মেষ: পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত ... বিশদ
এর ঠিক ন’বছর আগের কথা। লোকসভায় দাঁড়িয়ে নেহরু বলেছিলেন, আমাদের ম্যাপ দেখায় যে, ম্যাকমোহন লাইন আমাদের দেশের সীমান্ত। মানচিত্র থাকুক বা না থাকুক, এই সত্যিটা কখনও বদলাবে না... ওই সীমান্ত পেরিয়ে কাউকে আমরা প্রবেশ করতে দেব না। ১৯৫০ সাল... ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওই বছর আমাদের সংবিধান কার্যকর হয়েছিল। বছরটা চীনের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ... রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব। আন্তর্জাতিক মহলে একঘরে হয়ে যাওয়া। ওটাই ছিল ভারতের জমি শক্ত করার সঠিক সময়। ওই বছর দুয়েকের মধ্যে অনেক কিছুই কিন্তু করেছিলেন নেহরু... ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে ভুটানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি, আর ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে সিকিমের সঙ্গে। চীনের বিষয়ে তিনি ভাবেননি তা কিন্তু নয়! চীন সীমান্তের যাবতীয় গোপন খবর খুঁড়ে বের করে আনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোকে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিম্মতসিংজির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনও করেছিলেন। যার কাজ ছিল চীন সীমান্তকে মজবুত করার লক্ষ্যে যাবতীয় পরামর্শ দেওয়া। কিন্তু এর বেশি নয়। সেনাপ্রধান কারিয়াপ্পাকে ডেকে নেহরু প্রশ্ন করেছিলেন, তিব্বতে চীনের দখলদারি রুখতে ভারতের কি সেনা পাঠানো উচিত? সায় দেননি সেনাপ্রধান। সামরিক দিক থেকে চীন তখনও কিন্তু ভারতের কাছে বড় হুমকি ছিল না। অর্থাৎ পাঁচের দশকে। আর ১৯৬০ সালে এসে পরিস্থিতি ঘুরে গিয়েছিল ৩৬০ ডিগ্রি। সামরিক চীন তখন বহু বড় বড় দেশের কাছেই থ্রেট। বদলায়নি শুধু শিকড়টা... ম্যাকমোহন লাইন। ব্রিটিশ কলমের খোঁচায়
তৈরি মানচিত্র কখনও মানেনি চীন। পিকিং থেকে বেজিং... কমিউনিস্ট শাসন আটকেছিল তাদেরই ‘ঐতিহ্যে’র ম্যাপে। যা বদলায়নি আজও। গলওয়ান তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
সীমান্ত আগ্রাসন। এটাই চীনের সাম্প্রতিক কাজকর্মের ট্যাগলাইন। গোটা বিশ্ব যা নিয়ে তোলপাড়। দক্ষিণ চীন সাগর, হংকং, তাইওয়ানের মতো ইস্যু নিয়ে সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচুর শব্দ খরচ হয়েছে। আর তার সবটাই ছাপিয়ে গিয়েছে গলওয়ানে লালফৌজ পা রাখায়। ভারত সেনা বাড়িয়েছে, মিরাজ-সুখোই চক্কর দিয়েছে আকাশসীমায়, লাগাতার হুমকি-পাল্টা হুঁশিয়ারির কূটনীতি জমে উঠেছে। আর অবশেষে গলওয়ানের বিতর্কিত উপত্যকা থেকে সেনা সরাচ্ছে চীন। কী বলা যায় একে? ভারতের নৈতিক জয়? সেনাবাহিনীর জয়? নাকি প্রধানমন্ত্রীর?
নজর করার মতো বিষয় হল, সীমান্ত-সংঘাতের এই গোটা সময়সীমায় চীনের নামটুকু একবারও উচ্চারণ করেননি নরেন্দ্র মোদি। ‘আমাদের জমিতে কেউ পা দিলে ছেড়ে কথা বলব না...’ জাতীয় কথা অনেক বলেছেন তিনি। কিন্তু সবটাই নাম উহ্য রেখে। দেশবাসী অপেক্ষা করেছে, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে প্রধানমন্ত্রী কিছু নিশ্চয়ই বলবেন। তা হয়নি। ‘সুস্থ থাকুন, সতর্ক থাকুন’-এর মধ্যেই তাঁর বক্তব্য সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদি। চমক না দিলে কোথায় একটা খামতি থেকে যায়। আচমকা এমন কিছু বলবেন বা করবেন, যা দেশবাসীর মধ্যে হুলস্থূল ফেলে দেবে। ভাষণ শেষ হওয়া মাত্র তাঁরা ছুটবেন এটিএমে লাইন দিতে... আবার কখনও মুদির দোকানে মোমবাতি কিনতে। চীন নিয়ে এত কাণ্ড হচ্ছে, আর তিনি কোনও চমক দেবেন না? এ হতে পারে না। আর তাই আচমকা বাতিল হয়ে গেল প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের লাদাখ সফর। আর তারপর? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাদাখে। সেনা-জওয়ানদের মাঝে। আচমকা।
তিনি ভাষণ দিলেন। সেনাবাহিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। এবং তারপরও চীনের নাম উচ্চারণ করলেন না। বিরোধীরা লাগাতার বলে এসেছে, লাদাখ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন? তারই জবাব দিলেন মোদি। একেবারে নিজস্ব স্টাইলে। ঝকঝকে নীল আকাশের নীচে চপার থেকে নামলেন তিনি। পাশে সেনাপ্রধান নারাভানে, আর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত। প্রত্যেকটা মিডিয়ার পছন্দসই ফ্রেম। অমিতাভ বচ্চন এবং তারপর খান জমানাতেও বলিউডে একটা কথা বেশ প্রচলিত ছিল—অ্যাপিয়ারেন্স। হিরো যখন বড় পর্দায় অ্যাপিয়ার করবেন, সেই দৃশ্য। আর তা এমন চমকদার হবে যে, হলজোড়া দর্শক সিটি মারবে, পয়সা ছুঁড়বে। ছবির টিকিটের দাম উঠে যাবে ওতেই। নরেন্দ্র মোদি তেমনই অ্যাপিয়ারেন্সে বিশ্বাসী... ‘ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো’ টাইপ। নজর ঘুরিয়ে দেবেন তিনি ‘দর্শকদের’। ইস্যু থেকে, সঙ্কট থেকে, ব্যর্থতা থেকে। করোনা পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি কি? এটাই এখন পর্যন্ত পরিষ্কার হয়নি। আচমকা লকডাউন ঘোষণার নেপথ্যে কারণ কী ছিল? সংক্রমণ আটকে দেওয়া। যা হয়নি। প্রথমে মোদিজি বললেন, যে যেখানে আছেন, সেখানেই থেকে যান। তারপর তিনিই স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজেদের রাজ্যে ফেরালেন। তাঁরাও ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। কারণ, যে রাজ্যে বসবাস করে এতদিন তাঁরা পেটের ভাত জোগাড় করেছিলেন, তা মিলছে না। এই দায়িত্ব কার? কেন্দ্রের নয়? উত্তর মিলল না। সব দায় চেপে গেল সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির ঘাড়ে। বিদেশ থেকে ভারতীয়দের দেশে ফিরিয়ে আনলেন। সঙ্গে করোনা ভাইরাস। একেবারে ফ্রি... ফ্রি... ফ্রি...। এমন লকডাউনের তাহলে অর্থ কী? এটা কি ব্যর্থতা নয়?
বললেন, জনধন অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে যাবে। কত টাকা? ৫০০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরও হপ্তাখানেকের বাজার করতে ৫০০ টাকা খতম। আর মধ্যবিত্তরা? তাঁদের কারও চাকরি গিয়েছে, কারও বা বেতন কাটা যাচ্ছে। বাজার অর্থনীতি কিন্তু তাঁদের অ্যাকাউন্ট দেখে চলছে না! এই করদাতাদের জন্য মোদি কী করলেন? বলবেন প্যাকেজ। নির্মলা সীতারামন চারদিন ধরে ঋণনির্ভর একটি প্যাকেজ ঘোষণা করলেন। যাঁদের দু’বেলা খাবার জুটছে না, তাঁরা ঋণ নিলে ইএমআই দেবেন কী করে? তার কোনও দিশা নেই। মধ্যবিত্তরা অ্যাকাউন্টে কিন্তু কিছু পেলেন না! যা খুব অসম্ভব ছিল না। যে পরিমাণ ট্যাক্স একজন মধ্যবিত্ত এক বছরে দিচ্ছেন, তার একটা ভাগ তাঁর অ্যাকাউন্টে ফিরিয়ে দেওয়াই যেত। যা সরকার করেনি। তার উপর এখন নেগেটিভের লক্ষ্যে ছুটছে অর্থনীতি। এটা কি ব্যর্থতা নয়?
আনলক ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সব সেক্টরে কাজ শুরু হয়েছে বা হচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। স্বাস্থ্য পরিষেবা কিন্তু সেই তিমিরে। গত তিন মাস দেশজুড়ে সব বন্ধ থাকার সময় এদিকে কি আলাদা করে কেন্দ্রীয় সরকার নজর দিয়েছে? না দেয়নি। তাই আক্রান্তেরও অনেক সময় জায়গা হচ্ছে না হাসপাতালে। যাঁরা ভর্তি হচ্ছেন, চিকিৎসার খরচের ঠেলায় সঞ্চয়ের শেষটুকু তাঁদের বেরিয়ে যাচ্ছে। করোনা বিদায় নিলে তাঁদের অনেকেই হয়তো রাস্তায় এসে দাঁড়াবেন। নাগরিকদের ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। এটা কি ব্যর্থতা নয়?
তালিকা দীর্ঘ। আর উপায়? যুদ্ধ জিগির। নজর ঘুরেছে মানুষের। ব্যর্থতা আর চর্চার বিষয় নয়। আলোচনায় আজ চীন। অর্থাৎ, মোদি সরকার সফল। যুদ্ধ কি সত্যিই হবে? বা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে? দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর। ভুল স্ট্যাটেজি কেউ নেবে না। দু’পক্ষই কোমর বাঁধবে, হাঁকডাক করবে। তারপর সমঝোতায় আসবে। লাদাখ দখলের ক্ষেত্রে কিন্তু চীন অনেকটাই এগিয়ে ছিল। কারণ, গত বছর লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করেছে ভারত। সীমান্তবর্তী এমন একটা স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন কেন দেশের রাজ্য থাকবে না? এটাও কি সঠিক নীতি? আর এক তিব্বত হতেও পারত লাদাখ। হয়নি। তবে ভবিষ্যতেও যে হবে না, তার গ্যারান্টি কী? তিব্বতে চীনের আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিল নেহরুর ভারত। আমেরিকা, ব্রিটেন... পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। ছয়ের দশকের চীনের কাছে মাথা নিচু করতে হয়েছিল নয়াদিল্লিকে। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বহু ভালো এবং উন্নয়নমূলক কাজ করা সত্ত্বেও এই কালো দাগ তাঁর গা থেকে মেলায়নি। সেই কলঙ্ক আজও নেহরুকে বহন করতে হয়। এরপরও সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়নি। এই ইস্যুতে মধ্যস্থতায় আসতে পারেনি চীন এবং ভারত। নরেন্দ্র মোদিও কিন্তু সেই পথে এগচ্ছেন না। অর্থনীতি, লকডাউন, আনলক... সব নীতিতেই প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে। কিন্তু চীন নীতি?