সম্পত্তি সংস্কার বিষয়ে চিন্তাভাবনা ফলপ্রসূ হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি। যাবতীয় আটকে থাকা কাজের ক্ষেত্রে ... বিশদ
আরও একটা বাজেট আসন্ন। কোনও সন্দেহ নেই ভারতের অর্থনীতি এখনও প্রবল টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বেকারত্ব গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক, জাতীয় গড় উৎপাদনের হার ছ’বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, দেশ-বিদেশের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তোপ দেগে চলেছেন... এই পরিস্থিতিতে বাজেট পেশ করা কঠিন চ্যালেঞ্জ। সেই কাজটাই শনিবার করতে চলেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। অর্থনীতি নিয়ে সাম্প্রতিক বৈঠকে তাঁকে দেখা যায়নি ঠিকই, তবে রাষ্ট্রমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের সঙ্গে হালুয়া উৎসব পালন করে ফেলেছেন। বিশেষজ্ঞরা চ্যানেলে চ্যানেলে বসে পড়েছেন বাজেট পূর্বাভাস দিতে। সঙ্গে অবশ্য বিশ্লেষণ চলছে, অর্থমন্ত্রীর হাতে এই বাজেট সংক্রান্ত ঠিক কতটা ক্ষমতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই যে এবার চালিকাশক্তি হয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন, তা গোটা দেশ দেখছে। তাই এই বাজেট নিয়ে নির্মলার থেকেও বেশি আশা-আতঙ্ক জমাট বেঁধে আছে নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশার আলো একটাই, যতই বেহাল হোক না কেন, তাঁর জমানার অর্থনৈতিক হাল সেই ‘মনমোহনী’ বাজেট পেশ করার সময়ের তুলনায় অন্তত ভালো। দেখা যাক, এবার সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ঠিক কী?
১) প্রথমেই আসতে হবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে। বাজেটে এমন কোনও পদক্ষেপ সরকারকে ঘোষণা করতেই হবে, যার মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আনাজ, আলু, পেঁয়াজ আগুন দাম। দৈনন্দিন বাজার করতেই মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। আর প্রবল লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদর। এর অবশ্য আর একটা কারণও রয়েছে—জিএসটি। নোট বাতিল ছোটখাট কোম্পানিগুলির কোমর ভেঙে দিয়েছিল। আর জিএসটি সোজা কথায় পথে বসিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপরও জিএসটি এমনভাবে মেঘ বিস্তার করে রেখেছে যে, নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনধারণই অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার এবং জিএসটি নির্ধারক কমিটিকে সবার আগে এদিকে নজর দিতে হবে। মানুষের হাতে টাকার জোগান নেই। বড় কোম্পানিগুলিতে লাগাতার ছাঁটাই হচ্ছে। এবং যাঁদের চাকরি যাচ্ছে, শত চেষ্টা করে তাঁরা নতুন চাকরি জোটাতে পারছেন না। ডিগ্রি বা অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও। কঠিন সত্যিটা হল, কোম্পানিগুলি খরচ কোনও মতেই বাড়াতে চাইছে না। লোকসান করে কর্মী নিয়োগ তারা করবে না। বাজারে পণ্যের চাহিদা থাকলে উৎপাদন বাড়বে, তখন না হয় কর্মসংস্থানের কথা ভাবা যাবে। আপাতত নয়। তাও বড় কোম্পানিগুলি কিছুটা হলেও ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে। বেহাল অবস্থা ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র সেক্টরের। এই এমএসএমই ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করার জন্য ১২ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ চেয়েছেন নীতিন গাদকারি। যদি এই সেক্টরকে চাঙ্গা করা যায়, তাহলে তা অর্থনীতির পক্ষে মঙ্গল হবে। কারণ এই ছোটখাট শিল্পগুলিতেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। তবে প্রস্তাব বা ভাবনা তো এই একটা নয়! আরও অনেক আছে। তার জন্য অর্থের জোগান হবে কীভাবে? এয়ার ইন্ডিয়ার ১০০ শতাংশ বেসরকারিকরণ করছে কেন্দ্র। পাশাপাশি তালিকায় রয়েছে ভারত পেট্রলিয়ামের মতো সংস্থাও। এ কথা সত্যি, লাভজনক সংস্থার শেয়ার বিক্রি না করলে কাঙ্ক্ষিত দাম সরকার পাবে না। যে সংস্থা ধুঁকছে, তার শেয়ার ছাড়লে কম দামই পাওয়া যাবে। আর সরকারের লক্ষ্য অর্থনীতির হাল ফেরানো। তাই নজরে লাভজনক সংস্থাই থাকবে। একইসঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোও জরুরি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেশের প্রায় সর্বত্র কাঁচা সব্জির দাম সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্র, বিশেষত কৃষি গবেষণায় বরাদ্দ বাড়িয়ে এবং পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দিলে এই সঙ্কট থেকে মুক্তির দিশা মিলতে পারে।
২) ব্যক্তিগত আয়কর। এখন আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে কোনও কর দিতে হয় না। আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা আয় পর্যন্ত কর দিতে হয় ৫ শতাংশ। পাঁচ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা আয়ের জন্যে ২০ শতাংশ এবং তার উপর ৩০ শতাংশ কর দিতে হয়। বছর খানেক হতে চলল, উৎপাদন ক্ষেত্রে বিপুল ধাক্কা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তলানিতে এসে ঠেকায় মরিয়া হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একটা পদক্ষেপ নিয়েছিল... কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত করে দেওয়া। ভাবনা ছিল, মুকেশ আম্বানি, আদানি, বিড়লাদের মতো ধনকুবেরদের কর্পোরেট কর কমিয়ে আনলে সেই বেঁচে যাওয়া টাকা তাঁরা এবং অন্যান্য সব বড় সংস্থাই উৎপাদনে বিনিয়োগ করবেন। কর্মসংস্থান বাড়বে, বাজারও গতি পাবে। বাস্তবে তা হয়নি। মাঝখান থেকে ব্যক্তিগত আয়করের সর্বোচ্চ স্ল্যাব নামিয়ে আনার দাবি প্রবল হয়েছে। আর তা হওয়ার সম্ভাবনাও বিলক্ষণ রয়েছে। কারণ, কর্পোরেট কর ২৫ শতাংশ, আর ব্যক্তিগত আয়কর ৩০ শতাংশ... এটা তো হতে পারে না! কাজেই আসন্ন বাজেটে ব্যক্তিগত আয়করের দিক থেকে সাধারণ চাকরিজীবীরা লাভবান হতে পারেন। তাও বিষয়টা সম্ভাবনা আকারেই আছে। তার কারণ, লোকসভা নির্বাচন সদ্য শেষ হয়েছে। আগামী চার বছর তো মোদি সরকার নিশ্চিন্ত! এখনই আয়করে বড় ছাড়ের মতো ঘোষণা করে দিলে ভোটের আগে কী হবে?এই প্রশ্ন আপাতত শনিবার পর্যন্ত সিন্দুকে তোলা থাক। এই কয়েকটা ঘণ্টা খানিক আশা নিয়ে ঘর করার মতো হোক। আসা যাক পরের সম্ভাবনায়।
৩) এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষ জীবনবিমা, পিপিএফের মতো খাতে সঞ্চয় বা বিনিয়োগ করে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় পেতে পারেন। এই খাতে ছাড়ের অঙ্কটা যদি সরকার আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্তও করে, তাহলে মানুষ বিনিয়োগ করার দিকে ঝুঁকবে। এর থেকে সরকারের কোষাগারে যে টাকাটা ঢুকবে, তা দিয়েও কেন্দ্রীয় সরকার পরিকাঠামো খাতে খরচ বাড়াতে পারবে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণের পর যে অর্থ হাতে আসবে, তাও এই খাতে ব্যয় করতে পারে কেন্দ্র। তাহলে বাজারে নগদের জোগান বাড়বে। এছাড়া বাজেটে ৫০ হাজার টাকার স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশনের অঙ্কটা বাড়িয়ে ৭৫ থেকে ৮০ হাজারে নিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারে কেন্দ্র। সেটাও সাধারণ চাকরিজীবীকে কিছুটা স্বস্তি দেবে।
৪) গৃহঋণের সুদে এখন আমরা আয়করে সরাসরি ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ছাড় পেয়ে থাকি। এই পরিমাণটা যদি বাড়ানো যায়, তাহলে ঋণ নিয়ে জমি বাড়ি কেনার দিকে মানুষ আরও বেশি করে ঝুঁকবে। লাভের মুখ দেখবে ব্যাঙ্কগুলি। তার উপর ৪৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দামের ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিনলে আয়করে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা করে রেখেছেন নির্মলা সীতারামন। ৪৫ লক্ষ টাকার উচ্চসীমা যদি আরও বাড়ানোর ঘোষণা এই বাজেটে হয়, সেটাও অদূর ভবিষ্যতে গৃহঋণের ক্ষেত্রে বাড়তি সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে। কারণ, কলকাতা শহরের মধ্যে ফ্ল্যাট কিনতে গেলে ৪৫ লক্ষ টাকার বাজেট অনেক সময়ই কম মনে হয়। অথচ, বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত চাকরিজীবীরা অনেকেই এখন এমন বেতন পান, যা দিয়ে লোন করে ৫০ লক্ষ টাকার বেশি দামি ফ্ল্যাট কেনাই যায়। আর যদি দিল্লি বা মুম্বইয়ের মতো শহরকে তালিকায় আনতে হয়, ৪৫ লক্ষ টাকার মধ্যে বলতে গেলে একটা বাথরুম আর একটা বারান্দা মিলতে পারে। কাজেই ৪৫ লক্ষ টাকার অঙ্কটাকে সরকার ৭০-৭৫ লক্ষে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলে মন্দ হয় না।
সার্বিকভাবে দেখতে গেলে, এই মুহূর্তে মোদি সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব। এই দুয়ের সাঁড়াশি চাপে আম ভারতীয়দের সঙ্কট প্রতিদিন বাড়ছে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে বুঝতে হবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে থাকলে তার প্রভাবটা কিন্তু রান্নাঘরের পাশাপাশি ভোটযন্ত্রেও পড়বে। পরের সপ্তাহেই দিল্লি নির্বাচন। তারপর একে একে অন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য বিধানসভা ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবং বিজেপিকে মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রায় সব রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেই তাদের ডুবতে হয়েছে। এই বাজেটে তাই সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত দু’টি—কর্মসংস্থান এবং বাজারে টাকার জোগান। একমাত্র তবেই বাজারে পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে। সেই চাহিদা পূরণ করতে গেলে উৎপাদন বাড়াতে হবে। এবং ভারতের অর্থনীতি ফের গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াবে। কিন্তু নির্মলা সীতারামনের বাজেট কি সেই দিশা দেখাবে? সেই কৌশলী এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার জোরও কি আছে মোদি সরকারের? উত্তর মিলবে ১ ফেব্রুয়ারি।
তবে নরেন্দ্র মোদির আক্ষেপ এখানেই একটাই হওয়া উচিত... তাঁর মন্ত্রিসভায় কোনও মনমোহন সিং নেই।