অর্ধেক পাতারও বেশি জুড়ে বিজ্ঞাপন। তার ক্যাচলাইন—‘বিশ্বের বৃহত্তম বিনামূল্যে টিকাকরণ কর্মসূচি’। এই তথ্য কোন মহার্ঘ ঘোষণায় উঠে এসেছে তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তবে তিনি হাসছেন, যত্ন করে লালিত সাদা চুল-দাড়ি আর দামি চশমার আড়ালে তাঁর স্মিত হাসি মুখ যেন একবুক গর্বের বার্তা দিল। কী সেই বার্তা?—‘আজ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্য বিনামূল্যে টিকাকরণ অভিযান শুরু করেছে।’ অর্থাৎ সোমবার থেকেই চালু হল এই কর্মসূচি। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন ভারতের মতো বিশ্বের নানা দেশ কোভিডের করাল গ্রাসে রয়েছে। মারণ ভাইরাস মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও দেশের অর্থনীতিকে প্রায় তছনছ করে দিয়েছে। এর প্রতিকার কীভাবে করা যাবে তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে দ্রুত গবেষণায় বেশ কয়েকটি সংস্থা করোনা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন বাজারে এনেছে, যা নিলে অন্তত মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সঙ্গত কারণেই ভ্যাকসিন যাতে আপামর জনগণ বিনামূল্যে পান, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ দেশের সব বিরোধী দলের নেতৃত্ব সেই দাবি জানিয়ে আসছে অনেকদিন থেকেই। অবশেষে প্রবল চাপে পড়ে ‘বিজ্ঞাপনে ছবি’ দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ২১ জুন থেকে ভারতের ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের সকলকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হচ্ছে। ভারতের টিকাকরণের এই পর্যায়ে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও যুব সম্প্রদায় সবচেয়ে লাভবান হবে। দেরিতে বোধোদয় হলেও সরকারের এই ঘোষণায় মানুষের খুশি হওয়ারই কথা। অনেকেই উল্লসিত। কিন্তু সত্যিই কি মানুষ এই ঘোষণার পরও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন? পারছেন না। কারণ এখন জানা যাচ্ছে কেন্দ্রের ঘোষণা যাই হোক, মোদি সরকার পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন না পাঠানোয় ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সি (জরুরি ক্ষেত্র ছাড়া) সকলের জন্য সোমবার থেকে টিকাকরণ কর্মসূচি শুরুই করতে পারছে না রাজ্য সরকার। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ভ্যাকসিনের অভাবের কারণেই এই সিদ্ধান্ত। এই পর্যায়ে, অর্থাৎ সকলের জন্য টিকাকরণ শুরু করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলেই অনুমান রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তরের। কেন্দ্র টিকার জোগান বাড়ালে ও জরুরি ক্ষেত্রের পেশাজীবীদের টিকাদান শেষ হলে তখন শুরু হবে অন্য সকলের টিকাকরণ।
মোদি সরকারের কথায় ও কাজে যে বিস্তর ফারাক তা বহু ক্ষেত্রেই প্রমাণিত। সেটা প্রত্যেক ভারতীয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক বা নোটবন্দির পক্ষে যুক্তি দিতে কালো টাকার কারবার বন্ধের হম্বিতম্বিতেই হোক। নেতা-নেত্রী অনেকের অসত্য ভাষণ এখন আর কোনও নতুন কথা নয়। আর মোদি সরকারের ঘোষণা আর প্রতিশ্রুতি তো প্রায় সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিকার জোগান নিয়ে শুরু থেকেই লেজেগোবরে অবস্থা কেন্দ্রের। এর আগে বারবার কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারার ঘটনাও ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে টিকা নিয়ে তরজা তুঙ্গে উঠেছে। শুধু টিকা বাড়ন্তই নয়, এর আগে টিকার দাম এবং তা কোন সরকার দেবে তা নিয়েও বিরোধ বেধেছিল রাজ্যগুলির সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়। ভর্ৎসনার মুখে পড়ে কেন্দ্রের মোদি সরকার। এত কিছুর পর এবার ঘটা করে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় ভাবা গিয়েছিল বোধহয় ঘটনা পরম্পরা ও অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবেন মোদি-শাহরা। কিন্তু কোথায় কী। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। তাই সকলের জন্য টিকাকরণ পর্বের শুরুতেই গলদ প্রকাশ্যে এল। ধাক্কা খেল কর্মসূচি। হয়রানিও কম হল না।
একটা যাত্রা শুরুর প্রথম দিনেই পশ্চিমবঙ্গ সহ কয়েকটি রাজ্যে সবার টিকাকরণের সূচনায় জোগানে ঘাটতি হল। এই ব্যর্থতা সম্পূর্ণভাবেই কেন্দ্রের। কারণ বোঝাই যাচ্ছে চাহিদামতো ভ্যাকসিন দিতে তারা অপারগ। অবশ্য বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে মানুষের প্রত্যাশা বাড়ানোর কাজটি সহজ। কেন্দ্রের এই সরকার সে কাজে অতি নিপুণ। তবে এখন আর ভ্যাকসিনের জোগানের অভাবটিকে আড়াল করা যাচ্ছে না। মানুষকে ভাঁওতা দেওয়ার এই দায় তাই কেন্দ্রকেই নিতে হবে। ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহীদের হয়রানি যাতে না-হয় তার জন্য চাহিদা মতো ভ্যাকসিন জোগানের বিষয়টি তাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।