মঠে যোগদানের পর প্রায় আড়াই বৎসরকাল আমাদের মঠ-বাসের সৌভাগ্য হইয়াছিল। সে সময়ে আমরা পূজনীয় খোকা মহারাজের নিকটেই থাকিতাম। তখন মঠের অফিস ও লাইব্রেরি স্বামীজীর ঘরের পশ্চিমে বড় ঘরে ছিল। আমাদের তখন ঐ অফিসের ও লাইব্রেরির কিছু কিছু কাজ করিতে হইত বলিয়া আমরা অধিকাংশ সময়ই উপরে পূজনীয় খোকা মহারাজের ঘরের নিকটেই থাকিতাম। রাত্রেও নিচে শুইবার স্থানাভাবে খোকা মহারাজের ঘর ও স্বামীজীর ঘরের মাঝের ছোট বারান্দাতেই আমাদের শুইতে হইত। কিন্তু তাঁহার এত নিকটে থাকিয়াও সে সময়ে আমরা তাঁহার কোন বিশেষত্ব বা মাহাত্ম্য বুঝিতে পারি নাই। তিনি বাস্তবিকই খোকার মতনই ছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গেই পঙ্গতে বসিয়া খাইতেন ও সকল বিষয়ে আমাদের মতনই ব্যবহার করিতেন। ছোট একটি জামা ও ছোট একটি কাপড় পরিতেন ও নিজেই উহা পরিষ্কার করিতেন। তখন তাঁহার কোনও সেবক ছিল না। আমাদের ডাকিয়া মাঝে মাঝে তাঁহার চিঠি লেখাইতেন। কিন্তু পাশের ঘরে মহাপুরুষ মহারাজের যাহাতে কোনরূপ অসুবিধা না হয় সেদিকে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখিতেন ও অনুচ্চ স্বরেই আমাদিগকে তাঁহার চিঠির মর্ম বলিয়া যাইতেন। এমন সময় যদি পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজ আমাদের একটু ডাকিতেন তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁহার চিঠি লেখা বন্ধ করিয়া তাঁহার নিকটে যাইতে বলিতেন। তিনি তামাক খাইতেন কিন্তু কখনও তাঁহাকে পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজের সম্মুখে তামাক খাইতে দেখি নাই। পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজের সহিত আচরণেও তাঁহাকে খোকার মতন ব্যবহার করিতে দেখিয়াছি। একদিন ঢাকা হইতে কয়েকটি ভক্ত পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজকে সেখানে লইয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করিতে আসায় তিনি তাঁহার শরীর অসুস্থ বলিয়া সেখানে যাইতে অস্বীকার করেন ও পূজনীয় খোকা মহারাজের ঘরে আসিয়া বলেন যে, “খোকা, এই সকল ভক্তরা ঢাকা হতে সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। তা আমার তো শরীর খারাপ তুই একবার সেখানে যা না।” তাহাতে খোকা মহারাজ তাঁহার চোখ দুটি বড় বড় করিয়া বলিলেন, “না না, আমি সেখানে যেতে পারব না। সেদিকে যেতে যে বড় বড় নদী পড়ে তা দেখলে আমার ভয় করে।” পূজনীয় মহাপুরুষ মহারাজও খোকা মহারাজের খোকাত্ব বুঝিয়া আর এই বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করিলেন না।
কিন্তু ইহার দু-তিন বৎসর পরে তাঁহাকে অবশ্য ঢাকায় যাইতে হইয়াছিল। ঢাকা বালিয়াটি গ্রামে তদানীন্তন শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুরের পট প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে ও সেখানকার জমিদার যামিনী রায়ের বাড়িতেও একটু পদার্পণ করিতে হইবে বলিয়া তিনি সেখানে যাইতে অগত্যা রাজি হইয়াছিলেন ও চার-পাঁচটি সাধু লইয়া সেই সময় ঢাকা রামকৃষ্ণ আশ্রমে গিয়াছিলেন। তখন আমরা ঢাকা আশ্রমের কর্মী। সেই সময় আমরা তাঁহার যথার্থ মাহাত্ম্য কিছু কিছু বুঝিতে পারিয়া নিজেরা ধন্য হইয়া গিয়াছিলাম।
স্বামী চেতনানন্দের সংকলিত ও সম্পাদিত ‘স্বামী সুবোধানন্দের স্মৃতিকথা’ থেকে