সম্পত্তি সংস্কার বিষয়ে চিন্তাভাবনা ফলপ্রসূ হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি। যাবতীয় আটকে থাকা কাজের ক্ষেত্রে ... বিশদ
বাংলাদেশের সাভারের বাসিন্দা অন্তর আলির কথাই ধরুন। ইউরোপ যাওয়ার আশায় আবাদি জমি, তিনটি গরু, স্ত্রীর গয়না বেচে সব টাকা দালালদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অন্তর আলি। ২০১৬ সালের অক্টোবরে গ্রিসে যাওয়ার উদ্দেশে প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইরাকে। এরপর তুরস্ক, সেখান থেকে গ্রিস। কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও ছোট নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, আবার কখনও বা ছোট্ট একটা কনটেইনারের ভিতর ঢুকে যেতে হয়েছে। ইরাকে পর্যটক ভিসা নিয়ে গিয়ে এক মাসের বেশি থাকার সমস্যা হলেও দালাল তাকে বলেছিল কোনও সমস্যা হবে না। অন্তর আলির কথায়, যাওয়ার পথটা ছিল ভয়াবহ। প্রথম দিন দুবাই থেকে ইরাকের উদ্দেশে রওনা হন। সেখানে আট ঘণ্টা থাকার পর দালাল তাকে নিয়ে যায়। সাত থেকে আট ঘণ্টা লাগে নাজাফ থেকে বাগদাদ যেতে। বাগদাদে এক রাত থেকে কিরকুকে নিয়ে গেল। সেখানে চার দিন। রাতের বেলায় কুর্দিস্তান নিয়ে যায়। সেখানে একটা কারখানায় লেবারের কাজ করতে হয় কয়েকদিন। পরে সেখান থেকে তুরস্কের উদ্দেশে আবার রওনা হতে হয়। অন্তর আলি বলেন, ‘রাতের বেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে হাঁটতে হতো। সে কী পাহাড়। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের চামড়া উঠে গিয়েছে, হাত-পা কেটে রক্ত বের হয়ে যেত। এখনও হাতে পায়ে কাটা দাগ আছে। এছাড়া হাতুড়ির আঘাতে কালো হয়ে গিয়েছে নখ। এরপর এক গাড়িতে করে সাত ঘণ্টা ধরে জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে গেল, সেখানে তিন দিন ছিলাম। এই কয়দিনে দিনে-রাতে একবেলা খাওয়া পেতাম, সেটাও ছিল শুকনো একটি অথবা দুটি রুটি। ভয়ে একেকজন কুঁকড়ে যেতাম, কিন্তু কারও কিছু করার ছিল না। সেখান থেকেই গ্রিসের পথে রওনা হলাম। রাতের বেলায় নৌকায় করে নদী পার হয়ে আবার আরেক জঙ্গল। সেই নদী পার হতে নেয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। যে নৌকায় ১০ থেকে ১৫ জন ধরার কথা সেখানে ওঠাল ৩০ জন। সেখানে বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের লোকরাও ছিল। ইরাক পর্যন্ত যেতে নিয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। একেকটা জায়গা পার করেছে আর টাকা নিয়েছে। এভাবে মোট ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে দালালকে।’ গ্রিসে যাওয়ার পর ছয় মাসের বেশি থাকতে পারেননি অন্তর আলি। ইউরোপজুড়ে ঘোষণা হল, কাগজপত্র ছাড়া যেসব বাঙালি আছে তাদের ধরা হবে। এর আগে তাকে দেওয়া কার্ড রিনিউ করতে গেলে ধরা পড়ে যান। সেই অফিস তাকে পুলিসের হাতে তুলে দেয়। এরপর থানায় ১৫ দিন আর জেলে দুই মাস ছিলেন অন্তর আলি। জেলে গিয়ে জানতে পারেন এরপরও যদি সেখানে থাকতে চান তাহলে জেল হবে এক বছরের। তারপরও কোনও নিশ্চয়তা নেই থাকার। গত বছর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রক সূত্রে জানা যায়, শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার প্রতিরোধে সুদান, লিবিয়া ও মিশরে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ভিসা যাচাই-বাছাইয়ে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভিজিট ভিসার নামে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য থেকে যাওয়া বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিসহ অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। তারপরও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ না হওয়ার কারণ দু’টি বলে মনে করেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে লিবিয়াতে অস্থিতিশীলতার সুযোগে বহু মানবপাচারকারী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। অস্থিতিশীলতার কারণে অরক্ষিত হয়ে আছে লিবিয়ার সীমান্তগুলো। সেই কারণে আন্তর্জাতিক মানবপাচারচক্র ইউরোপে ঢোকার জন্য এই জায়গা ব্যবহার করছে। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদ্বাস্তুরাও এই পথ দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ইতালিতে প্রবেশ করা মানে হচ্ছে ইউরোপের ২৬টি দেশে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া। প্রত্যেকেই চিন্তা করে হয়তো বেঁচে যাব। বাংলাদেশিদের এই যে একটা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা –‘যে কোনও মূল্যে বিদেশ চলে যাব’ এটা যদি ভাঙা না যায় তাহলে বন্ধ করা সম্ভব না। কারণ ইউরোপ আগের অবস্থায় নেই। অবৈধভাবে গেলে কাজ পাওয়া যায় না। তাই এই বার্তা সবার কাছে পৌঁছানো উচিত যে কাগজপত্র ছাড়া ইউরোপে গেলে হয় জেলে যেতে হবে নয়তো ফেরত আসতে হবে।’ একইসঙ্গে তিনি বলেন, ইউরোপের পথে কিন্তু গরিব মানুষ যায় না। কারণ এতে ৮ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়। যারা যায় তাদের আর্থিক অবস্থা একেবারে খারাপ নয়। যারা এত টাকা খরচ করে এভাবে ইউরোপ যায়, তারা কিন্তু চাইলে দেশে ওই টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা করতে পারে।