আবার লোকসভার সঙ্গে জনসমর্থন যাচাইয়ের পরীক্ষায় বসতে হবে। নতুন বছরের শুরুতেই দিল্লির নির্বাচন। সেখানে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ কিছুতেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে লড়তে রাজি নয়। কারণ শতাব্দী প্রাচীন দলটাকে একটা আসন ছাড়তে হলেও সেটাই ক্ষতি। দিল্লির পর বছরের শেষপর্বে বিহারের ভোট। সেখানেও ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, লালু এবং তাঁর দুই ছেলে একা লড়ার পক্ষেই রায় দেবেন। তারপর ছাব্বিশের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও কেরল সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের ভোট। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে একা লড়লে অধিকাংশ আসনেই কংগ্রেসের জামানত জব্দ হওয়াই স্পষ্ট দেওয়াল লিখন। তাই তৃণমূলের পক্ষে এ রাজ্যে একটি আসন ছাড়াও বাহুল্য বইকি! এরাজ্যে কংগ্রেস বেঁচে আছে মালদহের একটা ছোট গনি সাম্রাজ্যে এবং মুর্শিদাবাদে। আর বামেরা উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র আছেন শুধু সমাজ মাধ্যমের মেকি ‘বিপ্লব’ মঞ্চে। বাস্তবের মাটিতে আগাগোড়া শূন্যই!
এই পটভূমিতে এক দেশ এক নির্বাচন তামাম বিরোধী শিবিরকে আরও বড় অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলে দেবে আশঙ্কা করেই বাংলার নেত্রীকে সামনে থেকে লড়ার আহ্বান জানাচ্ছে, কংগ্রেস ও বামেরা বাদে অন্য সমস্ত বিরোধী দল। ছাব্বিশে বাংলায় উপর্যুপরি চারবার তৃণমূল সরকার গঠিত হলেও তার মেয়াদ মাত্র আড়াই বছরেই সীমিত হয়ে যেতে পারে। উনত্রিশে বিজেপি বনাম বিরোধীদের মহাভারতের নির্ণায়ক লড়াইয়ে মমতাকেই সামনে দাঁড়াতে হবে। অর্জুন এবং কৃষ্ণ, দুই ভূমিকাতেই। রাহুল গান্ধীর প্রতি অধিকাংশেরই বিশেষ আস্থা নেই। সারাদেশের ভোট পাটিগণিতেও কংগ্রেস আজ নিতান্তই ক্ষীণবল। তাই আগামী ২০২৯ সালে ৮২তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ভারতের গণতন্ত্র ও সংবিধান অক্ষুণ্ণ থাকবে, না একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতটা আগ্রাসী লড়াই দিতে পারেন এবং ইন্ডিয়া জোটের তামাম শরিক তাঁর সঙ্গে কতটা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এগতে পারে, সেই রসায়নের উপর।
আগেই বলেছি, মুখে খরচ কমানো এবং সরকারি উন্নয়নের কাজে সময় বাড়ানোর কথা বললেও গেরুয়া শিবির বিশেষ করে সঙ্ঘ পরিবারের আসল উদ্দেশ্য, বিরোধী ঐক্যকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিভিন্ন রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণকে জাতীয় আঙ্গিকে অর্থহীন ও নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে আঞ্চলিক দলগুলির দূরত্ব তৈরিই এই কৌশলের মূল মন্ত্র। কট্টর হিন্দুত্বর সঙ্গে ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অনুসরণ করে ইন্ডিয়া জোটকে ভেঙে দেওয়াই লক্ষ্য। আর নাগপুরের মাথারা তা করতে পারলে এই মুহূর্তের রাজনীতিতে দাঁড়িয়ে যে সহজে কেন্দ্রে সরকার বদল সম্ভব নয় তা বিলক্ষণ জানেন নরেন্দ্র মোদি। কারণ আঞ্চলিক দলগুলি খুব ভালো করলেও লোকসভায় ৪০টি আসন জিততেই হিমশিম খাবে। আর হীনবল কংগ্রেসকে থেমে যেতে হবে একশোর আগেই। আর যদি কংগ্রেসকে দেড়শো পেরতে হয় তাহলে মার খাবে আপ, শিবসেনা, তেলুগু দেশম, সমাজবাদী পার্টি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, ডিএমকে এবং অবশ্যই লালুর আরজেডি। ক্ষতি স্বীকার করতে হবে তৃণমূলকেও। এই অবস্থায় কংগ্রেসের পক্ষে আঞ্চলিক দলগুলির নেতৃত্ব দেওয়া প্রায় অসম্ভব। শুধু বাংলাই নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও একমাত্র বিকল্প তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
একুশের বিধানসভা ভোটের আগে বাংলার রাজনীতি আন্দোলিত হয়েছিল একটিমাত্র স্লোগানে—‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়, বহিরাগতদের বিদায় চায়’। আর মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভোটের ফলে কংগ্রেসের শোচনীয় ভরাডুবির পর আওয়াজ উঠেছে, ‘ভারত নিজের মেয়েকেই চায়’। তৃণমূল নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগতদের পক্ষ থেকেও নয়, বাম ও কংগ্রেস বাদে ইন্ডিয়া জোটের একের পর এক শরিক ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে মমতাকেই চাইছেন। এই তালিকায় আছেন শারদ পাওয়ার থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, লালুপ্রসাদ থেকে অখিলেশ যাদব, ওয়াইএসআর কংগ্রেস থেকে শিবু সোরেনের ছেলে হেমন্ত। মুখে না বললেও ডিএমকের পর্যন্ত এব্যাপারে সায় রয়েছে। সাহস যেমন সহজেই সংক্রামিত হয়, তেমনি মমতার প্রতি জাতীয় স্তরের বিরোধী নেতানেত্রীদের এই আস্থা ও সমর্থনই প্রমাণ করে আজও তিনি কতটা জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য মুখ। মহারাষ্ট্র নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর সেই হাওয়ায় নিঃসন্দেহে দমকা বাতাস লেগেছে। প্রায় দু’বছর আগে ইন্ডিয়া জোটের জন্ম ইস্তক নেতৃত্ব নিয়ে কিছুতেই সহমত হতে পারছে না। কারণ নির্বাচনী আসরে বিশেষ করে উত্তর থেকে দক্ষিণ—অধিকাংশ রাজ্যেই বিধানসভার ভোটে রাহুল, সোনিয়ার কংগ্রেস ধারাবাহিকভাবে অকৃতকার্য। অনেক আশা জাগিয়েও শতাব্দী প্রাচীন দলটি মহারাষ্ট্র দখলে ব্যর্থ। ব্যর্থ হরিয়ানাতেও। সামনে দিল্লির নির্বাচন। সেখানেও ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম সদস্য আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তাঁর সতীর্থরা কংগ্রেসকে পাশে চান না।
দেশের শাসক দল বিজেপি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও বারেবারে তাকে রুখতে পারেনি। একুশ, চব্বিশের পর আগামী ছাব্বিশের নির্বাচনী লড়াইয়েও যাবতীয় ভোট পণ্ডিতের হিসেবকে ভুল প্রমাণ করবে। এক্সিট পোলের পূর্বাভাস মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলার সেই মেয়েই এখনও বাংলায় ক্ষমতায়। বিজেপির লম্ফঝম্প থামাতে পারেন একমাত্র তিনিই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ঝাঁপ, মন্ত্রীসান্ত্রিদের ডেলি প্যাসেঞ্জারিকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে তিনি বছরের পর বছর একইরকম অপ্রতিরোধ্য।
জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার গুরুত্ব বৃদ্ধি কোনও অলৌকিক ঘটনা নয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে দু’ক্ষেত্রেই তা দেখেছি আমরা। তবু সরকারে কিংবা নির্বাচিত সরকারের মুখ হিসেবে কোনও বাঙালিকে তেমনভাবে পাওয়া যায়নি কখনও। তাই ৭৫ বছরের স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একজনও প্রধানমন্ত্রী পাওয়া হয়নি বাংলা থেকে। দলমত নির্বিশেষে এ আমাদের বড় আক্ষেপ। স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল বাঙালি। দেশের স্বার্থে তারা প্রাণ দিতে পিছপা হয়নি কখনও। যোগ্যতার অভাবও ছিল না তাদের। এই তালিকায় সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। তাহলে এক আটপৌরে পরিবারের অসমসাহসী বাঙালি নেত্রীকে পিছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা কেন? যদি নিজের যোগ্যতায় মমতা দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী চেয়ারে বসতে পারেন তাতে এ রাজ্যে এত গাত্রদাহ কেন? বাঙালি চিরদিনই কি পরশ্রীকাতর কাঁকড়ার জাত হয়েই ইতিহাসে হারিয়ে যাবে? নেতাজি থেকে জ্যোতি বসু হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হবে যুগ যুগ ধরে!