সিবিআই, আইবির মতো আরও একটি কেন্দ্রীয় এজেন্সি গুরুতর অভিযোগের কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী যেকোনও ধরনের মাদক সেবন, সংরক্ষণ ও পাচার করা বেআইনি কাজ বলে গণ্য হয়। মাদক নিষিদ্ধ নেশার দ্রব্য। অতএব এমন এক নিষিদ্ধ দ্রব্য নিয়ে বেআইনি কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা বা থাকার চেষ্টার বিষয়টি দেখার জন্য রয়েছে অন্যতম কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরো, সংক্ষেপে এনসিবি। বলিউডের সুপারস্টার শাহরুখ খানের পুত্র আরিয়ানকে মাদক কাণ্ডে গ্রেপ্তার করা নিয়ে সেই এনসিবির বিরুদ্ধেই গেরুয়া শিবিরের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার অভিযোগ উঠেছে। এখানেই শেষ নয়। আরিয়ান মামলার এক সাক্ষীর সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়া হলফনামার ভিত্তিতে এনসিবির এক কর্তার বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। সন্দেহ নেই, এই জোড়া সাঁড়াশি আক্রমণের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ফের নিজেদের ইচ্ছায় মোদি-শাহরা ব্যবহার করছেন কি না সেই সঙ্গত প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে। মাদক নিয়ে রহস্য উপন্যাসের মতো বহু গল্প ছড়াচ্ছে। মাদক এক মহার্ঘ দ্রব্য, যার নামে কোটি কোটি টাকা উড়ছে বাজারে। নিষিদ্ধ মাদকের আকর্ষণ তীব্র। মাদকের মৌতাতে বুঁদ করে মোটা টাকা উপার্জনের এই ব্যবসায় জড়িত বহু রথী-মহারথী। কেউ কেউ এও মনে করেন, মাদক কারবারের সঙ্গে বলিউডের কারও কারও সম্পর্ক অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর মতো। সেখানে হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো রাত-কাহিনির ওঠানামা। এমনই এক নাটকের মতো টানটান উত্তেজনাকর গল্পের হাত ধরে কিছুদিন আগে জেলের ঘানি টানতে হয়েছিল অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীকে। বলিউডের উঠতি নায়ক সুশান্ত সিং রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় অভিনেতাকে মাদক খাওয়ানোর অভিযোগেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রিয়া। এখন অবশ্য তিনি জামিনে মুক্ত, এবার এনসিবির জালে উঠেছেন বলিউড বাদশার বছর তেইশের তরুণ তুর্কি পুত্র। মাদক সেবন করে প্রমোদতরীতে বন্ধুবেষ্টিত হয়ে ফুর্তির নেশায় নাকি মেতেছিলেন আরিয়ান—এনসিবির অভিযোগ তেমনই। এই নিয়ে মামলা চলছে। আরিয়ানের জামিনের আবেদনও একাধিকবার খারিজ হয়েছে। মামলা মামলার মতো নিশ্চয়ই চলবে। সন্দেহ নেই, অভিযোগ গুরুতর। এই অভিযোগ প্রমাণ হলে আরও একটি চর্চিত বিষয় ফের সামনে আসবে, কীভাবে বড়লোক ঘরের এক শ্রেণির তরুণ মাদকের নেশা ও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে।
এ পর্যন্ত কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু আরিয়ান কাণ্ডে এনসিবির কাজকর্ম ও তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। শাহরুখ খান বা তাঁর পরিবার সক্রিয়ভাবে কোনও রাজনীতি করেন না। কিন্তু গান্ধী পরিবারের সঙ্গে যে তাঁর ভালো সম্পর্ক তা সকলের জানা। উপরন্তু শাহরুখ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রশ্ন উঠছে, দেশের বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা, করোনা নিয়ে ল্যাজেগোবরে অবস্থা, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ, কৃষকদের রাস্তায় পড়ে থাকার মতো ইস্যু থেকে চোখ ঘোরাতেই কি শাহরুখ পুত্রের বিষয়কে এভাবে সামনে আনা হল? এমন প্রশ্ন ওঠার পিছনে বেশ কিছু যুক্তিও আছে। কারণ মোদি সরকারের রিপোর্ট কার্ড বলছে, গোটা দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের মুখ বন্ধ করা, বিরুদ্ধ মতাবলম্বী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ফাঁসিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ফোনে আড়িপাতা, আয়কর দপ্তরকে লেলিয়ে দেওয়া, সিবিআই, আইবির মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে হেনস্তা করার মতো বহু ঘটনার সাক্ষী রয়েছে দেশবাসী। এবারও হয়তো বা আরিয়ান কাণ্ডকে সামনে এনে বিরোধীদের জ্বলন্ত ইস্যুগুলো ধামাচাপা দিতে চাইছে খোদ সরকার। এনসিবির বিরুদ্ধে শাসক দলের হয়ে কাজ করার অভিযোগে নতুন মাত্রা জুগিয়েছে ঘুষ কাণ্ডের অভিযোগটি। এই কেসের প্রধান অফিসার তথা এনসিবির এক কর্তার বিরুদ্ধে শাহরুখ পুত্রকে ছাড়াতে ২৫ কোটি টাকা নজরানা চাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন মামলার অন্যতম এক সাক্ষী। অরিয়ানকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে ওই কর্তা পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন। ওই দুঁদে অফিসারের নানা কীর্তির কথা ক্রমশ সামনে আসছে। এই নিয়ে যথাযথ তদন্ত ও তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। রং না-দেখে আইন মেনে যাঁদের কাজ করার কথা তাঁদের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ উঠলে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। আশঙ্কা দেখা দেয় কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে পড়বে না তো?
তাই আরিয়ান কাণ্ডে নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। সেই সঙ্গে তোলাবাজি বা ঘুষ প্রসঙ্গে যেসব গুরুতর অভিযোগ উঠছে তারও তদন্তের প্রয়োজন আছে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা অটুট রাখার স্বার্থেই তা ভীষণ জরুরি। তারকা-পুত্রই হোক বা এনসিবি অফিসার অথবা সাধারণ মানুষ, আইনের চোখে সকলেই সমান। ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার প্রত্যেকের। মাদক বা ঘুষ কাণ্ড—প্রকৃত সত্য দুটিতেই প্রকাশ পাক। না-হলে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে সংশয় দানা বাঁধবে।