যে কোনও ব্যবসায়িক কর্মে অতিরিক্ত অর্থলাভের প্রবল সম্ভাবনা। শিল্পীদের পক্ষে শুভদিন। ... বিশদ
বিমল বাদ্যকর আপনার-আমার সবার চেনা। নামটা শুধু বদলে দিন। পুজোর সময় এই বিমলকেই আমরা দেখতে পাই। কখনও ঢাকি হিসেবে, কখনও ফুলের দিদি, আবার কখনও কুমোরটুলিতে দেবীকে ম্যাটাডোরে তুলে দেওয়া মুটে রূপে। পুজো মানে এদের কাছে রেস্তরাঁয় খাওয়া, প্যান্ডেল হপিং বা আউটিং নয়। পুজো মানে এদের কাছে জামা-জুতোর নতুন স্টক বা বোনাসও নয়। দুর্গাপুজোর পাঁচটা দিন মানে এরা বোঝে বাড়তি কয়েকটা টাকা আয়ের সংস্থান। ঢাকিদাদা ভাবে, টাকাটা পেলে মেয়েটার স্কুলের নতুন জুতো হবে। জলায় নেমে পদ্ম তুলে আনা নিতাই হিসেব কষে... আর এক ডজন তুলে দিতে পারলেই মায়ের জন্য একটা ছাপা শাড়ি হয়ে যাবে। পাড়ার মণ্ডপের পাশে রোলের ঠেলাগাড়ি দেওয়া বেকার যুবকটি স্বপ্ন দেখে, এর লাভের টাকা জমিয়েই একটা দোকান দেওয়ার মতো সংস্থান হয়ে যাবে। এরা কেউ সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে লেখে না। এরা বিপ্লব করে না। এরা উই ওয়ান্ট জাস্টিস স্লোগান তুলে পথেও বসে না। এদের বলা কথাগুলোয় কোনও শব্দ নেই, আছে শুধু আকুতি... ‘মা, এই পুজোয় বন্যা দিও না’... ‘এবার পুজো কমিটিগুলোর যেন টানাটানির সংসার না হয়’... ‘এবার যেন বায়নাটা ভালো হয়।’ এই মানুষগুলোর সংখ্যা কত জানেন? কয়েক লক্ষ। বিলাসিতা করা এদের সাজে না। দেওয়াল লেখাও নয়। প্রতিদিন এদের লড়াই। বেঁচে থাকার। প্রতিদিন এদের যুদ্ধ জাস্টিসের জন্য। বড়লোকদের কাছে। সমাজের কাছে। কারা আজ তুলছে আওয়াজ দুর্গাপুজো বন্ধের? বয়কটের? কী স্বার্থ তাদের? কোন গিমিকে গা ভাসিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের পেটে লাথি মারতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা? বড় জানতে ইচ্ছে করে।
আসলে বিমল বাদ্যধর বা নিতাইদের অ্যাকাউন্টে মাসের ১ তারিখ বেতন ঢুকে পড়ে না। তারা বিদেশে শ্যুটিং সেরে ফিরে মহামিছিলে পা মেলায় না। আবার বাবার হোটেলে খেয়ে আইফোন হাতে প্রতিবাদী সেলফি তুলে ফুটানিও মারে না। অথচ তারা আছে এই সমাজেই। এরাই দিনের শেষে সমাজ-গাড়ির চাকা। নিঃশব্দ চালিকাশক্তি। একটা সমাজের ঢুকে থাকা অন্য এই সমাজটাকে আমরা দেখেও দেখি না। এটা আমাদের ব্যর্থতা? নাকি নির্বুদ্ধিতা? উত্তর অবস্থা বিশেষে বদলে যায়। বদলায় না এদের জীবনযাত্রা। এরা জানে, আট কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতে মেয়েটার কী কষ্ট হয়। এরা জানে, মাসে হাজার টাকা জোগাড় করতে রক্ত জল হয়ে যায়। তবু মেলে না। আর ‘ভিক্ষার দানে’ যদি কেউ এমনিই অ্যাকাউন্টে সেই টাকা পৌঁছে দেয়? ওটাই তাদের কাছে আশীর্বাদ। শহর, শহরতলি বা সিস্টেমকে অচল করে দেওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। সত্যিই যদি সমাজের জন্য কিছু করতে হয়, এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। হঠাৎ একটা হুজুগ তুলে এদের পেটে লাথি মারার মধ্যে দিয়ে জাস্টিস আসে না। আসবে না। মোদ্দা কথাটা হল, প্রতিবাদের মূল মঞ্চ এখন দখল করে নিয়েছে রাজনীতি। এখানে সমাজ, মানুষ গুরুত্ব পায় না। প্রথম এবং একমাত্র শর্ত হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতির বাঁশে ক্ষমতার পতাকা ওড়ানো। অভয়া, ডাক্তারি, খেটে খাওয়া মানুষ, পুজো... এই সবই রাজনীতির দাবাখেলায় ঘুঁটির ভূমিকায়। এক পক্ষ লাগাতার চাল দিয়ে চলেছে। অন্য পক্ষ ধৈর্য ধরছে। অপেক্ষায় আছে পাল্টা চালের। সবটাই ক্ষমতার লড়াই। আর ঘুঁটিরা ভাবছে, আমরাই তো সব করছি। রাজনীতি এবং বাংলাকে পঙ্গু করে দেওয়ার উদভ্রান্ত দৌড়ে আমরা মাথা তুলে একবারও তাকাচ্ছি না বারাণসীর দিকে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্র। আইআইটি-বিএইচইউয়ের ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার বিজেপির আইটি সেলের কর্মী সাত মাসেই জামিন পেয়ে গিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, তাদের রীতিমতো ফুল-মালা দিয়ে সংবর্ধনা হয়েছে। আপ্যায়ন করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেই মেয়েটির জন্য একটি মোমবাতিও কি আমরা কেউ কিনেছি? স্লোগানে বা প্ল্যাকার্ডে কি লেখা হয়েছে ‘দফা এক, দাবি এক, মোদির পদত্যাগ’? সেখানকার পুলিস কাকে আড়াল করেছে? সেই তদন্ত হচ্ছে না কেন? সিবিআই কেনই বা সেখানে কোনও সঞ্জয় বা সন্দীপ ঘোষকে খুঁজে বের করার দাবিতে আদালতের কাছে আর্জি জানাচ্ছে না? উত্তর আছে—ওখানে যে রাজনীতি করার কেউ নেই। মোদি হটাও বা যোগী হটাও স্লোগান বারাণসীতে পড়ে না। কেউ প্ল্যাকার্ড হাতে তাই বিচারও চায় না। ধরে নেওয়া গেল, উত্তরপ্রদেশে প্রতিবাদ গড়ে তোলার মতো কোনও জেনারেশন নেই। সমাজ নেই। বাংলায় তো আছে! তাহলে সিস্টেমের এই দৈন্য কেন অভয়ার প্রতিবাদ মঞ্চে উঠে আসছে না? কেন একটা প্ল্যাকার্ডেও ভেসে উঠছে না বারাণসী ওয়ান্টস জাস্টিস?
বাজারে একটা ভিডিও ক্লিপ চলছে। একটি অনুষ্ঠানে শ্রুতি হাসান পারফর্ম করছেন। আর দর্শকাসনের সামনের সারিতে বসে কুৎসিক অঙ্গভঙ্গি করছেন দক্ষিণের নামজাদা অভিনেতা মোহনলাল। পাশে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন মামুট্টির মতো বর্ষীয়ান অভিনেতাও। শ্রুতি তো মোহনলালের মেয়ের বয়সি। অনুষ্ঠানে তাঁকে যে ক্যামেরা ফলো করবে, সেটাও তিনি খুব ভালো করে জানেন। তারপরও এমন আচরণে তাঁর বাধল না? আসলে সিস্টেমটাই এমন। অশিক্ষিত। প্রবৃত্তিনির্ভর। গোটা দেশ তোলপাড় পড়ে গিয়েছে মালায়লম ফিল্ম ইন্ডাস্টির যৌন কেলেঙ্কারি নিয়ে। সৌজন্যে, হেমা কমিটির রিপোর্ট। বহু প্রথম সারির অভিনেতা ও পরিচালকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনেছে এই কমিটি। কারা তারা? সেই নাম প্রকাশ্যে খুব একটা আসেনি। সবটাই ভাসা ভাসা। কেরল সরকার ইতিমধ্যে এর পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সিট গঠন করেছে। সামান্থা রুথ প্রভু একইভাবে তেলুগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির রোশনাইয়ের নীচে জমাট বেঁধে থাকা অন্ধকার প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছেন। অর্থাৎ, প্রতিবাদ হচ্ছে। সঙ্গে তদন্তও। ইন্ডাস্ট্রির ভিতর এবং বাইরে... প্রত্যেক সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রাখছেন, বিচার পাওয়া যাবে। তার জন্য রাজনীতি না করলেও চলবে। কেরলে দুনিয়ার সামনে হেনস্তা করে ক্রেডিট নিতে হবে না। বাংলায় অবশ্য যার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি, যৌন নিগ্রহের অভিযোগ, তিনিই মিছিলে হেঁটে জাস্টিস চাইছেন। টিভি চ্যানেলের বুমের মুখে দাঁড়িয়ে সিস্টেমের বাপান্ত করছেন। কে তৈরি করেছে এই সিস্টেম? আপনি নিজেও কি তার কারিগর নন? পুলিসকে ঘুষখোর বলে বিষ উগরানোর আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন তো, ঘুষটা তাকে কে দেয়? কারা তৈরি করেছে এই ঘুষের সিস্টেম? এটাও কি রাজনীতি নয়? শুধু পার্টি করলেই রাজনীতি হয় না। প্রতিদিন ঘটে যাওয়া হাজার হাজার অপরাধ থেকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়াটাও রাজনীতি? সুনাগরিক হিসেবে সঠিক কথাটা সর্বত্র বলতে হয়। শুধু মিছিল বা অবরোধে নয়। আমরা প্রত্যেকে জানা-অজানায় এই রাজনীতিরই শিকার? প্রতিবাদ রাজনীতি। সম্প্রতি এই বাংলার একটি গ্রামেই আদিবাসী এক যুবতীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাঁর জন্য মিছিলে কিন্তু একটাও মোমবাতি দেওয়া হয়নি? একবারও তাঁর জন্য ওঠেনি স্লোগান? কেন, তাতে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হবে না? নাকি স্টেটাস আসবে না?
আর জি কর হাসপাতালের দেওয়ালে বেশ কিছু গ্রাফিত্তি ছিল। সচেতনতা প্রচার। কোথাও হাত ধোওয়ার পরামর্শ, কোথাও ভিড়ে মাস্ক পরার, আবার কোথাও হেঁচে-কেশে জীবাণু না ছড়ানোর। সেই সব লেখা বদলে গিয়েছে। আসল লেখার উপর রঙের পোঁচ পড়ে ফুটে উঠেছে নতুন লেখা। ওয়াশ ইওর হ্যান্ড হয়ে গিয়েছে ওয়াশ ইওর মাইন্ড। মন পরিষ্কার করার ডাক। কে করবে মন পরিষ্কার? উত্তরপ্রদেশ, কেরল, মহারাষ্ট্র, বাংলা... প্রবৃত্তি এবং তারপর বৈষম্য—এই চেইনটাই আজ সব রাজ্যের, সব সমাজের আইডেন্টিটি কার্ড। দগদগে এই ঘা সর্বত্র। ডাক্তার, আদিবাসী বা কাগজকুড়ানি, প্রত্যেককে আমরা আজও এক আসনে বসাতে পারিনি। আর এই সুযোগই নিয়ে চলেছে রাজনীতির কারবারিরা। সমস্যাটা সমাজে, মানসিকতায়। সেটাই জন্ম দিচ্ছে নোংরা রাজনীতির। আমাদের প্রত্যেকের মনেই যে স্বার্থান্বেষী চিন্তাভাবনা আর বৈষম্যের ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে। খেয়ে ফেলছে তারা সাধারণ ভাবনাচিন্তাকেও। ভুলে যাচ্ছে তারা, যে থালায় খাই, সেই থালাতেই মলত্যাগ করা যায় না। যে রাজ্য আমার জন্মভূমি, তাকে বদনামের এভারেস্টে বসালে আমারই শিক্ষা-সংস্কৃতির অপমান। ফুটবল খেলায় সবচেয়ে থ্যাঙ্কলেস জব গোলকিপারের। চারটে ভালো সেভ করার পর একটা মিস করলেই সব দায় তার কাঁধের উপর চেপে বসে। বাছাই করা শব্দে এবং বিশেষণে ভরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। আমরা ভুলে যাই, এই গোলকিপারই ৮৮ মিনিট আমাদের রক্ষা করেছে। আর এখানে ‘আমরা’ কারা? যারা প্রচার চাই... রাস্তায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, গাড়ির জানালার কাচের ওপারে। সবার আগে চাই রাজনীতি। অচল সমাজে দুর্বৃত্তায়ন সহজতর হয়। সেই চেষ্টাই চলে নিরন্তর। কেউ ফাঁদে পা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা সেই ফাঁদেই পা আটকে বসে আছি। কিন্তু জালে জড়িয়ে যাওয়া এমন মানুষের সংখ্যা কত? মেরেকেটে ৫ শতাংশের বেশি নয়। বাকিরা? পেটের জ্বালায় দিনরাত ছুটে যাওয়া গরিব প্রান্তিক মানুষ। ফোন কেনার জন্য তারা রোজগার করে না। দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়াটাই তাদের স্বস্তি। পুজো তাদের কাছে বিলাসিতা নয়। কয়েকটা টাকা রোজগারের জন্য বছরের একমাত্র উৎসব। রাজনীতির অলিন্দে কে বিচরণ করবে, সেটাও কিন্তু এরা ঠিক করে। নিঃশব্দে। আঁতলামোয় তাদের পেট যেমন ভরে না, প্রভাবিতও করা যায় না।