মেষ: পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত ... বিশদ
“যা নাই—তা হতে কিছু হয় না প্রকাশ,
থাকে যদি—কিছুতেই নাই তার নাশ।”
তিনি ছিলেন। তিনি আছেন। তিনি সত্য অবিনাশী। ঠাকুরের সার কথা ছিল, ঈশ্বরের জন্যে ব্যাকুলতা। “এই ব্যাকুলতা। যে পথেই যাও, হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, শাক্ত, ব্রহ্মজ্ঞানী—যে পথেই যাও, ঐ ব্যাকুলতা নিয়েই কথা। তিনি তো অন্তর্যামী, ভুল পথে গিয়ে পড়লেও দোষ নাই—যদি ব্যাকুলতা থাকে। তিনি আবার ভাল পথে তুলে লন। আর সব পথেইভুল আছে। সব্বাই মনে করে আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে, কিন্তু কারো ঘড়ি ঠিক যায় না। তা বলে কারু কাজ আটকায় না। ব্যাকুলতা থাকলে সাধুসঙ্গ জুটে যায়, সাধুসঙ্গে নিজের ঘড়ি অনেকটা ঠিক করে লওয়া যায়।”
ঠাকুর বড় আয়োজন করে দেহধারণ করেছিলেন। ঠাকুরের কথায়ঃ “মা, আমি কি যেতে পারি! গেলে কার সঙ্গে কথা কব? মা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী শুদ্ধ ভক্ত না পেলে কেমন করে পৃথিবীতে থাকব!”
একান্তে দক্ষিণেশ্বরে নরেন্দ্রের সঙ্গে ঠাকুরের এইসব কথা হয়েছিল। এরপর শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে বলছেনঃ “তুই রাত্রে এসে আমায় তুললি, আর আমায় বললি, ‘আমি এসেছি।’”
শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামীজীকে তকমা দিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীমাকে একদিন একখানা কাগজে লিখে বলেছিলেনঃ “নরেন শিক্ষা দেবে।”
নরেন্দ্র পরে শুনে ঠাকুরকে বলেছিলেনঃ “আমি ওসব পারব না।”
ঠাকুর বলেছিলেনঃ “তোর হাড় করবে।”
তিরোধানের পর সন্তানেরা যে একটু বিপদে পড়বে ঠাকুর মানসচক্ষে তা দেখেছিলেন। দেখে শ্রীমকে একদিন বলেছিলেনঃ “তোমরা রাস্তায় কেঁদে কেঁদে বেড়াবে, তাই শরীর ত্যাগ করতে একটু কষ্ট হচ্ছে।”
তিরোধানের অব্যবহিত পরের অবস্থা শ্রীম লিখে গেছেন। নরেন্দ্রনাথ তখনও বিশ্বজয়ী হননি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলছেন। গুরুভ্রাতাদের দায়িত্ব নিয়ে কখনো বরানগর মঠে, কখনো কলকাতায়। অর্থকষ্ট, নানা সংশয়। ঠাকুরের অনন্ত পরীক্ষা চলেছে। “তুই পারবি না, তোর হাড় পারবে।”
“যোগ-ভোগ, গার্হস্থ্য-সন্ন্যাস, জপ-তপ, ধন-উপার্জন,
ব্রত ত্যাগ তপস্যা কঠোর, সব মর্ম দেখেছি এবার;
জেনেছি সুখের নাহি লেশ, শরীরধারণ বিড়ম্বন;
যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিহ নিশ্চয়!”
শ্রীম লিখছেনঃ “দু-তিন জনের ফিরিয়া যাইবার বাড়ি ছিল না। সুরেন্দ্র তাঁহাদের বলিলেন, ‘ভাই তোমরা আর কোথা যাবে; একটা বাসা করা যাক। তোমরাও থাকবে আর আমাদেরও জুড়াবার একটা স্থান চাই। তা নাহলে সংসারে এরকম করে রাতদিন কেমন করে থাকব। সেইখানে তোমরা গিয়ে থাক। আমি কাশীপুরের বাগানে ঠাকুরের সেবার জন্য যৎকিঞ্চিৎ দিতাম। এক্ষণে তাহাতে বাসা খরচা চলিবে।’ সুরেন্দ্র প্রথম প্রথম দুই-এক মাস টাকা ত্রিশ করে দিতেন। ক্রমে যেমন মঠে অন্যান্য ভাইরা যোগ দিতে লাগলেন, পঞ্চাশ, ষাট করিয়া দিতে লাগিলেন। শেষে ১০০ টাকা পর্যন্ত দিতেন। বরানগরে যে বাড়ি লওয়া হইল, তাহার ভাড়া ও ট্যাক্স ১১ টাকা। পাচক ব্রাহ্মণের মাহিনা ৬ টাকা আর বাকি ডালভাতের খরচ।”
শ্রীরামকৃষ্ণ অর্ডারের এই শুরু। শ্রীম লিখছেনঃ “ধন্য সুরেন্দ্র! এই প্রথম মঠ তোমারি হাতে গড়া। তোমার সাধু ইচ্ছায় এই আশ্রম হইল। তোমাকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার মূলমন্ত্র কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ মূর্তিমান করিলেন। কৌমর-বৈরাগ্যবান শুদ্ধাত্মা নরেন্দ্রাদি ভক্তের দ্বারা আবার সনাতন হিন্দুধর্মকে জীবের সম্মুখে প্রকাশ করিলেন।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরমপদকমলে’