মেষ: পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত ... বিশদ
সেদিন সকালে তিনি তাঁর সব স্যুট ওয়ার্ড্রোব থেকে বের করে একটা একটা করে পরে দেখছিলেন। আবার খুলে রেখে দিচ্ছিলেন। সেই সব স্যুট পরে ঘরের মধ্যে বুক চিতিয়ে এদিক থেকে ওদিকে হাঁটছিলেন আর আড়চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে ব্যক্তিত্ব মাপছিলেন। মনে মনে বলছিলেন, ‘ওঠো, জাগো, নিজের প্রাপ্য ভাবমূর্তি আবার গড়ে তোল। যে ভাবমূর্তি তোমার ছিল, অথচ আইসক্রিমের মতো গলে গিয়েছে, আসলে তা তোমার ছিল না। তুমি যা হারিয়েছো, তাও তোমার ছিল না। তুমি যা পেয়েছো, তাও তোমার ছিল না। তুমি যেসব অমৃৎবাণী দিয়েছ, তা কখনো মেনে চলার চেষ্টা করনি। আসলে সবই তোমার দানপ্রাপ্ত! দেশের মানুষই তোমাকে এসব দান করেছে। তুমি একটা খড়ের কাঠামো মাত্র। তার উপরে মাটি, রং দিয়ে তোমাকে সুন্দর করে গড়ে তুলেছে তোমার দেশের মানুষ। তোমার ভাবমূর্তির উপর গর্জন তেল মেরে তাকে চকচকে করে তুলেছে মানুষই। তোমার ব্যর্থতার উপরেই আবার গড়ে তোল নিজের সাফল্য, ওঠো, জাগো।’
চমকে উঠলেন হবু রাজা। এসব কী ভাবছেন তিনি? এটা কি তিনি, নাকি তাঁর ভিতরের বিবেকবাণী? একটু হেসে তিনি আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বিবেকবোধ সব সময় দুষ্টুই হয়। ভুলভাল ভাবনা মনের মধ্যে নিয়ে আসে। সাদাকালোর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বুঝতেই পারি না, কোন আমিটা ভালো, আর কোন আমিটা মন্দ!’
ওদিকে ততক্ষণে মোবাইল বেজে উঠেছে। দেখলেন গবু মন্ত্রীর ফোন। ফোনটা ধরতেই গবু বললেন, ‘মহারাজ, একটু দেখা করতে চাই। জরুরি ব্যাপার।’
হবু বললেন, ‘তোমার জরুরি সেন্স সম্পর্কে আমার ভালোই আইডিয়া আছে। কোনটা যে প্রকৃত জরুরি, তা এখনও ভালো করে বুঝতে পারলে না। ঠিক আছে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে এসো। তারপরে আমি যোগাসনে বসব।’
ফোনটা রেখে ‘হবুকোট’ গায়ে চড়াতে চড়াতে রাজা গুনগুন করে গান ধরলেন, ‘সীমান্তে ওই অ-চিন পাখি ক্যামনে ঢুকে যায়, দ্যাশের মানুষ তাই নিয়ে গো আমার মাথা খায়, ক্যামনে ঢুকে যায়...!’
আয়নার দিকে তাকিয়ে হবু রাজা ধমক দিলেন, ‘যা পালা, একদম আমাদের সীমানা পেরিয়ে ঢুকবি না, খুব মার মারব। খুব বেড়ে গেছিস না! তোদের জন্য আমাকে কথা শুনতে হচ্ছে, জানিস।’ তারপরেই আবার গেয়ে উঠলেন, ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল?’
কিছুক্ষণ পরেই গবু হাজির। খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছিল তাঁকে। রক্ষীদের দ্বারা শরীর পরিশোধনের পর পিপিই পরে এলেন হবুর কাছে। প্রণাম করতে যেতেই হবু হাঁই হাঁই করে উঠলেন। ‘একদম কাছে এগবে না। আর ঘটা করে প্রণাম করার আছেটা কী? যা বলতে এসেছ, তা বলে তাড়াতাড়ি বিদায় নাও।’
গবু দূর থেকে প্রণত হয়ে হবুর পায়ের কাছে একটি পদ্ম নিবেদন করে বললেন, ‘আজ্ঞে, গুরুপূর্ণিমা। তাই প্রণাম নিবেদন করতে এলাম মহারাজ। আপনিই তো আমার গুরু।’
হবু বললেন, ‘এইটা তোমার জরুরি ব্যাপার? আমি তখনই জানতাম...।’ হাত তুলে হবু রাজাকে থামিয়ে একটু দূরত্ব রেখে গবু বসলেন। তারপর বললেন, ‘দু’টি ব্যাপার মহারাজ। একটি ভালো, অপরটি মন্দ। কোনটি আগে বলব?’
হবু বললেন, ‘আগে আনন্দের সংবাদটাই বল। মনটা আগে একটু ভালো হয়ে যাক।’
গবু বললেন, ‘আমরা বিশ্ব মহামারী চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ কাপ জয় নিশ্চিত করেছি মহারাজ। তৃতীয় স্থান দখল করে এখন এগিয়ে চলেছি।’
হবু ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘এটা তোমার একটা জরুরি খবর হল? তুমি জানো না আমার কী টার্গেট?’ তারপর টেবিলের উপর জোরে জোরে চাপড় মেরে হবু বললেন, ‘আই উইল গো টু দি টপ, দি টপ, দি টপ। ওই বিশ্ব মহামারী চ্যাম্পিয়নশিপে সোনার কাপ জিতবে আমার দেশ। আমি ব্যক্তিগত প্রাইজ হিসাবে পাব গোল্ডেন ভাইরাস মেডেল।’
গবু হাততালি দিয়ে বললেন, ‘সাধু, সাধু, এই স্পিরিটটাই আপনার কাছ থেকে শেখার মতো। আপনি ভবিষ্যতের অনেক কিছু দেখতে পান। আমি জানি, আপনি সব বিভাগেই এই দেশকে এক নম্বরে নিয়ে যাবেন।’
হবু বললেন, ‘এবার মন্দ খবরটি বল।’
গবু বললেন, ‘মহারাজ, সীমান্ত শত্রুরা বড্ড বেশি ঘোঁট পাকাচ্ছে। সীমান্তের দেশগুলো হাত মিলিয়ে আমাদের ক্ষতি করতে চাইছে।’
হবু ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না।’
গবু বললেন, ‘সীমান্তের খবর হল, ওরা রোজ একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে। কয়েকটা দেশ নদীর জল বন্ধ করে দিচ্ছে শুনছি।’
হবু বললেন, ‘ওসব ছাড়ো, আমি আন্তর্জাতিক ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নেব। সীমান্তের থেকে এখন আমার কাছে বড় যুদ্ধ অঙ্গরাজ্য জয়। যেসব অঙ্গরাজ্যে আমাদের অধিকার কায়েম হয়নি, সেখানে আমাদের বিজয় পতাকা ওড়াতেই হবে। সেটাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবো। সীমান্তে আমি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করতে পারি। সেটা অনেক সহজ। কিন্তু আমার কাছে এখন বড় পরীক্ষা অভ্যন্তরীণ পলিটিক্যাল স্ট্রাইক। তার জন্য স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে। আসন্ন এই অপারেশনের নাম দিয়েছি, অপারেশন হাইজ্যাক।’
গবু বললেন, ‘অসাধারণ। আপনার প্রতিটি কর্মের পিছনেই থাকে একটি করে মহৎ উদ্দেশ্য। আপনার এমন ভূয়োদর্শন দেখে অবাক হয়ে যাই। আপনার ইনটিউশনের জোরেই আপনি নিজেই আজ একটা ইনস্টিটিউশন।’
হবু বললেন, ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে সতত ফলেষু আশান্বিতম্! এই মহৎ বাণীকে সামনে রেখেই আমার সম্মুখপানে অগ্রগতি।’
গবু বললেন, ‘মহারাজ এই শ্লোক কার লেখা? গীতায় শ্রীকৃষ্ণের শ্লোকটা তো অন্যরকম।’
হবু বললেন, ‘ঠিক ধরেছো গবু। ওখানে বলা আছে, মা ফলেষু কদাচন। অর্থাৎ কাজ কর, ফলের আশা কোরো না। ওই শ্লোক অচল। তাই আমি নিজে এই শ্লোক তৈরি করেছি। কেন ফলের আশা করব না? ছাত্র পড়াশোনা করে ভালো ফলের আশায়, ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করেন, তাকে সারিয়ে তোলার আশায়, মানুষ কাজ করে বেতনের আশায়, রাজনীতিকরা দেশসেবা করেন ক্ষমতার আশায়। এমনকী মা-ও সন্তানকে দুগ্ধপান করিয়ে বড় করে তোলে, যাতে সে বড় হয়ে তাদের দেখে, সেই আশায়। আশায় বাঁচে চাষা। যদিও জানি, আশা হল কুহকিনী, কিন্তু আশা ছাড়া জীবন সর্বনাশা। তাহলে কেন আমি ফলের আশা করব না? এই যে আমি দেশশাসন করছি, জনসেবা করছি, সেটা তো পরের নির্বাচনে ফের জিতে ক্ষমতায় আসার জন্যই। এই যে তুমি আমাকে এত তৈলমর্দন কর, সেও তো যাতে তোমার মন্ত্রিপদটা থাকে, সেই আশায়। নাহলে দেশসেবা কিংবা জনসেবার অত নির্মোহ বাতিক রাজনীতিকদের থাকে না। এটা দেশের মানুষ বোঝে না।’
গবু বললেন, ‘আপনার রাজনৈতিক দর্শন দেখে আমি হতবাক মহারাজ। শ্রীকৃষ্ণ যেটা বুঝতে পারেননি, সেটা আপনি বুঝেছেন। একমাত্র আপনিই এই শ্লোক রচনা করতে পারেন। কারণ আপনি নিজেই একজন অবতার। গরুড় পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি, ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতার ছিল। রাম, কুর্ম, বামন, বরাহ, কল্কি ইত্যাদি। আপনি হলে কলিযুগের একাদশতম অবতার। এতদিন বিষ্ণুর টিমে প্লেয়ার কম ছিল। এবার এই এগারোজনকে নিয়ে বিষ্ণুদেব ফুটবল বা ক্রিকেট টিম গড়তে পারে। খুব স্ট্রং টিম হবে। ত্রিলোক কাঁপিয়ে দেবে এই টিম।’
হবু বললেন, ‘আগে মর্ত্যলোক কাঁপাই। এখানে অনেক কাজ জমে আছে। তোমার প্রশংসার ভাবসাগরে ভাসার আগে এখন ভাবমূর্তি সাফাই করতে হবে। তুমি এখন যাও। আমার কাজ আছে।’
গবু বললেন, ‘যাই মহারাজ। গুরুপূর্ণিমায় আপনার একটু বন্দনা করে যাই। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি দেশাঃ/অভ্যুত্থানম দুরাত্মাস্য, অধর্ম সৃজম্যহম / পরিত্রাণায় অনুগামী, বিনাশায় চ বিপক্ষম / মূর্তিসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’