অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ক্লান্তি, প্রিয়জনের বিপথগামিতায় অশান্তি ও মানহানির আশঙ্কা, সাংসারিক ক্ষেত্রে মতানৈক্য এড়িয়ে চলা ... বিশদ
এবার নরেনের দিকে চোখ পড়তেই তিনি সব ভুলে গেলেন। দাঁড়িয়ে উঠলেন, নরেনের হাঁটুতে একটি পা দিয়ে অনেকক্ষণ বাহ্যশূন্য অবস্থায় রইলেন। ‘অনেকক্ষণ পরে সমাধি ভঙ্গ হইল। এখনও আনন্দের নেশা ছুটিয়া যায় নাই।’ আনন্দের নেশা মানে সমাধি অবস্থায় ঠাকুরের একটা নেশার ঘোরের মতো অবস্থা হোত। মাতালদের মতো দেহের উপরেও কোন কর্তৃত্ব বোধ থাকত না। তবে এ মাতাল সাধারণ মাতাল নয়, ঈশ্বরীয় ভাবে মাতাল—সাধারণ লোকে যাঁকে বোঝে না।
ঠাকুর বলছেন, ‘সচ্চিদানন্দ! সচ্চিদানন্দ! সচ্চিদানন্দ! ব’লবো? না, আজ কারণানন্দদায়িণী! কারণানন্দময়ী।’ কারণ কথাটির মানে বলেছেন, জগৎরূপ কার্য তার কারণে লয় হয়। জগতের স্রষ্টা হচ্ছেন এই জগতের কারণ, আবার কারণ মহাকারণে লয় হয়। মহাকারণ বলতে সেখানে আর কোন ব্যক্তিত্ব নেই। জগৎস্রষ্টারূপ ঈশ্বরের ভিতরে ব্যক্তিত্ব আছে কিন্তু মহাকারণের ভিতরে কোন ব্যক্তিত্ব নেই তাই তাঁকে অব্যক্ত বলা হয়েছে। এখানে বলছেন, ‘স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ, মহাকারণ! মহাকারণে গেলে চুপ। সেখানে কথা চলে না।’ আগে বলেছেন, ‘সা রে গা মা পা ধা নী। নী-তে থাকা ভাল নয়—অনেকক্ষণ থাকা যায় না। এক গ্রাম নীচে থাক্বো।’ কেন? না, তাহলে ভক্তদের সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান সম্ভব হবে। তার উপরে গেলে একেবারে সমাধিস্থ। যেখানে গেলে আর বক্তা নেই, শ্রোতা নেই।
তারপর ব্যাখ্যা করছেন, ‘ঈশ্বরকোটি মহাকারণে গিয়ে ফিরে আসতে পারে। অবতারাদি ঈশ্বরকোটি। তারা উপরে উঠে, আবার নীচেও আসতে পারে। ছাদের উপরে উঠে, আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে আনাগোনা করতে পারে। অনুলোম, বিলোম।’ অনুলোম মানে স্থূল থেকে সূক্ষ্মে যাওয়া আর বিলোম মানে সূক্ষ্ম থেকে নেমে স্থূলে আসা। উপমা দিয়ে বলছেন, ‘রাজার ছেলে, আপনার বাড়ী সাত-তোলায় যাওয়া আসা কর্তে পারে।’ সাততলা মানে মনের সাতটি কেন্দ্র আছে যার উপর দিয়ে ধাপে ধাপে মন উপরে ওঠে। সাততলায় ওঠা মানে মহাকারণে লয় হওয়া। ঠাকুর বলছেন, অবতার পুরুষেরাই এই সাততলা অবধি উঠে ফিরে আসতে পারেন, সাধারণ মানুষ পারে না। অবতার পুরুষেরা জীবের মঙ্গলের জন্য সমাধির উচ্চতম স্তরে উঠেও আবার নেমে আসেন। লোককল্যাণকামনার সূত্র ধরেই তাঁরা স্থূল জগতে নেমে আসেন। কিন্তু সাধারণ লোক যখন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে তীব্র সংগ্রাম করে একটু একটু এগিয়ে গিয়ে সূক্ষ্ম তত্ত্বে কোনো রকমে পৌঁছায় আর তাদের নীচে নামার কোনো সূত্র থাকে না। নীচের সব আকর্ষণ মুক্ত হয়ে তারা সেই মহাকারণে লয় হয়ে যায়, তাদের ব্যক্তিত্ব আর থাকে না। এখন কথা হল যে, এরকম ব্যক্তিত্বহীন হওয়াই তো ভাল। কিন্তু ঠাকুর বলছেন, সাধারণ লোক একবার খেলায় জিততে পারলে আর ঘুঁটি কাঁচাতে পারে না, পাকা খেলোয়াড় আবার ঘুঁটি কাঁচিয়ে খেলতে পারে। অবতার পুরুষেরা ইচ্ছামত মায়ার পারে যেতে পারেন, মায়ার ভিতর দিয়ে ফিরতেও পারেন। কোথাও আটকে যাবার ভয় নেই। এখন এই ওঠানামার ব্যাপারটা আমরা কল্পনা করি মাত্র, বোঝার সামর্থ্য নেই। যিনি সর্ববাসনাশূন্য হতে পেরেছেন একমাত্র তিনিই এটি বুঝতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সর্ব বাসনা নির্মুক্ত, তাঁর পক্ষে সাততলায় থাকাও যা নীচের তলায় থাকাও তা।