কর্মের প্রসার ও উন্নতি হবে। ব্যবসায়ীদের দিনটি অনুকূল। অর্থকড়ি প্রাপ্তি যোগ শুভ। অর্থ সঞ্চয় বাড়বে ... বিশদ
সাধারণ মানুষ বাসে চড়ে... ক’জনের নিজের গাড়ি আছে? সবাই দেখতে দেখতে এই দামের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।—নারায়ণ প্রসাদ (বিহারের মন্ত্রী)
কোভিডে ত্রাণের জন্য অনেক খরচ হচ্ছে। তেলের শুল্কের টাকা সামাজিক প্রকল্পের জন্য বাঁচাচ্ছে কেন্দ্র।—ধর্মেন্দ্র প্রধান (প্রাক্তন পেট্রলিয়ামমন্ত্রী)
পেট্রল অনেক আগেই শতরান সম্পূর্ণ করেছিল। এবার ষোলো কলা পূর্ণ করেছে ডিজেল। দাম বাড়ছে... প্রত্যেকটা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের। নাভিশ্বাস উঠছে মানুষের। আর বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা যুক্তি সাজাচ্ছেন। তাও একেবারে পোলাপানের মতো যুক্তি। তা সে সাইকেলে চেপে বাজারে যাওয়াই হোক, কিংবা গাড়ির বদলে বাসে চড়া... তাতে জ্বালানির দাম কমছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের কষ্টও লাঘব হচ্ছে না। নেতাদের কথাতেই আসা যাক... প্রথমেই প্রদ্যুম্ন সিং তোমার। সাহেব, আপনি শেষ কবে বাজারে গিয়েছিলেন বলতে পারেন? জানেন, কলকাতার বাজারে গত সপ্তাহেও পটল ছিল ৬০-৬৫ টাকা কেজি। আর এ সপ্তাহে সেটাই ৯০ টাকা! বিনস ছিল ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। তার দাম এখন প্রায় ২৫০ টাকা কেজি। ক্যাপসিকামেরও এক দশা! তা ছাড়া টম্যাটো ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা হয়েছে, গাজরও এখন ৮০ থেকে ১০০। অথচ গত সপ্তাহেই বাজারে গিয়ে ৫০ টাকা দেখেছিলাম। সাইকেল চেপে বাজারে গিয়ে না
হয় তেলের টাকা বাঁচানো গেল। কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি
টাকা খরচ করে কিনতে হবে তো ওই সব্জিই!
তাও সবাইকে... কত শতাংশ দেশবাসীর গাড়ি
বা বাইক-স্কুটি চড়ার ক্ষমতা আছে জানেন? ১ শতাংশ? দু’শতাংশ? এর বেশি নয়। বাকিরা হেঁটেই বাজারে যান... দর করেন... পকেট হাতড়ে দেখেন... আর তারপর ভাবেন, বাকি মাস চলবে কীভাবে!
কেন বেড়েছে দাম? জিজ্ঞেস করলেই খেঁকিয়ে
উঠছেন সব্জিওয়ালা। বলছেন, ‘মাল আনানোর
খরচ কত বেড়েছে জানেন? আগে এক লরি মাল
কত টাকায় আসত... আর এখন কত টাকা লাগে, খোঁজ নিয়ে দেখুন।’
সব্জিওয়ালা ভুল বলেননি। এই ক’বছর আগেই তো ডিজেল ছিল ৫০ টাকা লিটার। তেলের দাম বেড়েছে। লরিওয়ালাও ভাড়া বাড়িয়েছে। তাঁকেও তো সংসার চালাতে হবে! কেউ তো আর লোকসান করে ব্যবসা করবে না! সব্জিওয়ালা না, লরিওয়ালাও না। ডিজেলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়ছে চড়চড়িয়ে। তাই দাম বাড়ছে পণ্যের। আর আপনি গাড়ির তেল বাঁচানোর কথা বলছেন? নারায়ণ প্রসাদ মশাই তো আবার আশ্বাস দিয়েছেন, সবাই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। কীসে অভ্যস্ত হয়ে যাবে? পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের দামে? নাকি রোজকার এই সংসার-যন্ত্রণায়? আপনাদের জমানায় মধ্যবিত্ত আজ নিম্নবিত্ত হয়েছে। আর নিম্নবিত্ত নেমে গিয়েছে দারিদ্র্যসীমার নীচে। এটাই তো আপনারা চেয়েছিলেন! সমাজের একটা অংশের হাতে থাকবে টাকা। বাকিরা চুলোয় যাক। আপনাদের আখেরটা গুছিয়ে নেওয়া গেলেই হল। এই তো সেদিন উত্তরপ্রদেশের আর এক বিজেপি-মন্ত্রী উপেন্দ্র তেওয়ারি বললেন, পেট্রল-ডিজেল নাকি দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের কাজেই লাগে না। ঠিক বলেছেন, প্রত্যক্ষভাবে কাজে সত্যিই লাগে না। কিন্তু পরোক্ষে? জ্বালানিই তো নিয়ন্ত্রণ করে দৈনন্দিন অর্থনীতি! বাসে চড়েছেন কখনও? রাস্তায় বেরিয়ে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে... বাসের অপেক্ষায়। কেন বাস নেই? মালিকরা চালাতে পারছে না। দাবি একটাই, ভাড়া বাড়াতে হবে। ডিজেলের দাম যখন ৭০ টাকা ছিল, তখন ন্যূনতম ভাড়া ১০ টাকা। এখন তেল বাস্তবেই অগ্নিমূল্য। তাহলে সেই একই ভাড়ায় বাস কীভাবে চলবে? তেলের খরচ রয়েছে, দেদার টাকা লাগে মেইনটেইনেন্সেও। তারপর রোড পারমিট, পলিউশন, রাস্তায় কেস খাওয়া তো রয়েইছে। আর রয়েছে ড্রাইভার-কন্ডাক্টরের মাইনে। কাজেই বাস চালানোর থেকে বসিয়ে রাখায় লোকসান কম। এবার তাহলে মানুষকে নতুন করে হাঁটা শিখতে হবে... মাইলের পর মাইল। উপায় কী? গত সাত বছরে ক’টা চাকরি দিয়েছেন? প্রতিশ্রুতি তো ছিল গালভরা! বছরেই নাকি কোটি কোটি কর্মসংস্থান? হয়েছে? উত্তর এক কথায়, না হয়নি! বরং কোভিডে আরও বেশি মাটিতে মিশে গিয়েছে সমাজের একটা বড় অংশ। বলছেন, টাকা লাগছে মানুষের কাজে। সত্যিই কি? প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন না? কার কার কাজে লেগেছে সেই প্যাকেজ? কত টাকা রোজগার করেছে এক কামরার ঘরে ১০ জনের সংসার পেতে দিন গুজরান করা গোবিন্দ নস্কর বা শেখ সাহিবুলরা! দেশবাসীর মাথাপিছু আয় কমছে... প্রতিদিন। অভ্যস্ত কি এতেই হতে হবে নেতা মশাই?
আসলে আপনাদের এই দাদাগিরি কেন জানেন? একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভে। জোট সরকার আপনাদের চালাতে হয়নি। শুনতে হয়নি শরিকদের বায়না। তার উপর বিরোধীদের সিংহভাগই কাগুজে বাঘ হয়ে থেকে গিয়েছেন। গত সাত বছরে সংস্কারের নামে একের পর এক তুঘলকি সিদ্ধান্তের সাক্ষী থেকেছে দেশ। আরও কোণঠাসা হয়েছে সাধারণ মানুষ। বিরোধীরা তারপরও মিনমিন করে আওয়াজ তুলেই থেমে গিয়েছে। না তৈরি হয়েছে জনমত, না আন্দোলন। আর আপনাদের সব কিছুতেই লেজ নাড়তে নাড়তে সায় দিয়েছে দেশের অধিকাংশ মিডিয়া। সংবাদ মাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত জনতার সামনে তুলে ধরা, সমালোচনা করা, দুর্নীতিকে বেআব্রু করাটাই আমাদের কাজ। সেই কর্তব্যে আমরাও তো ডাহা ফেল! ভয় পেয়েছি আমরা... প্রতিবাদের সুর চড়ালেই যে হানা দেবে এজেন্সি, ভুয়ো মামলায় ফাঁসবেন সাংবাদিকরা, রাষ্ট্রদ্রোহের বেত আছড়ে পড়বে আমাদের পিঠে। এই একটা ক্ষেত্রে তাই বলতেই হয়, মোদি সরকার সফল। আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরিতে... আর সঙ্গে একটা প্রোপাগান্ডা—বিকল্প বলে কিছু নেই। গল্পের গোরুকে গাছে তুলেই আপনারা থেমে যাচ্ছেন না, তাকে মহাকাশেও পাঠাচ্ছেন। মূর্খের মতো তর্ক করছেন, যুক্তি দিচ্ছেন। একটা লোকও দলে এমন খুঁজে পাওয়া ভার, যার সঙ্গে বিতর্কে অংশ নেওয়া যায়। সব যুক্তিই যে ছেঁদো। আর তাতেও না পারলে গা জোয়ারি। পেট্রলের যা দাম, তার ৫৮ শতাংশই কর। বেশিটাই কেন্দ্রীয় সরকারের পকেটে যায় (প্রায় ৩৩ টাকা), বাকিটা রাজ্যের। ডিজেলের দাম ১০০ টাকা প্রতি লিটার হলে, ৫২ টাকা যায় সরকারের পকেটে। তার উপর রয়েছে কেন্দ্রের সেস (তার ভাগ আবার রাজ্য সরকার পায় না, সবটাই কেন্দ্রীয় কোষাগারে), পরিবহণ খরচ। এই শুল্কে আপনারা ছাড় দেবেন না। কারণ, এটাই যে আপনাদের উপার্জনের সবচেয়ে বড় রাস্তা! লকডাউনের মধ্যে, অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এক্সাইজ ডিউটি বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার আয় করেছে ৩ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। অথচ, গত বছরের অনেকটা সময়ই দেশের রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলেনি... সৌজন্যে লকডাউন। তারপরও এত টাকা আয় কি চাট্টিখানি কথা? জহর রায় বলেছিলেন না, ‘শিল্ড আমি গ্রামের বাইরে যেতে দেব না!’ আপনাদের হাবভাবও ঠিক তেমন, ‘মানুষ মরে মরুক, রোজগার আমি কমাব না!’ আমরা ভোটে জিতব... যেভাবে হোক। নির্বাচনী দামামা বেজে গেলে তখন না হয় মাস দুয়েক পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়বে না। থমকে যাবে রান্নার গ্যাসও। তখন কেন আর নিয়ন্ত্রণ তেল কোম্পানিগুলির হাতে থাকে না? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু নেই। মানে, আপনারা দিতে চান না। দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেন না। কেন? ওই যে বললাম, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভ! আপনারা বরং রাহুল গান্ধী বা কংগ্রেসকে দোষারোপ করুন (ইউপিএ আমলে অবশ্য পেট্রলের উপর কেন্দ্রের কর ছিল ১০ টাকার আশপাশে)। আর ভোটে মন দিন। পাঁচ রাজ্যের ভোট আসছে। অনেক দায়িত্ব... অনেক প্রচার... অনেক প্রোপাগান্ডা।
আর আম আদমি! আমরা না হয় শুধুই ভাবব, গোটা বছর কেন ভোট থাকে না। তাহলে তেল-গ্যাসের দামটা বাড়ত না!