ধ্রুবানন্দ নামে এক ব্রহ্মচারী পুরীতে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে প্রভু জগন্নাথকে অর্পণ করতে গেলেন। বাধা পেলেন পাণ্ডাদের কাছে। অপমানিত, সাধু ধ্রুবানন্দ পুরী ত্যাগ করে চলে গেলেন নির্জনে। সেখানে মুক্ত প্রকৃতিতে শুয়ে তিনি একটি স্বপ্ন দেখলেন। শ্রীজগন্নাথদেব তাঁকে স্বপ্ন দিয়ে বলছেন ‘ধ্রুবানন্দ, তুমি মাহেশে যাও। মাহেশে গেলে তুমি আমাকে পাবে।’ সাধু মাহেশে আসেন। সেখানে গঙ্গাস্নান করেন। স্নানকালে তিনি জগন্নাথ মূর্তি পান ও সেই স্বপ্নে দেখা মূর্তির প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে মনে করেন, পুরীর শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবেরই আর এক রূপ হচ্ছে হুগলির মাহেশের জগন্নাথ মূর্তি। যিনি মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে প্রকটিত। ধ্রুবানন্দ জগন্নাথ মূর্তি পেয়েছিলেন নাকি নিমকাঠ পেয়েছিলেন যার মাধ্যমে তিনি স্বপ্নাদিষ্ট মূর্তি বানিয়েছিলেন, তা হল তর্কের বিষয়। তবে ধ্রুবানন্দই যে মাহেশের জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা মূর্তির প্রতিষ্ঠাতা এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
শেওড়াফুলি রাজবংশের রাজা মনোহরচন্দ্র রায় মাহেশে শ্রীজগন্নাথদেবের মন্দির প্রথম নির্মাণ করেন। তিনি জগন্নাথের সেবাকার্যের জন্য জগন্নাথপুর নামক একটি পল্লিও দান করেন। রাজা মনোহরচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত মাহেশের জগন্নাথ মন্দির যখন কালের নিয়মে ভেঙে পড়ল সপ্তগ্রামের নিমাইচরণ মল্লিক ৭০ ফুট উঁচু মন্দির নির্মাণ করেন।
বিশাল এলাকা নিয়ে মাহেশ শ্রীজগন্নাথের মন্দির। প্রবেশপথের দু’দিকে দুটি গরুড়। মন্দিরের দুয়ার থেকে সোজা তাকালেই শ্রীশ্রীজগন্নাথ দেবের দর্শন মেলে। বিশাল নাটমণ্ডপ। শিব মন্দির, কমলাকর পিপলাইয়ের সমাধি, শ্রীচৈতন্যদেব, নীলমাধবের মূর্তি, বজরংবলি, সংকটমোচন পরপর দর্শন করা যায়। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে অবস্থান করছেন শ্রীজগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা। ভোর সাড়ে চারটেয় মঙ্গলারতি হয়। সকাল সাতটায় পুজো শুরু। পুজো চলে ন’টা পর্যন্ত। ন’টার সময় বাল্যভোগ। ফল, মিষ্টি, মিছরি, মাখন থাকে বাল্যভোগে। বেলা বারোটায় ভোগ নিবেদন। খিচুড়ি ভোগ, ভাজা, শাকের তরকারি অন্নভোগে সাজানো থাকে। ভাজায় থাকে আলু, কাঁচকলা, করলা, বেগুন, কুমড়ো অথবা পটল। পঞ্চ ব্যঞ্জন। শাকের তরকারিতে পুঁই, কলমি ব্যতীত সব শাকই রান্নায় ব্যবহৃত হয়। জগন্নাথের অত্যন্ত প্রিয় হল অড়হর ডাল। তাই ভোগে অড়হর ডাল থাকে। কামিনী আতপ বা গোবিন্দভোগ চালের পোলাও থাকে দেবতার প্রসাদে। মন্দিরের সেবাইত সৌমেন অধিকারী মন্দিরের ভোগের নিয়মকানুন বলতে গিয়ে একটি দারুণ ছড়া বললেন, ‘খিচুড়ি, অন্ন, পায়েস, এই তিন নিয়ে মাহেশ।’ মালপোয়া দিয়ে শেষ হয় দুপুরের অন্ন ভোগের খাদ্য তালিকা। মাহেশ জগন্নাথ মন্দির খোলা থাকে সকাল পাঁচটা থেকে দুপুর বারোটা, বিকেল চারটে থেকে রাত আটটা। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি বিকেলের সময়ে একটু বদল ঘটে। রাত সাড়ে সাতটায় মন্দির বন্ধ হয়। বিকেল চারটায় একইসঙ্গে জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান ফটক ও গর্ভগৃহের দ্বার উন্মুক্ত হয়। মাহেশের তীর্থ প্রবর্তক ধ্রুবানন্দ স্বামী জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা মূর্তির পুজো করতেন কিন্তু ধ্রুবানন্দের যখন বয়স হল তখন তিনি ভাবলেন এবার পুজোর কী হবে? ঈশ্বর নিজের উপায় নিজেই বের করলেন। কমলাকর পিপলাই-এর বাড়িতে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব একদিন অতিথি হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পুরী যাওয়ার পথে মহাপ্রভু প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য কমলাকরের গৃহে অতিথি হন। তিনি কমলাকরকে বলেন, ‘আমার মতো এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী প্রভু জগন্নাথের পদে আত্মসমর্পণ করে তাঁরই সেবায় নিযুক্ত। এখন তাঁর অন্তিমকাল উপস্থিত। জগন্নাথের পতিতপাবন রূপ তুমি কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছ। তোমাকে তাঁর সেবা ও পূজার ভার গ্রহণ করতে হবে।’ কমলাকর পিপলাই বলেছিলেন, ‘প্রভু, আমি কোথায় গেলে তাঁর সাক্ষাৎ পাব?’ মহাপ্রভু বলেছিলেন, ‘সুতানুটির সাত ক্রোশ পশ্চিমে নতুন যে তীর্থ মাহেশ সেখানেই তাঁরা অবস্থান করছেন।’ কমলাকর পিপলাই চললেন মাহেশের পথে। মাহেশে এসে ধ্রুবানন্দ স্বামীর কাছ থেকে জগন্নাথদেবের পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করে কৃতার্থ হলেন। ধ্রুবানন্দ দেহ রাখলেন। কমলাকর পিপলাইয়ের বংশধরেরা মাহেশের অধিকারী নামে পরিচিত। তাঁরা বংশানুক্রমে জগন্নাথের সেবা করে আসছেন।
স্নানযাত্রার দিন সকালবেলায় গর্ভগৃহের বাইরে চাতালে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি আনা হয়। তিথির সময় ধরে মন্দিরের উত্তর দরজা দিয়ে দেবতাদের মন্দির সংলগ্ন উন্মুক্ত প্রান্তরে স্নানমঞ্চে নিয়ে আসা হয়। শেওড়াফুলির রাজ পরিবারের তরফ থেকে শ্রীজগন্নাথদেবের মাথার ওপর ছাতা ধরা হয়। প্রথমে বলভদ্র, তারপর জগন্নাথ ও শেষে সুভদ্রার স্নান সম্পন্ন হয়। রিষড়ার কুমোরবাড়ি থেকে জল আসে। ভাদ্র মাসের ভরাকোটালের জল কলাপাতা দিয়ে মুড়ে কর্পূর দিয়ে রাখা থাকে। সেই পবিত্র গঙ্গাজল এবং স্নানযাত্রার দিন গঙ্গায় জোয়ার এলে তার জলও সামান্য সংগ্রহ করে স্নানযাত্রায় দেবতাকে নিবেদন করা হয় মোট ১৮ ঘড়া জল, দেড় মন দুধ লাগে দেবতাদের স্নানে। সূর্য ডোবার আগে মন্দিরে দেবতাদের নিয়ে আসা হয়। গর্ভগৃহে দেবতারা প্রবেশ করলে সন্ধ্যায় আরতি হয়। মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ দিন দ্বার বন্ধ থাকে। ১৮ ঘড়া জল আর দেড় মন দুধে স্নানের পর জগন্নাথদেবের জ্বর আসে। সৌমেনবাবু বলছিলেন, আমরা জগন্নাথদেবের কপালে উত্তাপ অনুভব করি, প্রবল জ্বর থাকে। আরামবাগ, গোঘাট, খানাকুল, মেদিনীপুর থেকে কবিরাজ আসেন। পাঁচন দেন। দেবতারা আরোগ্য লাভ করেন। তারপর ভাস্কর অঙ্গরাগ করেন। অমাবস্যায় নবযৌবন, প্রাণপ্রতিষ্ঠা, অভিষেক ও চক্ষুদান সম্পন্ন হয়। শুক্লা দ্বিতীয়ায় দেবতারা রথে ওঠেন। সে আলাদা উৎসব। স্নানযাত্রার পরই এই রথযাত্রা উৎসব। কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার নকশায় লিখছেন, ‘পূর্বে স্নানযাত্রার বড় ধুম ছিল—বড় বড় বাবুরা পিনেস, কলের জাহাজ, বোট ও বজরা ভাড়া করে মাহেশে যেতেন, গঙ্গায় বাচ খেলা হত। স্নানযাত্রার ... মাঠে লোকারণ্য, বেদিমণ্ডপ হতে গঙ্গাতীর পর্যন্ত লোকের ঠেল মেরেছে; এর ভেতরেই নানাপ্রকার দোকান বসে গ্যাচে, ভিকিরিরা কাপড় পেতে বসে ভিক্ষে কচ্চে, গায়েনরা গাচ্চে, আনন্দ লহরী, একতারা খঞ্জনী ও বাঁয়া নিয়ে বষ্টুমরা বিলক্ষণ পয়সা কুড়ুচ্চে।’
মাহেশের বর্তমান রথটি ১২৯২ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্যামবাজার বসু পরিবারের দেওয়ান জগন্নাথ ভক্ত কৃষ্ণচন্দ্র বসু আনুমানিক প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ করে এই রথ নির্মাণ করিয়ে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবকে উৎসর্গ করেন। রথটি তৈরি করেছিল মার্টিন বার্ন কোম্পানি। রথের উচ্চতা ৫০ ফুট। সম্পূর্ণ ইস্পাতের উপর কাঠের পাঠাতনে মোড়া ১২৫ টন ওজনের রথটি চারতলা বিশিষ্ট। রথের চূড়া নয়টি। এক ফুট বেড়ের বারোটি চাকা রথটিকে চলতে সাহায্য করে। চতুর্থ তলে রয়েছে শ্রীজগন্নাথদেবের সিংহাসন। প্রথম তলে শ্রীচৈতন্যলীলা, দ্বিতীয় তলে শ্রীকৃষ্ণলীলা ও তৃতীয় তলে শ্রীরামলীলা চিত্রিত। মোট ৯৬ জোড়া চোখ রথে আঁকা আছে। রথের দড়ি দুটি। ম্যানিলা রোপ। যার পরিধি ১০ ইঞ্চি। প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১০০ গজ। রথে দুটি ঘোড়া থাকে। তামার তৈরি ঘোড়াদুটির রং নীল ও সাদা। কাঠের সারথি রথ চালাতে সাহায্য করেন বলে বিশ্বাস। দুটি প্রমাণ মাপের রাজহাঁস রথের শোভা বর্ধন করছে। মাহেশ হল একটি শ্রীপাট।
‘নীলাচলে পুরুষোত্তম জগন্নাথ নাম।/সেই নাম প্রকট হয় মাহেশের ধাম।।/নিত্য পূজা নিত্য ভোগ নিত্য শাস্ত্রপাঠ।/ ভক্তজনে জানে তাই মাহেশ শ্রীপাট।।’
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মাহেশের রথে এসেছিলেন। তখন ছিল কাঠের রথ। ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’তে লেখা আছে, ‘মাহেশ নামেতে গ্রাম গঙ্গাকূলে স্থিতি।/ অনেক লোকের বাস নানাবিধ জাতি।।/এই মহাভাগবত বসু বলরাম।/ তাঁর পূর্বপুরুষদিগের কীর্তিধাম।।/ সুন্দর মন্দিরে জগন্নাথের মূরতি।/ভোগরাগ সহ হয় সেবা নিতি নিতি।। /বিশেষে আষাঢ়ে মহাসমারোহ হয়। / বৃহৎ কাঠের রথ উচ্চ অতিশয়।।’
কলকাতার শ্যামবাজার থেকে কৃষ্ণরাম বসুর পরিবারের লোকজন মাহেশে আসেন। এখানে কীর্তন চলে। প্রথমে তিনটি নারায়ণ, তারপর মা সুভদ্রার মূর্তি, বলভদ্রদেব ও শেষে শ্রী জগন্নাথদেবকে রথে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ছয় সাতটি শালগ্রাম শিলাও রথে থাকে। জগন্নাথরূপী শালগ্রাম শিলার নাম দামোদর। দড়ি দিয়ে কপিকলের মাধ্যমে সুভদ্রা, বলভদ্র, জগন্নাথদেবকে রথের উপর চড়ানো হয়। যেখানে মূল সিংহাসনে শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর দাদা ও বোনকে নিয়ে জগতের সব কলুষতা মুক্ত করার লক্ষ্যে কৃপাদৃষ্টি প্রসারিত করেন।
উচ্চ, নিচ, ধনী দরিদ্র সকলেই রথে উঠতে পারেন। রথে শ্রীজগন্নাথদেব উঠলেই তিনি বিশ্বম্ভর মূর্তি ধারণ করেন। রথের উপরে তিন দেবতার শোধন হয়। ১০-১৫ মিনিটের পুজো হয়। শালগ্রামের অর্চনা হয়। তারপর রথ টানা হয়।
রথ এগিয়ে যায় মাসির বাড়ির দিকে। মাসির বাড়িতে সারা বছর নিত্যদিন গোপীনাথের পুজো হয়। মাসির বাড়িতে গেলে জগন্নাথবাড়ির পুরোহিতরা একই নিয়মে ওই মন্দিরে গিয়ে পুজো করে আসেন। রন্ধনশালায় রান্না হয়। কদিন দেবতার উদ্দেশে ভোগ মাসির বাড়িতেই নিবেদিত হয়। হেরাপঞ্চমী উৎসব পালিত হয় পঞ্চমীতে। লক্ষ্মীর সঙ্গে জগন্নাথের বাদানুবাদ হয়। মাহেশে পুরোহিত ছড়া কেটে জগন্নাথকে বশীকরণ করেন। এ ছড়া আসলে প্রতীকী। দেব জগন্নাথ মা লক্ষ্মীকে ছেড়ে মাসির বাড়ি এসেছেন। এই ন’দিন মা লক্ষ্মী ভিক্ষা করেন। অষ্টধাতু নির্মিত লক্ষ্মী মূর্তিকে জগন্নাথ মন্দির থেকে মাসির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। মা লক্ষ্মী সেখানে গিয়ে সর্ষেপোড়া দিয়ে জগন্নাথকে বশ করে আসেন। উল্টোরথে শ্রীজগন্নাথদেব মন্দিরে ফেরেন। একই পদ্ধতি। ফিরতে ফিরতে রাত ৭ টা, ৭.৩০ হয়ে যায়। সাড়ে আটটার পরে শুরু হয় দেবদর্শন। দেবতার সেই বেশ দেখা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। দেবতার চোখে মুখে যেন ঘরে ফেরার আনন্দ ফুটে ওঠে। রাত নটায় মন্দির বন্ধ হয়। এই বছর মাহেশের রথ পা দেবে ৬২৮ বছরে। রথযাত্রা পড়েছে মোক্ষযোগে। ফলে এবার প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক।