কর্মরতদের সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা ও ব্যবহারে সংযত থাকা দরকার। ... বিশদ
স্বাধীনতার এতদিন পরে আজ আবার নতুন করে দেশভক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠছে, কে বড় দেশপ্রেমিক ছিলেন, মহাত্মা গান্ধী না নাথুরাম গডসে? কে বড় দেশপ্রেমিক ছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ না সূর্য সেন? কে বড় দেশপ্রেমিক ছিলেন, সাভারকর না ভগৎ সিং? সব ঘুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এসব প্রশ্নের মধ্যে আমাদের হৃদয়ে অনন্ত আলোর উৎস হিসেবে জেগে থাকেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি হলেন অন্য এক গ্রহ। অন্য এক মানুষ। অন্য এক মহামানব। সকলের থেকেই অনেক আলোকবর্ষ দূরে তাঁর অবস্থান। এমনকী তাঁর কাছে স্বাধীনতার ভাবনাটাই ছিল অন্যরকমের।
যাঁদের হাত ধরে আমাদের দেশে স্বাধীনতা এসেছে, তাঁদের কাছে স্বাধীন ভারত নিয়ে কোনও ভিশন ছিল না। স্বাধীনতার পর দেশকে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, সে ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী না থাকার কারণেই দেশ গড়ার কাজ একেবারে সূচনা লগ্ন থেকেই ব্যাহত হয়েছে। দেশভাগের কাঁটায় আজও আমরা বিদ্ধ হয়ে চলেছি। স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তিসাধনা এবং সাধারণতন্ত্রের লক্ষ্য ছিল মানুষের হাতে ক্ষমতা। ভোট দেওয়ার ক্ষমতাটুকু ছাড়া আমাদের দেশে সেই গণতন্ত্রের মূল্য আর কতটুকু! স্বাস্থ্যে, শিক্ষায়, ক্ষুধানিবৃত্তিতে সাধারণ মানুষ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠছে। সরকারি বিজ্ঞাপনের ঢক্কানিনাদে গণতন্ত্র আজ মুখ টিপে হাসে।
কিন্তু নেতাজির ছিল একটা নিজস্ব ভিশন। তিনি জানতেন, কীভাবে দেশগঠন করতে হয়। চারিদিকে ধূসর অন্ধকার আর রাজনৈতিক দূষণের মধ্যে তিনি আজও এক অকম্পিত প্রদীপ। নেতাজি বুঝেছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাস বদলাচ্ছে। সেই পরিবর্তিত ইতিহাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে স্বাধীনতা সহজলভ্য হবে না। ১৯৩৯ সালে সেপ্টেম্বরে ইউরোপে শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নেন তিনি।
নেতাজি জানতেন, বিশ্বযুদ্ধের আঁচে বিশ্বের প্রায় সব দেশই কমবেশি বিধ্বস্ত। যুদ্ধ শেষ হলেই প্রত্যেকেই নতুন করে শুরু করবে নিজেদের দেশগড়ার কাজ। যুদ্ধের জন্য ভেঙে পড়েছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি। যুদ্ধের শেষে সব দেশই চাইবে নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে মজবুত করতে। নেতাজিও চেয়েছিলেন ভারত অর্থনীতির দিক থেকে কিছুটা শক্তিশালী হয়ে উঠলেই অন্যান্য ক্ষেত্রে তাকে বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে অগ্রগতির পরীক্ষায় নামাবেন। সারা বিশ্ব তখন এক আধুনিক বিশ্বের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। সেখানে বিজ্ঞান এসে দাঁড়িয়েছে একেবারে সামনের সারিতে। তাই নতুন এবং স্বাধীন ভারত গড়ার ক্ষেত্রে তিনি প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানকে।
নেতাজি স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন ভারতে গড়ে উঠবে তার নিজস্ব অস্ত্র কারখানা। সামরিক শক্তিতে ভারতকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। এমন পরিকল্পনা করে নেতাজি দেখতে গেলেন চেকোস্লোভাকিয়ার দুটি অস্ত্রের কারখানা। সে দু’টি হল স্কোদা এবং ব্রেন। নেতাজির সঙ্গে তাঁদের মউ স্বাক্ষর হল। স্বাধীনতার পর নেতাজির উদ্যোগে অস্ত্র কারখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা সাহায্য করবে। তিনি দেখতে গেলেন সিন্থেটিক বেঞ্জিনের কারখানা। তার নাম স্তালিন ওয়ার্কস। খনিজ তেলের দিক থেকে ভারত তেমন উন্নত নয়। তাই এ ব্যাপারেও নেতাজি উৎসাহ দেখালেন। এরপর তিনি জার্মানির কয়েকটি কলকারখানা পরিদর্শন করেন। স্বাধীন ভারতে শিল্পপ্রসার ঘটানোর স্বপ্ন ছিল তাঁর দু’চোখে।
স্বাধীন ভারতে সেনাদের মেডেল কেমন হবে, তার পরিকল্পনাও করেছিলেন নেতাজি। শুধু পরিকল্পনাই নয়, ভিয়েনা থেকে তা তিনি তৈরিও করেছিলেন। মোট দশ রকমের মেডেল তৈরি করেছিলেন তিনি। এতেই বোঝা যায়, তখনকার নেতাদের থেকে ভাবনায় বা পরিকল্পনায় তিনি কত এগিয়ে ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, পোস্টাল স্ট্যাম্প কেমন হবে, পাসপোর্ট কেমন হবে। সেসবের নমুনাও তিনি তৈরি করে ফেলেছিলেন। এছাড়াও কেমন হবে ভারতের মুদ্রা, সে ব্যাপারেও তিনি ভেবেছিলেন।
জার্মানিতে থাকার সময় তাঁর হাতে আসে ভারতীয় অর্থনীতি ও কৃষি সংক্রান্ত কয়েকটি বই। এগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে প্রকাশিত। ভারতীয় কৃষি, অরণ্য, পশুপালন, বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও খনিজ সম্পদ
এবং শিল্প ও কৃষিতে ব্যবহৃত সম্পদ নিয়ে বইগুলি লেখা। এগুলি তাঁকে নতুনভাবে চিন্তা করতে
সাহায্য করেছিল। তিনি চেয়েছিলেন কৃষিক্ষেত্র,
অরণ্য সম্পদের ব্যবহার, পশুপালন ইত্যাদির উপর জোর দিতে।
এইসব রূপরেখা অঙ্কনের সময় তিনি জার্মানি, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, রুমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া প্রভৃতি দেশের অনুসৃত নীতির ভালো দিকগুলিকে গ্রহণ করেছিলেন। ইউরোপের অর্থনীতি, সমাজনীতি, কৃষি এবং সামগ্রিক জীবনকে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছিলেন। প্রত্যেকের ভালো দিকগুলিকে একত্রিত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষকে।
তিনি শুধু অপেক্ষা করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের নাগপাশ থেকে ভারত মুক্ত হলেই সেগুলি তিনি চালু করে দেবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজরা ভারতকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য।
কিন্তু ইংরেজরা তখন খেলছিলেন অন্য খেলা। তাঁদের মধ্যে তখন ভারত ভাগের কৌশল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। জার্মানিতে বসে রেডিও এবং খবরের কাগজের মাধ্যমে তিনি সব খবরই পাচ্ছিলেন। দেশের মানুষকে পঙ্গু করে দিতে বিভাজন নিয়ে ভারতে উচ্চ পর্যায়ের সব আলোচনা চলছে। দেশের মধ্যেই একদল লোক এতে মদত দিচ্ছে। নেতাজি ছিলেন ভারতভাগের বিরোধী। তিনি মনে করতেন, জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে তার ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বিভাজন এক অপরাধমূলক কাজ। তিনি মনে করতেন, ভারত ভাগ মানে এক মায়ের দুই দুর্বল শিশু। তিনি মনে করতেন, ইংরেজরা যদি ভারত ভাগ করতে সক্ষম হয়, তবে সেটা হবে তাদের বড় রাজনৈতিক জয়। শুধু তাই নয়, ভেঙে যাবে জাতিগত, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক সংহতি। অথচ হাজার হাজার বছর ধরে সহস্র প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ভারত তার অখণ্ডতা রক্ষা করতে পেরেছে। অখণ্ড ভারত প্রাচ্যের মধ্যে সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র।
১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে জার্মানির বার্লিনে তিনি শুরু করেছিলেন ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার বা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের কাজ। এর প্রথম বৈঠক বসে ১৯৪১ সালের ২ নভেম্বর। সেই বৈঠকে অনেকগুলি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল জাতীয় সঙ্গীত কী হবে। নেতাজি বললেন, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হবে ‘জনগণমন অধিনায়ক’। তার আগে পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত কোনও জাতীয় সঙ্গীত ছিল না। কিছু দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হতো। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে বিদ্রোহ যখন সশস্ত্র আন্দোলনের পথে গেল, তখন থেকে কংগ্রেস এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সভা-অনুষ্ঠানে গাওয়া হতো মূলত ‘বন্দেমাতরম’।
‘জনগণমন’ নিয়ে বার্লিনের সভায় জোরদার বিতর্ক হয়। কয়েকজন এনিয়ে প্রশ্নও তোলেন। নেতাজি গানটির পক্ষে ক্ষুরধার সব যুক্তি উপস্থাপন করেন। এরপরই সকলে তা মেনে নেন।
১৯৪২ সালে হামবুর্গে ইন্দো-জার্মান কালচারাল সোসাইটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘জনগণমন’ গানটি পূর্ণ অর্কেস্ট্রা যোগে গাওয়া হল। সেই গানের গ্রামোফোন রেকর্ডও হয়েছিল। সেই প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকা বিদেশের মাটিতে উড়ল। অন্য রাষ্ট্রের পতাকার পাশে সেদিন উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল ভারতের পতাকাকে। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নেতারা। তাঁদের উপস্থিতিতে হামবুর্গের মেয়র নেতাজিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক নেতা হিসেবে অভ্যর্থনা জানান। নেতাজিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হামবুর্গের মেয়র বলেন, ভারতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাঁরা স্বীকৃতি দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে হার্দিক ও মৈত্রীর সম্পর্ক তাঁরা বজায় রাখবেন। সরকারিভাবে সেদিনই নেতাজিকে দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রনেতার সম্মান। ১৯৪২ সালের ২৯ মে জার্মানি ভারতকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল, আর সেটাই সত্যে পরিণত হল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট।
কিন্তু দুর্ভাগ্য! সেদিন দেশ নেতাজিকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পেল না। ইতিহাস চলে গেল অন্য পথে। নানারকম ভাগ-বাঁটোয়ারা আর আপসের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা এল, তা ছিল পঙ্গু স্বাধীনতা। আজ এতদিন পরেও সেই পঙ্গুত্বের লক্ষণগুলি ফুটে উঠেছে সমাজের সর্বাঙ্গে। তাঁর স্বপ্নকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। আমরা ‘যোদ্ধা’ নেতাজিকে চিনি, কিন্তু ‘স্বাধীন ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা’ নেতাজিকে চিনি না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
আজ দেশ আবার নতুন সঙ্কটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার কি মানুষে মানুষে বিভেদের বিষফণা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে? কীভাবে হবে তার মোকাবিলা? সেকথা বলবে সময়। আজ শুধু এই আঁধারপথে সেই সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলি, জয়তু নেতাজি, তোমাকে প্রণাম।