ব্যবসায় বাড়তি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত সাফল্য নাও দিতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি। শ্বাসকষ্ট ও বক্ষপীড়ায় শারীরিক ক্লেশ। ... বিশদ
২০১১ সাল। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের সেফি রথ নামে এক শিক্ষক বায়ুদূষণের বিভিন্ন প্রভাব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। ভাবলেন, চিন্তাশক্তির উপর এর কোনও প্রভাব পড়ে কি না একটুখানি পরীক্ষা করে দেখা যাক। শিক্ষার্থীদের কয়েকটি পরীক্ষার দিন তিনি বেছে নিলেন। সেই সমস্ত দিনে বায়ুদূষণের মাত্রা কেমন থাকে, সেটা দেখা হল। বিশেষ করে বায়ু বাদে বাকি সব বিষয় যেন একই থাকে, সেটা খেয়াল রাখা হল। যেমন, ভিন্ন ভিন্ন দিন পরীক্ষা নেওয়া হলেও অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী একই হতে হবে। পরীক্ষা হতে হবে একই জায়গায়। প্রশ্নের মান হতে হবে একইরকম। গবেষক দল আবিষ্কার করলেন, বায়ুদূষণের মাত্রা যেদিন বেশি ছিল, সেদিন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাও খারাপ হয়েছে। অর্থাৎ, বায়ুদূষণ আসলেই শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তির উপর খারাপ প্রভাব ফেলছে। বাস্তব জীবনে যা হয়, গবেষক দল তারপর সেটাই দেখালেন। যারা সেদিন পরীক্ষা খারাপ করেছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে গিয়েছে। ফলে, তুলনামূলক ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের পড়ার সুযোগ কমে গিয়েছে। যার প্রভাব পড়বে তাদের চাকরি জীবনেও। যেটা পরবর্তীকালে আবার তাদের পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলবে। মানে, শুধু পরীক্ষার দিনটায় যে এলাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি থাকবে, সারা জীবনের জন্য সেই এলাকার শিক্ষার্থীরা কোনও কারণ ছাড়াই অনেকটা পিছিয়ে যাবে।
পরবর্তী প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১৬ সালে। আরও একদল গবেষক এ নিয়ে পরীক্ষা করে একই ফলাফল পেলেন। রথ এবং তাঁর দল তাঁদের গবেষণা আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। দু’বছরে লন্ডনের ৬০০ ইলেক্টোরাল ওয়ার্ডে (ভোটের হিসেবে ভাগ করা এলাকা) যেসব অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, সেসব তথ্য নিয়ে কাজ করলেন। দেখা গেল, যে এলাকাই হোক না কেন, ভয়ঙ্কর সব অপরাধ যেসব দিনে ঘটেছে, সেসব দিনের বায়ুদূষণের মাত্রা অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি ছিল।
হ্যাঁ, এর মধ্যে অন্য অনেক ব্যাপারই থাকতে পারে। শুধু এটুকু যুক্তি দিয়ে গবেষণার ফলাফল টেনে ফেলা যায় না। তাহলে, এই বিষয়টা সঠিক কিনা, সেটা পুরোপুরি বোঝার উপায় কী? এরপর গবেষকরা কিছু এলাকা বেছে নিলেন। সেখানকার দূষিত বায়ু শনাক্ত করে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বাতাস যেদিকে বইবে, দূষিত বায়ু ধীরে ধীরে সেদিকেই সরে যাবে। সেই হিসেবে, একটা শহরে সময়ে সময়ে বায়ুদূষণের পরিমাণ কম-বেশি হবে। রথের ভাষায়, ‘আমরা শুধু সেই দূষিত বায়ু-মেঘটাকে অনুসরণ করে গিয়েছি। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার অপরাধ প্রবণতার দিকেও লক্ষ্য রেখেছি। দেখা গেল, দূষিত বায়ু যে এলাকা দিকে যাচ্ছে, অপরাধের হার তুলনামূলকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। তবে, এই গবেষণা থেকে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলেও, ভয়াবহ অপরাধগুলোর
উপর এর প্রভাব সেভাবে বোঝা যায়নি।’
২০১৮ সালের আরও এক গবেষণা থেকে খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধের উপরেও বায়ুদূষণের সম্ভাব্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এই গবেষণাটির নেতৃত্বে ছিলেন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-র গবেষক জ্যাকসন লু। দীর্ঘ ন’বছর ধরে আমেরিকার ৯ হাজারের মতো এলাকা নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরা। দেখা গেল, ছ’টি ভয়াবহ অপরাধ, যেমন — খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ইত্যাদির উপরেও বায়ুদূষণের প্রভাব পড়ছে এবং যেসব শহরে দূষণের মাত্রা বাড়ছে, সেখানে অপরাধের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। এরকম একাধিক গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণ মস্তিষ্কের উপর যে প্রভাব ফেলে, তার ফলে মানুষের বিবেচনা বোধ এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। বেড়ে যেতে পারে মানসিক সমস্যা এবং অপরাধ প্রবণতা।
শুধু তাই নয়, মানুষের মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। জ্যাকসন লু এবং তাঁর সহকর্মীরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন, বায়ুদূষণের প্রভাব মস্তিষ্কের স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায়। পরীক্ষা করতে তাঁরা বিভিন্ন দেশের মানুষকে আলাদাভাবে বসান। খুব দূষিত এলাকার ছবি দেখিয়ে জানতে চান, তাঁরা সেসব এলাকায় বসবাস করতে রাজি আছেন কিনা। এর মধ্যে আমেরিকান যেমন ছিলেন, তেমনই ভারতীয়ও ছিলেন। এই সময় তাদের মস্তিষ্কের ব্রেনওয়েভ, পালস ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
লু’র কথায়, ‘আমরা তাঁদেরকে মানসিকভাবে বায়ুদূষণের অনুভূতি দিই। জিজ্ঞাসা করি, এমন পরিবেশে থাকতে তাঁদের কেমন লাগবে? একইসঙ্গে পরিষ্কার কোনও এলাকায় থাকতে কেমন লাগবে, সেটাও তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়।’ দেখা যায়, শুধু মানসিকভাবে দূষিত এলাকায় থাকার অনুভূতিও মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ এবং স্বার্থপর ভাবনা জাগিয়ে তোলে। শান্ত মাথায় অপরাধ করা বা কাউকে ঘুসি মেরে বসার চেয়ে উদ্বিগ্ন অবস্থায় মেরে বসার সম্ভাবনা বেশি। তার মানে, বায়ুদূষণ আপনার ব্যবহারের উপর খারাপ প্রভাব ফেলছে।
গবেষকদের মতে, শুধু উদ্বেগ বা স্বার্থপর ভাবনাই নয়, জৈবিক কারণও রয়েছে এর পিছনে। দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিলে আপনার মস্তিষ্ক প্রয়োজনের তুলনায় কম মাত্রায় অক্সিজেন পৌঁছয়। এমন অবস্থায় ওই ব্যক্তি যে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া, দূষিত বায়ু নাক, কান, গলা, ফুসফুসের উপরেও প্রভাব ফেলে। এসবের ফলে মস্তিষ্কে স্নায়বিক সংযোগের ক্ষতি হতে পারে। এই ক্ষতিটা মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল লোবে হয়। আর, মস্তিষ্কের এই অংশটিই মূলত আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, বিবেচনাবোধ ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বর্তমান পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ শহরে বসবাস করে। ফলে বাসে বা গাড়িতে যাতায়াতের সময় নিয়মিত ভীষণরকম দূষিত বাতাস টেনে নিচ্ছে মানুষ। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (‘হু’) বলছে, বিশ্বের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই ভয়াবহ দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছে। বর্তমান হিসেবে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ শুধু বায়ুদূষণের প্রভাবে মারা যাচ্ছে। তাহলে ভাবুন আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজের চিত্রটা কেমন হতে চলেছে?
বিজ্ঞান গবেষণার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল, সে শুধু তথ্য বিশ্লেষণই করে না, বরং বিশ্লেষিত তথ্য ব্যবহার করে অনুমান করতে পারে, কী ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। দেখা গেল, এমআইটির গবেষক জ্যাকসন লু’র গবেষণা শুধু তথ্য বিশ্লেষণই করছে না, বরং বায়ুদূষণের মাত্রা হিসেব করে বলে দিতে পারছে, কোন শহরে কোন দিন অপরাধের হার কেমন হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই গবেষণায় বয়স, লিঙ্গ, চাকরিজীবীদের পেশাগত পদ এবং সেই হিসেবে তাদের আয়-ব্যয়, জনসংখ্যা ইত্যাদি বিষয়গুলিও হিসেবে রাখা হয়।
সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ডায়ানা ইউনান এবং তাঁর সহকর্মীরা গবেষণা করে দেখেছেন, প্রতারণা কিংবা স্কুল পালানো থেকে শুরু করে ছোটখাটো চুরি, ভাঙচুর ইত্যাদির উপরেও বায়ুদূষণের প্রভাব রয়েছে। ওই গবেষণায় ৬২৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা বাতাসে পিএম ২.৫ কণার দূষণের দিকে বিশেষ নজর রেখেছিলেন। মানুষের চুল যতটা সরু তার থেকে প্রায় ৩০ গুণ ছোট যেসব কণা বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়, এরাই পিএম ২.৫ নামে পরিচিত। কল-কারখানা, মোটর গাড়ি বা পোড়ানো কাঠ থেকে এই ধরনের কণা উৎপন্ন হতে পারে এবং বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। ভারত কি এই মারণ-ঘাতক থেকে সতর্ক?
বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে পরিবেশ মন্ত্রক সম্প্রতি একটি নির্দিষ্ট রূপরেখা প্রকাশ করেছে। যার পোশাকি নাম, ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’ (এনসিএপি)। ওই কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্যই হল, যেভাবে দেশে বায়ুদূষণ বিপজ্জনক মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। পাশাপাশি, ২০২৪ সালের মধ্যে প্রাথমিক ভাবে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা (পিএম ১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) পরিমাণ জাতীয় স্তরে ২০-৩০ শতাংশ কমানো। সেই রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে বায়ূসূচকের স্বাভাবিক মাত্রা লঙ্ঘিত হয়েছে এমন ১০২টি শহরের (মন্ত্রকের তরফে যেগুলিকে ‘নন অ্যাটেনমেন্ট সিটিজ’ বলা হচ্ছে) মধ্যে অন্যতম হল কলকাতা! অর্থাৎ, পরিবেশ, আক্ষরিক অর্থেই, অনাথ। এইসব তথ্য জানার পর প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক — ওরা পারে, আমরা পারি না কেন?
আসলে কোনও জাদুকাঠির বলে কলকাতা সহ গোটা দেশের বড় বড় শহরে বায়ুদূষণ রোধ করা যাবে না। এর জন্য চাই সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নীতি। যার বড় উদাহরণ হতে পারে আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া। কলকাতায় এসে বলে গিয়েছিলেন মার্কিন পরিবেশ প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ জেমস স্যার।