সম্পত্তি সংস্কার বিষয়ে চিন্তাভাবনা ফলপ্রসূ হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি। যাবতীয় আটকে থাকা কাজের ক্ষেত্রে ... বিশদ
একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী যে-কোনও শাসকই ভুলে যায় সুস্থ বিতর্ক, বিরোধ আর গঠনমূলক সমালোচনাই আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মূল কথা। সংবিধান প্রণেতারা সেই দিকনির্দেশই করে গিয়েছেন। শুধু কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারই নয়, সামান্য একটা সমবায় কিংবা ছোট আবাসনের পরিচালন ক্ষমতা বছরের পর বছর দখলে রাখার নেশায় তাই ক্ষমতাধরেরা যাবতীয় শিষ্টাচারকে বিসর্জন দিতে পর্যন্ত কার্পণ্য করেন না। এটাই ক্ষমতাভোগীদের সবচেয়ে বড় অসুখ। অথচ ভারতের গণতান্ত্রিক পরম্পরা সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলে। আজকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পূর্বসূরি বিজেপির সর্বমান্য নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ি সংসদে একাধিকবার তাঁর বক্তৃতায় বলে গিয়েছেন, দল আসবে যাবে, সরকার তৈরি হবে, বিদায় নেবে, কিন্তু দেশ, দেশের লোকতান্ত্রিক কাঠামো যেন অটুট, অক্ষুণ্ণ থাকে। না-হলে বিপদ অনিবার্য। বাজপেয়িজি বুঝেছিলেন, সুস্থ বিরোধিতা, যুক্তিনির্ভর বিতর্ক আর সমালোচনা আমাদের সংসদীয় রাজনীতির প্রাণ। সরকার পক্ষ যতই শক্তিশালী হোক, ভারতের সংসদ কিন্তু মূলত বিরোধীদের। তাকে কোনওভাবে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা হলে, বিরোধীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে বাধ্য।
সাত দশকের চলার পথে সংবিধানের উপর আঘাত এসেছে বারে বারে। চতুর শাসক ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে বারে বারে সংবিধানকে ঘুরিয়ে ব্যবহার করার চেষ্টা যেমন করেছে, তেমনই নাগরিকদের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টাও হয়েছে বারে বারে। কিন্তু প্রতিবারই সাময়িক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সংবিধান আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে তার অন্তর্নিহিত শক্তির জোরে। এবারও শাসকের রক্তচক্ষুর মোকাবিলা করে আবার গণতন্ত্র আপন মর্যাদা ও সম্মান ফিরে পাবে বলেই মানুষের বিশ্বাস।
১৯৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধীর শাসনে জরুরি অবস্থা জারি ও মৌলিক অধিকার থেকে দেশবাসীকে বঞ্চিত করা ভারতীয় সংবিধানের উপর প্রথম বড় আঘাত। কার্যত সংবিধানকেই সেইসময় সাময়িকভাবে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। কালা কানুন ‘মিসা’ জারি করে দেশের তাবৎ বিরোধী নেতানেত্রীদের একতরফা গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল। কালা কানুনের দরুণ আইনি লড়াইও কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকী সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের উপরও আঘাত নেমে আসে। স্বাধীনতার পর ইন্দিরা জমানাতেই ভারতীয় সংবিধান প্রথম বড় ধাক্কা খেয়েছিল। আর গত এক বছরে দ্বিতীয়বারের মোদি জমানায় সংবিধানের উপর ক্রমাগত আঘাত নেমে এসেছে।
আগেই বলেছি, সংবিধান লিখতে আম্বেদকর ও তাঁর সহযোগীরা সময় নিয়েছিলেন দু’বছরেরও বেশি। ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শুরু করে ১৯৪৯-এর শেষার্ধ পর্যন্ত সংবিধান লেখার কাজ চলে। সংবিধান লেখা শেষ ও গৃহীত হয় ১৯৪৯-এর ২৬ নভেম্বর। আর তা কার্যকর করা শুরু হয় ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি। সেই থেকে ২৬ জানুয়ারি দিনটি ‘সাধারণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পরিচিত। মোদি সরকার এসেই ২০১৫ থেকে ২৬ নভেম্বর দিনটি পালন করছে ‘সংবিধান দিবস’ নামে। কিন্তু, সংবিধানের মূল আত্মা ভালো আছে কি? আজ এই প্রশ্নের মুখে গোটা দেশ এবং দেশের মানুষ।
গত এক বছরে সংবিধান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিছু কম হয়নি। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই মোদি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটান। ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারার সৌজন্যে স্বাধীনতার সময় থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছিল। সেই বিশেষ মর্যাদা শুধু কেড়েই নেওয়া হয়নি, পূর্ণ রাজ্যটিকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়েছে। আর তা করতে গিয়ে মাসের পর মাস উপত্যকায় সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলিকেই কেন্দ্র হরণ করে রেখেছে। এমনকী, ইন্টারনেট, টেলিফোনসহ দৈনন্দিন পরিষেবাগুলিকেও দিনের পর দিন বন্ধ রাখা হয়েছে। যার দরুণ সুপ্রিম কোর্টকে পর্যন্ত হালে বলতে হয়, ইন্টারনেট পরিষেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেইসঙ্গে আটক করে রাখা হয়েছে শতাধিক কাশ্মীরি নেতানেত্রীকে। কোনও মামলা বা শুনানি ছাড়াই তাঁরা কার্যত সেই আগস্ট মাস থেকে গৃহবন্দি। বহু এলাকায় এই সেদিন পর্যন্ত টেলিফোন ও মোবাইল পরিষেবা বন্ধ ছিল, বিমানবন্দর থেকে মূল শহরে প্রবেশের ছাড়পত্রও দেওয়া হচ্ছিল না। এক-দু’দিন নয়, মাসের পর মাস এমনটা চলেছে। তাঁদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় ওই রাজ্যের তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও আছেন। সামগ্রিকভাবেই এই একের পর এক ঘটনা পরম্পরা গণতন্ত্র রক্ষার মানদণ্ডে ভারতের অবস্থানকে নীচের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যেখানে শীর্ষ নেতানেত্রীরাই নিরাপদ নন, তাঁদের স্বাধীন চলাফেরাটুকুও নিয়ন্ত্রিত, সেখানে কীসের গণতন্ত্রের বড়াই! গণতন্ত্রই যেখানে বিপন্ন, সেখানে সংবিধানে লেখাজোখার দাম দেবে কে? এ প্রশ্ন অবান্তর নয়।
আর ৩৭০ নিয়ে যখন উত্তেজনা কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসছে, ঠিক তখনই মোদি সরকার আরেক নজির গড়ল নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন তৈরির বিতর্কিত বিলটিকে এনে, যেটি ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজনের এক মোক্ষম অস্ত্র মাত্র। স্বাধীনতা পরবর্তী সাত দশক অতিবাহিত হওয়ার পর দেশ যখন পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, ঠিক তখন কে নাগরিক আর কে নয়, তা নিরূপণ করতে নতুন উদ্যমে আইন সংশোধন করা হচ্ছে এবং গোটা দেশ তাতে উত্তপ্ত। এ এক বেনজির কাণ্ড। একবার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, ২০২৪-এর মধ্যে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীকে তাড়ানো হবে, আবার সেই তিনিই বলছেন, এই আইন কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়, নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য। এই স্ববিরোধিতা দেশবাসীর ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। বিজেপিরই অনেক ছোটবড় নেতা বলছেন, এনআরসি হবেই। আবার অন্য একদল বলছেন, আপাতত এনআরসি নাকি শুধু অসমেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে। তাহলে কোনটা ঠিক? দেশের মানুষ অত শত বোঝেন না। তাঁদের সব হাতে কাজ চাই। শিক্ষা চাই। বাসস্থান চাই। বিশুদ্ধ পানীয় জল চাই। সুলভে চিকিৎসার ব্যবস্থা চাই। সেইসঙ্গে চাই—সুবিচার, স্বাধীনতা এবং সামাজিক সাম্য। মানুষের এইসব মৌলিক চাহিদা থেকে চোখ ঘুরিয়ে দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বোকা বানানো যায় না। যাবেও না। সদা জাগ্রত দেশবাসী ইতিহাসের নিয়মেই ঘুরে দাঁড়াবে, প্রতিবাদে সোচ্চার হবে।
সংশোধিত নাগরিক আইনে বলা হয়েছে—পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে আসা হিন্দু সহ ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বলা বাহুল্য, ওই তালিকায় মুসলিমদের রাখা হয়নি। এই প্রথম ভারতীয় সংবিধানের কোনও আইনে ধর্মীয় বিভাজনের কথা বলা হল। একথা ঠিক, ওই তিনটি দেশই মুসলিমপ্রধান বা মুসলিমরাই সেখানে সংখ্যাগুরু। তবু, সংবিধানের শুরু থেকে ১৪ নম্বর ধারায় সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে যে সাম্য রক্ষার কথা বলা হয়েছিল, তা এই নতুন আইনে বড় মাপের ধাক্কা খেতে বাধ্য। কার্যত ভারতীয় সংবিধানকে পাকিস্তানের মতো ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে বার করে এনে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের করে তোলার চেষ্টা হলে সমূহ বিপদ। কারণ, ভারতের আত্মা ও সংবিধান ধর্ম জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠার কথাই বার বার বলে এসেছে। আম্বেদকর ও তাঁর সতীর্থদের অক্লান্ত শ্রমে রচিত সুবিশাল সংবিধানের ভিত্তিও সেই সমস্ত ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়ের আদর্শ বহন করছে।
গত সাত দশকের ইতিহাসে এই সংবিধান শতাধিক বার সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু, যে আদর্শ ও দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে এটি রচিত হয়েছিল, তাকে আগে এভাবে কেউ আহত করতে পারেনি। এমনও শোনা যাচ্ছে, সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ চালু করা। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে ধীরে ধীরে ভারতকে প্রকৃত হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার ষোলোকলা পূর্ণ হবে। তবে, একটা জিনিস পরিষ্কার যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে যেইমাত্র আমরা কট্টর হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের দিকে ছুটব, তখনই উদারবাদের পথটি হারিয়ে ভারত একটি কানাগলিতে আটকে যাবে, যা থেকে মুক্তিলাভ দুষ্করই হবে। এতে অপূরণীয় ক্ষতি হবে ঐতিহ্যশালী ভারতেরই। তাই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রটি অটুট রাখাই সব স্তরের মানুষের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। ৭১ তম সাধারণতন্ত্র দিবসে সংবিধান রক্ষারই শপথ গ্রহণ করুক প্রতিটি ভারতবাসী।