উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। হিসেব করে চললে তেমন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবসায় উন্নতি ... বিশদ
ঐতিহাসিক মন্দিরের শিল্যানাসের বাকি আর মাত্র ৭২ ঘণ্টা। গত নভেম্বরে বেরিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের রায়। তারপর কোথা দিয়ে যেন ন’মাস কেটে গিয়েছে। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশাসনিক কাজকর্মেও সিলমোহর দেয় সরকার। কিন্তু তারপরই বৈশ্বিক মহামারীর ঠেলায় সব থমকে যায়। এখনও মহামারী পিছু ছাড়েনি। অযোধ্যাও তার ব্যতিক্রম নয়। সেখানে কর্তব্যরত পুলিস, এমনকী পুরোহিতরাও ওই ভয়ঙ্কর রোগের শিকার। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরাও যে নাছোড়বান্দা। আর সবার উপরে রয়েছে আর এসএস, বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির জটিল ভোট অঙ্ক। পাখির চোখ, লোকসভা নির্বাচন ২০২৪। টানা তৃতীয়বার জিতে দিল্লি দখলের রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন। সেই কারণেই জন্ম-মৃত্যু, মহামারী, প্রলয় কোনও কিছুই আপাতত ভোটের সেই অঙ্ক কষা থেকে মোদি-অমিত শাহদের নিরস্ত করতে পারে না। কারণ ওই আপাত সরল অঙ্কটাই আজ গেরুয়া শিবিরের রাজনীতির একমাত্র ধ্রুবপদ। আপাতত তাই ৫ আগস্টের অপেক্ষা। মোদিজির হাত ধরে ওইদিন থেকে শুরু হবে মন্দির আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস লেখার কাজ। ভার্চুয়াল নয়, করোনা পর্বেও গোটা অনুষ্ঠানটি হবে ষোলোআনা রিয়াল। ভূমিপূজনের শুভ মুহূর্ত দুপুর সাড়ে বারোটা। গলওয়ান কাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী লাদাখ গিয়েছিলেন জওয়ানদের মনোবল বাড়াতে। এবার অযোধ্যা সফর। করোনার মধ্যেও এই দুটোই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রিয়াল কর্মসূচি তাঁর। অটলবিহারী বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদবানিরা যে স্বপ্ন ফেরি করেও শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত করতে পারেননি, এবার তাই করে দেখাতে চলেছেন তিনি। স্বাধীন ভারতের ৭৩ বছরের ইতিহাসে কোনও অকংগ্রেসি রাজনীতিকের কেরিয়ারে যা নিঃসন্দেহে গৌরবের মাইলফলক হয়েই থাকবে চিরদিন।
ভুললে চলবে না, মন্দিরের স্বপ্ন দেখিয়েই চার দশক আগে বিজেপি দলটার জন্ম। তারপর শান্ত সরযূ দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী থেকেছে এই প্রাচীনতম জনপদ। অযোধ্যা ইস্যুকে সামনে রেখেই ধীরে ধীরে ভারতীয় রাজনীতির সেন্টার স্টেজ দখল সঙ্ঘ পরিবার তথা হিন্দুত্ববাদীদের। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বিতর্কিত বাবরি সৌধ ধ্বংস জাতীয় রাজনীতিকেই নতুন খাতে প্রবাহিত করতে শুরু করে। সেই ঘটনার পরও বহু বছর অতিক্রান্ত। বিজেপির পুরনো প্রজন্ম অনেক স্বপ্ন ফেরি করেও শেষপর্যন্ত রামমন্দিরের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারেনি। কখনও রাজনৈতিক অঙ্ক মেলেনি, আবার কখনও বাদ সেধেছে আদালত। আজ ৯৩ বছর পেরনো মন্দির আন্দোলনের সবচেয়ে জনপ্রিয় জীবিত ব্যক্তিত্ব আদবানিজির সামনেই মোদি-অমিত শাহের হাত ধরে গেরুয়া শিবিরের দীর্ঘদিনের সেই স্বপ্ন বাস্তব হতে চলেছে। নিঃসন্দেহে এদেশের কট্টর হিন্দুত্বের রাজনীতিতে এক বিরাট ঘটনা।
কিন্তু সে তো গেল হিন্দুত্ববাদীদের গৌরব আর আহ্লাদের কথা। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর করোনার আবহে মানুষ এর থেকে কী পাবে? সাধারণের সরাসরি কতটা উপকার হবে? এই বিতর্কও কিন্তু শুরু হয়েছে। খেয়ে পড়ে বাঁচলে তবে না মানুষ মন্দিরে ভজন পূজনে অংশ নেবে। সে ফুরসতই বা কোথায়। একই সঙ্গে শিলান্যাসের জন্য এই সময়টাকে বেছে নেওয়া নিয়েও প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। পবিত্র রাখি পূর্ণিমা (৩ আগস্ট) ও আসন্ন জন্মাষ্টমীর (১১ আগস্ট) মধ্যবর্তী সময়টাকে বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব ছাপিয়ে ৫ আগস্টের এই কর্মসূচি মনে করিয়ে দেয়, মানুষের শত বিপন্নতার মধ্যেও রাজনীতিকদের কূট খেলা কখনও থেমে থাকে না। থেমে থাকে না মানুষে মানুষে বিভাজনের সঙ্কীর্ণ কৌশলও। কারণ মানবিকতা কিংবা উন্নয়ন নয়, কোনও গঠনমূলক কাজও নয়, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভাজনই এদেশে ভোট যুদ্ধে সফল হওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। সেই সাফল্যের ফর্মুলাকে বেছে নিতে তাই কোনও কসুর করতে রাজি নয় মোদি ব্রিগেড।
এমনিতেই করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্বের ঠেলায় মানুষ আজ বড় একা। এক অব্যক্ত অসহায়তা গ্রাস করেছে ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে গোটা জাতিকে। এককথায় বৈশ্বিক মহামারীতে গোটা পৃথিবীই বিধ্বস্ত। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে সবার। একান্ত পরিচিতজনের সঙ্গেও দেখা করতে, মুখোমুখি কথা বলতে মানুষ দু’বার ভাবছে। সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়েও দিব্যি রমরমিয়ে মন্দির রাজনীতিতে শান দেওয়ার কাজ চলতে থাকে। এই একটা ঘটনাই বুঝিয়ে দেয়, করোনা আবহেও বর্তমান বিজেপি নেতৃত্ব তার কোর অ্যাজেন্ডা থেকে কিছুতেই সরতে রাজি নয়। গত বছর আগস্টে বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে কাশ্মীরকে দু’ভাগ করেছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। অবলুপ্ত হয়েছিল সংবিধানের বিতর্কিত ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা। ওই পদক্ষেপের পিছনেও বিভাজনের নিপুণ রাজনৈতিক অঙ্ক ছিল। এবং, তা করতে গিয়ে মাসের পর মাস রাজ্যেরই প্রাক্তন তিন মুখ্যমন্ত্রীকে গৃহবন্দি পর্যন্ত করে রাখতে হয়েছে। আজ একবছর পরও তারমধ্যে একজন এখনও অন্তরালে। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের বর্ষপূর্তির দিনেই ফের আর এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়ে গেরুয়া শিবিরের রাজনীতিতে নিজের নাম অক্ষয় করলেন তিনি।
বলা বাহুল্য, মোদিজির রাজনৈতিক জীবনটা আগাগোড়াই অঙ্ক কষে এগনো। যার শুরু ২০০২-এর ভয়ঙ্কর গুজরাত দাঙ্গা দিয়ে। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারার বিলোপই হোক, রামমন্দিরের শিলান্যাসই হোক কিংবা তিন তালাকের অবসান, সবটাই দল ও সঙ্ঘপরিবারের দীর্ঘমেয়াদি ভোট জয়ের অ্যাজেন্ডাকে মেনেই। রামমন্দির নির্মাণ শুরু হলে বিজেপির কট্টর হিন্দুত্বের রাজনীতিও যে আরও চাঙ্গা হয়ে নতুন খাতে প্রবাহিত হবে, তা কারও অজানা নয়। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশকে কেন্দ্র করে সমগ্র হিন্দু বলয়ে দলের বিস্তারে একটা বড় ঝাঁকুনি তো লাগবেই। মেরুকরণ তীব্র হবে। বলা হচ্ছে, মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হতে লাগবে সাড়ে তিনবছর। অর্থাৎ মোদি অমিত শাহদের অঙ্ক হচ্ছে, পূর্ণ নির্মিত রামমন্দিরের উদ্বোধন করা হবে আগামী ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বিশেষভাবে লক্ষ করুন সময়টার দিকে। ঠিক তার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। বেজে যাবে ভোটের দামামা। সেই সঙ্গে আবার উত্তরপ্রদেশ সহ হিন্দি বলয়ে ঝড় তুলে নরেন্দ্র মোদির বাজিমাত! আর উল্টোদিকে দুর্বল কংগ্রেস ও ছত্রভঙ্গ বিরোধীরা।
কিন্তু বিজেপির এই অভূতপূর্ব সাফল্যে মানুষের কী হবে? কতটা যাবে আসবে? বাংলার কী হবে? করোনা উত্তর পৃথিবীতে শুধু মন্দির মন্দির করে কি পেট ভরবে? না গোটা ব্যবস্থাটাই আমূল বদলে যাবে, আমরা কেউ জানি না। আপাতত এরাজ্যের মানুষের কাছে স্পষ্ট নয় আর একটা জিনিসও। বিজেপির অগ্রাধিকার ঠিক কোনটা? ২০২১-এ বাংলার বিধানসভা ভোট নাকি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা বলছেন, বাংলা নয়, গেরুয়া সংগঠনের পাখির চোখ আবার কেন্দ্রে এককভাবে ক্ষমতায় আসাই। সেই দৌড়ে বাংলা একটা কমা কিংবা সেমিকোলন হতেও পারে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। এরাজ্যে আপাতত প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেলেই সন্তুষ্টই থাকবে মোদি ব্রিগেড। কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্নটা থেকেই যায়, এই কঠিন সময়েও মন্দির মসজিদ মাতামাতির আফিমে মজে আখেরে গরিব মানুষের কোন উপকারটা হবে? সবার হাতে কাজ না থাকলে, অর্থনীতি অন্ধকারে ডুবে গেলে ৮২৩ ফুটের সুউচ্চ রামমূর্তি অথবা ১৬১ ফুটের বিশাল মন্দির দিয়ে সাধারণের কোন উপকারটা হবে?