শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্ত শত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত ... বিশদ
প্রযোজনা: কুশীলব
পরিচালনা: রুণু চৌধুরী
সারা বিশ্বেই ফরাসি কমেডির এক অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে। বিশেষ করে সে নাটক যদি হয় ‘ফ্লেউর দ্য ক্যাকটাস’। যার রচয়িতাদ্বয় হলেন প্যারি ব্যারিলেট এবং জাঁ পিয়ের গ্রেডি। এই নাটক সেই দেশের মঞ্চে অভিনীত হতে শুরু করেছিল ১৯৬৫ সালের ৮ ডিসেম্বর। টানা দু’বছর ১২৫০ রজনী অভিনীত হয়েছিল এ নাটক রয়্যাল থিয়েটারে। সেই কাহিনী নিয়ে আমেরিকায় নির্মিত হল ‘ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার’ ছবিটি। মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। অভিনয়ে ছিলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান, গোল্ডি হন এবং ওয়াল্টার ম্যাথাউ। সুপারহিট কমেডি ছবি। সেই গল্প নিয়ে হিন্দিতে নির্মিত হল ছবি ‘ম্যায়নে প্যার কিউ কিয়া’ (২০০৫)। এতে অভিনয় করলেন সলমন খান, সুস্মিতা সেন ও ক্যাটারিনা কাইফ। সে ছবিও সুপারহিট। তারপর হলিউডে ২০১১ সালে ফের এই গল্প নিয়েই হয় আরও একটি সিনেমা। যার নাম ‘জাস্ট গো ফর ইট’। এই ঘটনা প্রমাণ করছে এমন অনাবিল হাস্যরসের ছবি দেশে বিদেশে সমাদৃত।
সেই গল্পের নাট্যরূপ বাংলায় পাওয়া গেল। নাম ‘কাঁটা গাছে ফুটলো ফুল।’ কুশীলব প্রযোজিত এ নাটকের পরিচালক রুণু চৌধুরী। নাট্যরূপ দিয়েছেন উৎপল ঝা। কী আছে এই মজার গল্পে সেটা একটু দেখে নেয়া যাক। দাঁতের নামকরা ডাক্তার জয়দীপ সামন্ত দায়হীন প্রেম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ছলনার আশ্রয় নেন। তিনি জানান যে তিনি বিবাহিত। তাঁর দুটি সন্তানও আছে। কিন্তু এই বিবাহে তিনি তৃপ্ত নন। তাই তিনি রিয়াকে ভালোবেসে নতুন করে সংসার পাততে চান। দু’জনের মধ্যে ডেটিং চলতে থাকে। সর্বদা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেন না বলে জয়দীপের উপর অভিমান করে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন রিয়া। কিন্তু এ যাত্রায় তাঁকে বাঁচালেন পাশের ফ্ল্যাটের অবিবাহিত সঙ্গীতপিপাসু এক সুদর্শন যুবক, যার নাম অর্ক। প্রথমে দু’জনের মধ্যে বেশ কিছু কথা কাটাকাটি হয়। তবে পরে দু’জনের বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগে না। পাশাপাশি ডাক্তার সামন্তের চেম্বার দক্ষ হাতে সামলান মিস জয়তী সেন। রোগীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া, হিসাবপত্র রাখা, ফোন ধরা, ডাক্তারবাবুকে নানান কাজে সাহায্য করা, এ সব ব্যাপারে মিস সেনের কোনও তুলনা নেই। সময়মতো বিয়ে করতে পারেননি, কারণ যাঁকে ভালোবেসেছিলেন তিনি বিবাহিত। কারও ঘর ভাঙতে তিনি চান না। এদিকে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রিয়া শর্ত দেন, তিনি একবার মিসেস সামন্তের সঙ্গে কথা বলবেন। জয়দীপ যেখানে বিয়েই করেননি সেখানে মিসেস সামন্ত আসবে কোথা থেকে! অগত্যা জয়ন্তী সেনকে মিসেস সামন্ত হয়ে আসতে হল। বিধাতা পুরুষ অলক্ষ্যে হাসছেন নিশ্চয়ই! এখানেও শেষ নয়, মিসেস সামন্তরূপী জয়তী সেন তাঁর জীবনে নতুন এক পুরুষ পেয়ে গিয়েছেন এ কথা শুনে রিয়া সেই পুরুষটিকেও একবার দেখতে চাইলেন। সে মানুষ কোথায় পাওয়া যাবে? অগত্যা জয়দীপের ন্যাংটো বয়সের বন্ধু এবং বর্তমানে তাঁর রোগীও বটে সেই চঞ্চলকে মিসেস সামন্তের নতুন প্রেমিক রূপে আনা হল। মিথ্যে দিয়েই যেখানে ফাঁদ পাতার চেষ্টা, সেখানে একটার পর একটা মিথ্যে ছলনার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া জয়দীপের করারও কিছু ছিল না। শ্যাম রাখি না কুল রাখি বোধ হয় একেই বলে। বাকিটা মঞ্চে দেখার জন্য আর বিস্তারে গেলাম না।
সমগ্র নাটকে চারটে সেট সাজানো হয়েছে। রিয়ার বেডরুম, ডাক্তার সামন্তের চেম্বার, রিয়ার সিডি বিক্রির শো-রুম, রঙিন এক রেস্টুরেন্ট। মঞ্চ ভাবনার ক্ষেত্রে দেবাঞ্জন সুর এবং মঞ্চ নির্মাণের ক্ষেত্রে মদন হালদারের প্রশংসা করতেই হয়। আলো-আঁধারির কাজে সৌমেন চক্রবর্তীরও প্রশংসাই প্রাপ্য। এমন নাটকে গানের তেমন সুযোগ থাকে না। তবে সঙ্গীত পরিচালক পিলু ভট্টাচার্যের সুরে প্রথম গানটি ‘কচি কচি দাঁতে লাগে শিরশিরানি’ শুনতে ভালোই লাগে।
এই নাটকের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হল দলগত অভিনয় নৈপুণ্য। কমেডি নাটকে অভিনয় সহজ নয়। কিন্তু শিল্পীরা তাঁদের চরিত্র রূপায়ণে যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ডাক্তার জয়দীপ সামন্ত চরিত্রের রূপকার শৌভিক মজুমদারের কথা। একটা মিথ্যে ঢাকতে আরেকটা মিথ্যের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে যে অসহায় অবস্থা, তাকে বাস্তবায়িত করেছেন শৌভিক। মিস জয়তী সেনের চরিত্রে পাপিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় অপূর্ব। নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, অন্যদিকে ডাক্তার সামন্তের প্রতিও দুর্বল, এই দুটি দিকই তিনি মূর্ত করে তুলেছেন তাঁর অভিনয়ে। রিয়ার চরিত্রে শ্রেয়া মুখোপাধ্যায় আগাগোড়া প্রাণোচ্ছল। একই কথা প্রযোজ্য অর্ক চরিত্রের অভিনেতা মিঠুন রায় সম্পর্কেও। এই দু’জনের ছোট ছোট খুনসুটি দর্শকেরা উপভোগ করেছেন। চঞ্চলের চরিত্রাভিনেতা দেবাঞ্জন সুর দর্শকদের হাসাবার সুযোগ পেয়েছেন, সে কাজটি তিনি করেছেনও আন্তরিকভাবে। ডাক্তারের দুই পেশেন্ট মিসেস মজুমদার এবং সর্দারজি। এই দুই চরিত্রে শিখা চট্টোপাধ্যায় এবং প্রতীপ মুখোপাধ্যায়ও হাস্যরস জমিয়ে তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। অন্যদের অভিনয়ও মানানসই। এই উপভোগ্য প্রযোজনার প্রধান কৃতিত্ব অবশ্যই পরিচালক রুণু চৌধুরীর। এক-একটি দৃশ্যকে অযথা দীর্ঘ না করে আয়তন ঠিক রেখে যে সামঞ্জস্য তিনি বজায় রেখেছেন তার প্রশংসা করতেই হয়। হাসির নাটকে হাসিটা ধরে রাখা এক দুরূহ কাজ। সেই কাজে তিনি সফল। প্রথমার্ধেই রস নিষ্পত্তি ঘটে গিয়েছে, তাই দ্বিতীয়ার্ধের প্রতি তেমন টান না থাকারই কথা। কিন্তু অভিনয় দিয়ে সেই জায়গা ভরাট করেছেন পরিচালক। এ জন্য তিনি অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।