রাগানুগা ভক্তির সব চাইতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছেন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের পার্ষদেরা। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ব্রজবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুরাগকে বলা হয় রাগানুগা ভক্তি। ভক্তি সম্বন্ধে তাঁদের শিক্ষালাভ করতে হয় না। তাঁরা ইতিমধ্যেই সমস্ত শাস্ত্রবিধির চরম সিদ্ধিলাভ করেছেন। যেমন, যে সমস্ত গোপবালকেরা কৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করেছেন, তাঁরা কৃষ্ণের সঙ্গে কিভাবে খেলা করতে হয়, তা তাঁদের তপশ্চর্যা অথবা যোগাভ্যাসের মাধ্যমে শিখতে হয়নি। তাঁরা তাঁদের পূর্ব জন্মেই এই সমস্ত বিধি-বিধানের পরীক্ষাগুলি উত্তীর্ণ হয়েছেন, এবং তার ফলস্বরূপ তাঁরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সখ্যভাব লাভ করেছেন। তাঁদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ভগবৎ-প্রেমকে বলা হয় রাগানুগা ভক্তি। রাগানুগা ভক্তির বিশ্লেষণ করে শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন, কোন কিছুর প্রতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আকৃষ্ট হয়ে তার চিন্তায় সম্পূর্ণভাবে মগ্ন হয়ে, তার প্রতি প্রগাঢ় প্রেমের আকুলতায় যখন ভগবদ্ভক্তি সাধিত হয়, তখন তাকে বলা হয় রাগানুগা ভক্তি। রাগানুগা ভক্তিকেও আবার দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, তার একটি হচ্ছে ‘কামরূপা’ এবং অপরটি হচ্ছে ‘সম্বন্ধরূপা’। এই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে সপ্তম স্কন্ধে নারদ মুনি যুধিষ্ঠির মহারাজকে বলেছেন, “হে রাজন! ভক্ত প্রথমে কাম, দ্বেষ, ভয় অথবা স্নেহের বশে ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু পরিণামে তাঁর সেই আকর্ষণ সব রকম জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে, ধীরে ধীরে তাঁর হৃদয়ে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির উদয় হয়, এবং অবশেষে তাঁর জীবনের পরম প্রাপ্তি শুদ্ধ ভগবৎ-প্রেম লাভ হয়।”
কামার্ত হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভগবৎ-প্রেম লাভের দৃষ্টান্ত হচ্ছেন ব্রজগোপিকারা। ব্রজগোপিকারা হচ্ছেন যুবতী রমণী, আর শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন নবকিশোর। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন ব্রজগোপিকারা কামের বশবর্তী হয়ে কৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তেমনই, কংস কৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল ভয়ের বশবর্তী হয়ে। কংস সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের ভয়ে ভীত ছিল, কারণ সে দৈববাণী শুনেছিল, যে, তার ভগিনীর পুত্র কৃষ্ণ তাকে হত্যা করবে। শিশুপাল সব সময় কৃষ্ণের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ছিল। আর যদুবংশীয়েরা কৃষ্ণকে তাঁদের আত্মীয় বলে মনে করে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই সমস্ত বিভিন্ন ধরনের ভক্তরা ভিন্ন ভিন্নভাবে কৃষ্ণের প্রতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুরক্ত হলেও চরমে তাঁরা সকলেই জীবনের পরম লক্ষ্যে উপনীত হন।
কৃষ্ণের প্রতি ব্রজগোপিকাদের আকর্ষণ ও যদুবংশীয়দের স্নেহ উভয়ই স্বতঃস্ফূর্ত অনুরাগ বা রাগানুগা ভক্তি বলে স্বীকার করা হয়েছে। ভয়ের বশবর্তী হয়ে উদ্বেগগ্রস্ত কংসের নিরন্তর কৃষ্ণচিন্তা, এবং বৈরীভাবাপন্ন হয়ে শিশুপালের কৃষ্ণচিন্তা, ভগবদ্ভক্তি বলে স্বীকার করা হয়নি, কেন না কৃষ্ণের প্রতি তাদের মনোভাব অনুকূল ছিল না। অনুকূল মনোভাবাপন্ন হয়েই কেবল ভগবদ্ভক্তি সাধন করতে হয়। তাই শ্রীল রূপ গোস্বামীর মত অনুসারে এই ধরনের কৃষ্ণচিন্তা ভগবদ্ভক্তি নয়।
শ্রীল রূপ গোস্বামী বিরচিত ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ থেকে