মেষ: পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত ... বিশদ
“মা ভৈষ্ট বিদ্বংস্তব নাস্ত্যপায়ঃ
সংসারসিন্ধোস্তরণেহস্ত্যুপায়ঃ
যেনৈব যাতা যতয়োহস্য পারং
তমেব মার্গং তব নির্দিশামি।।”
—হে বিদ্বান! ভয় পেও না, তোমার বিনাশ নেই, সংসার-সাগর পার হবার উপায় আছে। যে পথ অবলম্বন করে শুদ্ধসত্ত্ব যোগী এই সংসার-সাগর পার হয়েছেন সেই পথের নির্দেশ তোমায় আমি দিচ্ছি।
ঠাকুর শ্রীমকে অন্যভাবে বলেছিলেন, অনেক নরম করে সহজ করে। প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিয়ে করেছিস? শ্রীম যেই বললেন, হ্যাঁ, ঠাকুর। হতাশ হয়ে বললেন, যাঃ। প্রথম ধাক্কা। ছেলে হয়েছে শুনে, দ্বিতীয় ধাক্কা। শ্রীম বুঝতে পারছেন, ধীরে ধীরে ঠাকুর তাঁর অহঙ্কার চূর্ণ করে দিচ্ছেন। শেষ পথও বাতলে দিলেন কৃপা করে—“তেল হাতে মেখে তবে কাঁঠাল ভাঙতে হয়। তা নাহলে হাতে আঠা জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।”
স্বামীজী শরচ্চন্দ্রকে শঙ্করাচার্যের ‘বিবেকচূড়ামণি’ পাঠ করতে বললেন। দেখিয়ে দিলেন বেদান্তের পথ। ঠাকুর বলতেন রসেবশে, স্বামীজী বলতেন, “আমাদের ভিতর অনন্ত শক্তি, অপার জ্ঞান, অদম্য উৎসাহ।” আর “চেতনের লক্ষণ কি?” “প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।” “যেখানেstruggle, যেখানে rebellion, সেখানেই জীবনের চিহ্ন, সেখানেই চৈতন্যের বিকাশ।” রস বশ নয়। একেবারে বিদ্রোহ।
স্বামীজী শিষ্যকে বললেনঃ “সকলকে গিয়ে বল—‘ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের নিজের ভিতর রয়েছে, একথা বিশ্বাস কর, তাহলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে। ঐকথা সকলকে বল্ এবং সেইসঙ্গে সাদা কথায় বিজ্ঞান, দর্শন, ভূগোল ও ইতিহাসের মূল কথাগুলি mass–এর ভিতর ছড়িয়ে দে। আমি অবিবাহিত যুবকদের নিয়ে একটি Centre তৈয়ার করব—প্রথম তাদের শেখাব, তারপর তাদের দিয়ে এই কাজ করাব, মতলব করেছি।’”
দক্ষিণেশ্বরে মা-ভবতারিণী, ধূপ, ধুনো, আরতি, ধ্যান, প্রাণায়াম। প্রাণপুরুষ ঠাকুর নিত্যধামে। সময় এগিয়ে গেছে পনের বছর। স্বামীজী পাশ্চাত্য কাঁপিয়ে এসেছেন। মেটিরিয়ালিস্টদের কাছে চাইতে যাননি, দিতে গিয়েছিলেন—বেদান্তধর্ম।
“আমাদের দেশে আছে মাত্র এই বেদান্তধর্ম। পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনায় আমাদের এখন আর কিছু নেই বললেই হয়।” স্বামীজী ‘মিরর’ পত্রিকার সম্পাদককে বলছেনঃ “ধর্মের চর্চায় ও বেদান্তধর্মের বহুল প্রচারে এদেশ ও পাশ্চাত্যদেশ—উভয়েরই বিশেষ লাভ। রাজনীতিচর্চা এর তুলনায় আমার কাছে গৌণ উপায় বলে বোধ হয়।”
দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে ঠাকুর বেরিয়ে এসেছেন বিশ্বমঞ্চে। একদিকে ভোগবাদী পাশ্চাত্য, আরেক দিকে দরিদ্র প্রাচ্য। মাঝখানে প্রকৃত সাম্যকার বিবেকানন্দ। ক্লাসকে নয় জাগাতে চাইছেন মাসকে। মঠ তখনো বেলুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মঠ আলমবাজারের ভাড়াবাড়িতে। স্বামীজী কখনো বাগবাজারে, কখনো আলমবাজারে, কখনো কাশীপুরে। যখন যেখানে, সেইখানেই ভক্ত ও বিদ্বজ্জন সমাগম। কেউ আসছেন বিশ্বমানবকে চোখের দেখা দেখতে। কেউ আসছেন প্রাণের টানে পথের সন্ধান পেতে। যিনি যেভাবেই আসুন, বৈদান্তিক, কর্মযোগী, তেজোময় স্বামীজীকে ঘিরে দক্ষিণেশ্বরের মতো শান্ত, একান্ত লীলা জমছে না। জমতে পারে না। কারণ, “বহুরূপে সম্মুখে তোমা ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর।”