হিটলারের জার্মানিতে প্রচারমন্ত্রী ছিলেন জোসেফ গোয়েবলস। তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি হল—মিথ্যে কথাও এত বড় করে বলা এবং এত বার বলা জরুরি যে মানুষ একদিন তা বিশ্বাস করতে শুরু করবে। সেই সময়ে এই উক্তির বাস্তবায়ন করেছিল জার্মান রেডিও। আজকের স্মার্টফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপ অক্ষরে অক্ষরে সেই কাজটাই করে চলেছে। আধুনিক ব্যবস্থায় যাকে বলে ‘ফেক নিউজ’। আর তা মানুষের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল ছাড়া কিছু নয়। ফলে এখন কে ঠিক আর কে ভুল, কোন খবরটা আসল আর কোনটা নকল, তা বুঝতে আম জনতা সম্পূর্ণ দিশেহারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে পড়ার ফল যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা অনেকেই জেনে গিয়েছেন। বহু প্রান্তিক মানুষকে ছেলেধরা সন্দেহে প্রাণ দিতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার এক সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি অপর সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ উদ্রেক করাই থাকে লক্ষ্য। তাতে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধরুন, নোট বাতিলের পর সেই ছড়িয়ে-পড়া মেসেজটির কথা। যেখানে ছড়ানো হয়েছিল যে, আসল ২০০০ টাকার নোটে নাকি ন্যানো চিপ লাগানো আছে। সুতরাং কেউ যদি সেটি লুকিয়ে রাখে তা হলেও সেটিকে ধরে ফেলা সম্ভব। কিংবা, নতুন নোট স্ক্যান করলে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনা যায়। এগুলো ফোনে-ফোনে ছড়ানো হয়েছিল। ভুয়ো খবর মানব-মনস্তত্ত্বের উপরে জাল বিছিয়ে ফেলে। ডিজিটাল মাধ্যমে এখন যেভাবে ভুয়ো খবর ছড়ায় তা জনমত, এমনকী ভোটেও প্রভাব ফেলছে। বিবিসির এক গবেষণা বলছে, অনেক ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা করতে পারে এমন ফেক নিউজকে প্রকৃত খবরের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এসব ভুয়ো খবরের উৎস কী—সে বিষয়েও তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। অধুনা ফেক নিউজের রমরমার বুনিয়াদ এটাই। গুজব ও ভুয়ো খবর উপচে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
ফেক নিউজ কী? স্রেফ মিথ্যে কথা। উদাহরণ? অজস্র। সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপ-বার্তায় বাংলায় ‘বিশৃঙ্খলা’র ছবি তুলে ধরতে রক্তাক্ত শিশুর ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যা দেখিয়ে বলা হয়েছিল, এই বিক্ষোভ বা বিরোধিতাকে সমর্থন করলে আপনি ক’জন নিষ্ঠুর নরপশুর সমগোত্রীয়। পরে জানা গেল, ওই ছবিটি আসলে বাংলাদেশের একটি দুর্ঘটনার ছবি। এই বাংলায় নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় যা হচ্ছে, তার দিকে আঙুল তুলতে কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় জখম একটি শিশুর ছবিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। এর আগে বসিরহাটে গোলমালের সময়ে নারীনিগ্রহের ভুয়ো গল্প ফাঁদতে ভোজপুরি সিনেমার দৃশ্য ব্যবহার করা হয়েছিল। গত অক্টোবরে পাঞ্জাবে রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে দশেরার রাবণ পোড়ানো দেখছিলেন একদল মানুষ। তাঁদের উপর দিয়ে ট্রেন চলে যায়। ষাট জনের মৃত্যু হয়। সবাই যখন শোকস্তব্ধ, সোশ্যাল মিডিয়ায় রটে গেল, ‘‘কেউ কি ট্রেন চালকের ধর্মপরিচয় খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিলেন? ইমতিয়াজ আলি। এবার বুঝুন ট্রেন কেন থামেনি, এবং অত গতিতে কেন চলছিল!’’ বাস্তবে, ড্রাইভারের নাম অরবিন্দ কুমার। যারা খবর ছড়াচ্ছিল, তারা নাকি এক রাজনৈতিক দলের আইটি সেল কর্মী। আন্দোলন ঠেকাতে জেএনইউয়ের নামে ভুয়ো প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে। দিন কয়েক আগেই ট্যুইটারে এক তরুণীর ছবি ছড়ানো হয়, যাতে দেখা যায় তাঁর এক হাতে বোতল ও আর এক হাতে সিগারেট। ওই তরুণী জেএনইউয়ের ছাত্রী বলে প্রচার করা হয়। লেখা হয়, ‘‘যারা নেশার জন্য টাকা খরচ করতে পারে তারা ফি কমানোর আন্দোলন করে কোন যুক্তিতে?’’ যাচাই করতেই অবশ্য বোঝা যায়, ছবিটি ভুয়ো। এমন ভুয়ো খবরের কথা ছেড়েই দিন, গত আগস্টে হুবহু নকল করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের একটি বিজ্ঞপ্তি। যেখানে বলা হয়েছে, আয়কর রিটার্ন জমার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। তাতে এতটাই বিভ্রান্তি ছড়ায় যে সিবিডিটি-র পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ওই ঘোষণা ‘ভুয়ো’।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে প্রায় ২০ কোটি মানুষ স্মার্টফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন এবং এঁদের প্রত্যেকেই কোনও-না-কোনও গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। তা সে পারিবারিক হোক বা অফিস হোক বা পাড়ার হোক, বন্ধুদের হোক বা রাজনৈতিক হোক বা অন্য কোনও গ্রুপ হোক। আর এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রোজ কোনও-না-কোনও ফরওয়ার্ড করা মেসেজ আসে। এগুলো কোথা থেকে আসে কেউ জানে না হয়তো। কিন্তু পাঠিয়ে দেয়। আসলে যে মানুষ যা বিশ্বাস করে, সে সেটাই পাঠায়। দেখা গিয়েছে, ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ মোবাইলে আসা যে-কোনও কিছুকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। লালবাজারের পুলিসকর্তাদের কথায়, যাবতীয় অপপ্রচার কিন্তু সংগঠিতভাবে চালানো হয়। এসবই পাকা মাথার কাজ। আর আম জনতা? মিথ্যেতেই বিশ্বাস জন্মাচ্ছে তাদের। জোসেফ গোয়েবলস যেন ফের বেঁচে উঠেছেন এ-দেশের মাটিতে!