প্রায় দেড় বছরেও মুক্তি মেলেনি দেশবাসীর। করোনার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয় দ্বিতীয় ঢেউ। তার প্রভাব এখনও সক্রিয়। এখনও দৈনিক প্রায় ৬০ হাজার মানুষ সংক্রামিত হচ্ছে। মৃত্যুও হচ্ছে কমবেশি ১৬০০ জনের। এ-পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩৯ লক্ষ। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে রয়েছে ভারত। ভারতে এ-পর্যন্ত ২ কোটি ৯৯ লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এখানে মৃতের সংখ্যাটাও বিরাট—৩ লক্ষ ৮৭ হাজার। বহু মানুষ একাধিক বার করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছে। একাধিক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে, এমন পরিমাণও রয়েছে হাজার হাজার। একমাত্র রোজগেরে সদস্যকে হারিয়ে বহু পরিবার আতান্তরে পড়ে গিয়েছে। প্রথম দিকে আক্রান্ত ও মৃতদের বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় বিশেষজ্ঞরা বুঝলেন, করোনা কোনও গোল্ডেন রুল মেনে চলে না। এই পর্বে অনেক যুবক-যুবতী, এমনকী কিশোর-কিশোরীও আক্রান্ত হল। তাদের মধ্যে মৃত্যুও হল কিছুজনের। তৃতীয় ঢেউয়ের সময় ভাইরাসের চরিত্রটা ঠিক কী হবে, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। অথচ, বিপদটা ভারতের জন্য অনিবার্য! সতর্ক করে দিয়েছেন এইমস ডিরেক্টর এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কোভিড সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য রণদীপ গুলেরিয়া। তাঁর আশঙ্কা, তৃতীয় ঢেউ আগামী ছয়-আট সপ্তাহের মধ্যে আসছে। 
তবে আশার কথা এই যে, একটা নামী আন্তর্জাতিক সংস্থার জনমত যাচাই রিপোর্টে প্রকাশ, তৃতীয় ঢেউতে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম হবে। কারণ, যারা টিকা নিয়েছে এই পর্বে তারা জোরদার লড়াই দিতে পারবে। রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে নামজাদা ৪০ জন হেলথ কেয়ার স্পেশালিস্ট, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, ভাইরোলজিস্ট এবং অধ্যাপকের মতামত নিয়ে। যদিও খুব কম বয়সিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা খারিজ করে দিয়েছে এই রিপোর্ট। তারা সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে, টিকাকরণের উপর। টিকাকরণ যত দ্রুত ও বেশি হবে, করোনা ভাইরাসকে তত সার্থকভাবে প্রতিহত করা সম্ভব হবে। জনসংখ্যার কত শতাংশের মধ্যে সার্স-কোভ-২ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তার জন্য একটা স্টাডি বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন। এটাকে বলা হয় সেরোপ্রিভ্যালেন্স সার্ভে। সম্প্রতি ভারতে পাঁচ রাজ্যের দশ হাজার মানুষের উপর একটা সেরোপ্রিভ্যালেন্স স্টাডি করা হয়। তা থেকে বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, যেসব ছেলেমেয়ের বয়স ১৮-র নীচে তাদের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা ৫৫.৭ শতাংশ। সংখ্যাটি ১৮ ঊর্ধ্বদের মধ্যে ৬৩.৫ শতাংশ। সবচেয়ে আশার কথা হল, শিশুরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হবে না। কারণ তাদের মধ্যে অ্যান্টিবডি উপস্থিতির স্তরটা বড়দের মতোই লক্ষ করা গিয়েছে। তবে দুঃসংবাদ রয়েছে মহারাষ্ট্রের জন্য। মূলত ডেলটা প্লাস ভ্যারিয়েন্টের কারণে পশ্চিমের এই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে থার্ড ওয়েভ সবচেয়ে বিপজ্জনক হতে পারে। সংক্রমণের আকার ৮ লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে।  সেখানে মোট আক্রান্তের মধ্যে ১০ শতাংশ হতে পারে শিশু। 
একটা ঢেউ থেকে আর একটা ঢেউয়ের মাঝখানে গ্যাপটা সব দেশের ক্ষেত্রে সমান হয়নি। গ্যাপটা কোথাও চার সপ্তাহ, আবার কোথাও ১০৫-১২০ দিন হয়েছে। তাই তৃতীয় ঢেউ প্রতিরোধের প্রস্তুতিটা সবসময়ের জন্যই থাকা দরকার সারা দেশের। আর একটা বিষয় হল, ভ্যারিয়েন্ট নানা প্রকার। নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্য নতুন প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা হাতিয়ারও হাতে আপাতত নেই। এই প্রশ্নে কোনও তফাত নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট, ব্রিটেন, চীন, ভারত কিংবা ব্রাজিলের মধ্যে। অসহায় মনে করলে, সেটা সবাই। ধাপে ধাপে আনলকের শক্তি বাড়িয়ে জীবনযাত্রায় স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনাই বাঁচার একমাত্র উপায়। তার জন্য ‘মাস্ক মাস্ট’, স্যানিটাইজার এবং দূরত্ববিধি কঠোরভাবে মেনে চলার বিকল্প আপাতত মাথায় আনাও দোষের মনে হয়। সর্বোপরি, সবার জন্য দ্রুত টিকাকরণের কাজটা মোদি সরকারকে অবশ্যই করতে হবে। রাজ্য সরকারগুলো নিশ্চয় সহযোগিতা করবে। তারা সেটা করছেও। কেন্দ্রের তরফে অনেক গাফিলতি, ত্রুটি ইতিমধ্যেই হয়েছে। পুরনো কাসুন্দি আর কেউ ঘাঁটতে চায় না। তাতে লাভ কিছু নেই। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা সংগ্রহ এবং দেশজুড়ে বিনামূল্যে বণ্টনের ক্ষেত্রে যে বিরাট গ্যাপটা এখনও আছে, সেটা মোদি সরকারকে আন্তরিকতার সঙ্গে দূর করতেই হবে। সরকার যেন ভুলে না যায়, প্রথম দফায় ২১ দিনের পূর্ণ লকডাউনের সময় সারা দেশে দৈনিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। বেকারত্বের হার ছুঁয়েছিল ২৬ শতাংশ। প্রত্যক্ষভাবে কাজ হারিয়েছিল ১ কোটি ৪০ লক্ষ শ্রমিক। ওই সময় জিডিপি লস হয়েছিল ৪০ শতাংশ। বিভীষিকার পুনরাবৃত্তি আর চাই না আমরা। অর্থনীতি সবে মাথা তুলতে চাইছে। অর্থনীতির এই নয়া উড়ানের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা দরকার। তাকে আঁকড়েই দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে।