রথ শব্দটি এসেছে রম্ ধাতু থেকে। যার অর্থ ক্রীড়া, আনন্দ। আর যাত্রার অর্থ গমন, ভ্রমণ, বিশেষ উৎসব। ফলে রথযাত্রার মানেও তাই গমন, ভ্রমণ ও বিশেষ উৎসব। এখানে প্রধানত অর্থ হল উৎসব।
প্রাচীন ভারতে শিব, বিষ্ণু, সূর্য ও দেবী ভগবতীকে কেন্দ্র করে রথযাত্রা প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধ ও জৈনদের মধ্যেও বুদ্ধ ও মহাবীরকে নিয়ে রথ খুব প্রচলিত ও জনপ্রিয় ছিল। কে বা কারা এটি প্রথম চালু করেন সে নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কারও মতে হিন্দুরাই প্রথম রথ শুরু করেন। অবশ্য বৌদ্ধ ও জৈনদের এই কৃতিত্ব বলে অনেকে দাবি করেন। তবে উপনিষদের যুগ নিশ্চয় বুদ্ধদেবের পূর্ববর্তী। কঠোপনিষদে খুবই স্পষ্টভাবে রথের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য সে রথ যে রথযাত্রা রূপে ব্যবহৃত হতো, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রবর্তন বা শুরু যাঁরাই করুক, এখন রথযাত্রা মানে পুরীর জগন্নাথের রথযাত্রা। অন্য সব রথযাত্রা যেন মিশে গেছে অথবা অন্যভাবে বলা যায়, অন্যসব রথযাত্রাকে জগন্নাথের রথ গ্রাস করে নিয়েছে।
আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে রথযাত্রা। পুরীর রথযাত্রা সমারোহে হলেও, প্রতি বছর বাংলার সর্বত্র ছোট বড় নানা প্রকার রথ হয়। পুরীর জগন্নাথের রথ কবে শুরু হয়েছিল, জানা না থাকলেও কম করে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরাতন এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পুরাণে বিশেষ করে পদ্মপুরাণ ও স্কন্দপুরাণে শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথের রথের উল্লেখ ও বর্ণনা পাওয়া যায়। অনেক পণ্ডিতের মতে দ্বারকা থেকে শ্রীকৃষ্ণের ব্রজে আসার যে ঘটনা তা-ই হল রথযাত্রার মূল।
পুরাণ কাহিনি
জগন্নাথের পৌরাণিক কাহিনি একটু সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক। যদুবংশ ধ্বংসের পর শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগ হয়। তাঁর মৃত দেহ একটি গাছের নীচে পড়ে ছিল। তখন কয়েক জন ভক্ত সেই দেহ থেকে কয়েকটি অস্থি তুলে রাখেন।
এদিকে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ঠিক করলেন বিষ্ণুর পুজো করবেন। কে এই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন? তিনি ছিলেন উজ্জয়িনীর সূর্যবংশীয় রাজা। বিষ্ণুর ভক্ত। একদিন বিষ্ণুর পুজো করবেন স্থির করে স্থান খুঁজতে খুঁজতে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে আসেন। সেখানে যাগ যজ্ঞ করেন। বিষ্ণুর মন্দির তৈরি করার ইচ্ছা। কিন্তু কোন মূর্তিতে পুজো করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। স্বয়ং বিষ্ণু স্বপ্নে জানান তাঁর সনাতনী মূর্তি তৈরি করে তার মধ্যে কৃষ্ণের অস্থি প্রতিষ্ঠা করতে। এবং আরও জানান সমুদ্রের তীরে ভেসে আসবে একটি কাঠ। সেই কাঠ দিয়ে তৈরি হবে মূর্তি। পরদিন ভোরে রাজা সমুদ্রের তীরে গিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যি একটা কাঠ ভেসে এসেছে। রাজা আনন্দে নিজে মূর্তি করবেন স্থির করলেন। এমন সময় স্বয়ং বিষ্ণু ছদ্মবেশে বিশ্বকর্মাকে সেখানে নিয়ে হাজির হন। বিশ্বকর্মার উপর ভার দেন মূর্তি তৈরির। রাজা তখন শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি করতে আদেশ করেন। কিন্তু প্রবল আগ্রহের কারণে সময়ের আগেই দরজা খোলা হয়। ভেতরে তখন অসমাপ্ত তিন মূর্তি। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তখন ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করেন, এখন কী করা কর্তব্য? ব্রহ্মা তখন এই মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে নিজে পুজো করেন। এই হল শ্রীবিষ্ণুর দারুমূর্তি।
প্রবাদ আছে যে, এক অনার্য শবররাজ তাঁর নাম বিশ্বাবসু তিনি নীলাচলে নীলমাধবের পুজো করতেন নীলগিরি পর্বতে। তবে তিনি তা কাউকে জানতে দিতেন না,পুজো করতেন খুবই গোপনে। পরে নীলমাধব অন্তর্হিত হয়ে দারুময় শ্রীজগন্নাথ মূর্তি রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
শ্রীক্ষেত্রে বৈষ্ণবদের সঙ্গে শাক্তদেরও প্রভাব দেখা যায়। মহাদেবী বিমলা এখানে বিরাজ করছেন। বিমলা মায়ের ভৈরব হলেন শ্রীজগন্নাথ। তাই পঞ্চমকারের বিকল্প এখানে নিত্য সেবাতে নিবেদন করা হয়। এছাড়া সপ্তমাতৃকা মন্দির, চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরও দেখা যায়।
অনেক গবেষকের মতে বৌদ্ধদের ত্রিরত্নের সঙ্গে এই তিন মূর্তির মিল রয়েছে। ফা হিয়েন ও হিউ-এন-সাং এর লেখাতে পাওয়া যায়, প্রাচীন কালে বুদ্ধদেবের দাঁত ও তাঁর মূর্তি নিয়ে রথযাত্রা করা হতো। বৌদ্ধদের রথযাত্রার একটি বিবর্তিত রূপ এই জগন্নাথের রথযাত্রা— এ কথা অনেকে মনে করেন। পরে শংকরাচার্যের সময় তা হিন্দু অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। বুদ্ধ হলেন জগন্নাথ। সঙ্ঘ হলেন বলভদ্র। আর ধর্ম হলেন সুভদ্রা। বৈষ্ণবতন্ত্রে সুভদ্রা হলেন মহাদেবী ভুবনেশ্বরী।
কেমন হয় পুরীর রথ?
স্নানযাত্রার পর জগন্নাথের দর্শন বন্ধই থাকে। রথের দিন সকাল নটা নাগাদ পুজোর পরে খিচুড়ি, পিঠে প্রভৃতি ভোগ দেওয়া হয়। এরপর দয়িতাপতিদের কাঁধে চেপে জগন্নাথ বাইরে আসেন। প্রথমে আসেন সুভদ্রা, বলরাম। আর শেষে আসেন জগন্নাথ।
রথযাত্রা শুরু হয় মন্দিরের সামনের সিংহদ্বার থেকে। তিনটি বিশাল আকারের রথ। রথে তোলার এই পর্বটিকে বলে ‘পাহাণ্ডী যাত্রা’। ধীরে ধীরে থামতে থামতে হেলে দুলে, বিশাল মুকুট পরে জগন্নাথ রথে ওঠেন। তিনটি রথ পর পর কিছুটা দূরে ‘বড়দাণ্ড’ বা প্রধান রাস্তার উপরে রাখা থাকে।
জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ। অধিষ্ঠাতা দেবতা হলেন নৃসিংহদেব। রথের কাঠামোর উপর চূড়া থেকে রঙিন কাপড় দিয়ে ঢাকা হয়। ১০৯০ মিটার কাপড় লাগে। লাল আর হলুদ রঙের কাপড় থাকে। রথের চূড়াতে থাকে গরুড়ের মূর্তি।
এর পর বলভদ্রের রথ। রথের রজ্জুর নাম ‘বাসুকী’। সুভদ্রার রথের নাম ‘দর্পদলন’। অধিষ্ঠাত্রী দেবী জয়দুর্গা। কলসের উপর ধ্বজের নাম পদ্মধ্বজ। সারথি হলেন অর্জুন। রথের রজ্জুর নাম ‘স্বর্ণচূড়া’।
রথের দিন সকালে ভোগ ঘরে পুজো হোম করে রান্না শুরু হয়। ফল, মিষ্টি নানা রকমের পিঠে, খিচুড়ি প্রভৃতি ভোগ দেওয়া হয়। এই সময় ‘টাকুয়া’ নিবেদন করা হয়। টাকুয়া হল আমের রস। শবরজাতির লোকেদের খুব প্রিয় পানীয়। দেবতাদের যাত্রার আগে এই হল খাওয়া দাওয়া। এর পর মোটা কাপড় দিয়ে তিনটি মূর্তিকে ভালো করে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে টানাটানিতে কোনও অসুবিধা না হয়।
এবার শোভাযাত্রা বা ‘পহাণ্ডী’। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষ্ঠান। রত্ন সিংহাসন থেকে ভক্তদের ধরা দেবেন বলে পথের ধূলায় নেমে আসেন ভগবান। সকল শ্রেণির মানুষ একবার স্পর্শ করতে পারলে নিজের জীবনকে সার্থক বলে মনে করেন। তাই ভক্তেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন।
প্রথমে এক দৌড়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুদর্শনকে। রাখা হয় দেবী সুভদ্রার রথে। সুদর্শন চক্রের স্থান ধর্মরূপী সুভদ্রার রথে। এরপর বলরাম। তারপর দেবী সুভদ্রা। সবশেষে শ্রীজগন্নাথ। বহু প্রতিক্ষার পর এই শুভ দর্শন। বাজনার তালে তালে নাচতে নাচতে বিশাল নয়নের দৃষ্টিতে সকলকে আপ্লুত করে প্রভু রথে ওঠেন।
এরপর হয় ভারী মজার একটি অনুষ্ঠান। পুরীর গজপতি রাজা নিজে আসেন শোভাযাত্রা করে। হাতে থাকে সোনার ঝাঁটা। রাজা অনঙ্গ ভীমদেবের সময় থেকে এই প্রথা আজও চলে আসছে। একে স্থানীয় ভাষায় ‘ছেড়াপহরা’ বলে।
একটি বেশ মজার ঐতিহাসিক কাহিনি রয়েছে এই নিয়ে। পঞ্চদশ শতকের কথা। তখন রাজা হলেন গজপতি পুরুষোত্তমদেব। তিনি দক্ষিণ ভারতে কাঞ্চী প্রদেশের রাজকন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। রাজকুমারী পদ্মাবতী ছিলেন অসামান্য সুন্দরী। বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হল কাঞ্চির রাজার কাছে। কিন্তু উত্তরে রাজা জানান যে, যে রাজা ‘ঝাড়ুদার’এর কাজ করেন তার হাতে তিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই প্রথা চলে আসছে। সোনার ঝাড়ু নিয়ে রাজা নিজে রথের সময় রথ ও চারপাশ পরিষ্কার করেন। অতএব তিনি ঝাডুদার। কলিঙ্গ রাজ ওই কথা শুনে খুবই রেগে গেলেন। ঠিক করলেন যুদ্ধে কাঞ্চিরাজকে পরাজিত করে মেয়েকে বন্দি করে নিয়ে আসবেন। সেই মতো যুদ্ধের ব্যবস্থা করে সৈন্য সামন্ত নিয়ে নিজে কাঞ্চি যাত্রা করলেন।
এদিকে জগন্নাথ পড়লেন চিন্তায়। তাঁর ভক্তকে ‘ঝাড়ুদার’ এই অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। সেই ভেবে বলরামকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘোড়ায় চড়ে চললেন। সশস্ত্র সেনার বেশ ধরে চললেন আগে আগে। রাজা পৌঁছবার আগেই যুদ্ধ করে কাঞ্চিরাজকে পরাজিত করলেন। এর কিছু সময় পরে কলিঙ্গরাজ হাজির হলেন সৈন্য সামন্ত নিয়ে। পরাজিত রাজার কন্যাকে তিনি বন্দি করে নিয়ে চলে এলেন। রাজকন্যার সঙ্গে রাজা সেখানকার বিখ্যাত গণেশ মূর্তিও নিয়ে এলেন। ওই গণেশ বর্তমানে জগন্নাথ মন্দিরের পেছনের দিকে ‘কাঞ্চিগণেশ’ নামে আজও বিরাজ করছেন। নাট মন্দিরের দেওয়ালে জগন্নাথ ও বলরামের সেনার বেশে কাঞ্চি বিজয়ের মূর্তিও দেখা যায়। ছদ্মবেশে এই কাঞ্চি বিজয়ের কৃতিত্ব জগন্নাথ-বলরামের।
দেশে ফিরে এলেন সকলে। সেনাপতি বন্দি রাজকন্যাকে রাজার সামনে পেশ করলেন। কী শাস্তি দেওয়া হবে এই বন্দির? তখন রাজা বললেন— ‘এই মেয়েকে ঝাড়ুদারের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়া হোক।’ মন্ত্রী খুব বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ ছিলেন। তিনি রাজকন্যাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দিলেন।
সে বছর রথের সময় যথারীতি পুরীর রাজা ঝাড়ু হাতে রথ পরিষ্কার করছেন। সেই সময় কাঞ্চি রাজকন্যাকে মন্ত্রী রাজার কাছে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন— ‘আজ কাঞ্চিরাজ কুমারীকে রাজার নির্দেশ মতো ঝাডুদারের কাছেই নিয়ে আসা হল—তিনি যেন তাঁকে গ্রহণ করেন।’ জগন্নাথকে সাক্ষী রেখে রাজকন্যা বরমালা দান করলেন। এই ঘটনা তাই একটি মধুর মিলনের সাক্ষী হয়ে রইল।
রথ তিনটি ধীরে ধীরে বড়দণ্ডে টানা হয়। হাজার হাজার ভক্ত নাম সংকীর্তন করতে করতে সঙ্গে চলতে থাকেন। গুণ্ডিচার দিকে রথ চলতে থাকে। দেশ বিদেশের নানা ভক্ত পুণ্যার্থী সমবেত হন এই দুর্লভ দৃশ্য দেখার জন্য।
কেন এই রথযাত্রা?
মন্দিরে দেবতার নিত্য আরাধনা পুজো হয়েই থাকে। কিন্তু সেই দেবমূর্তিকে নিয়ে রথের উৎসব প্রবর্তনের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? বিশেষ বিশেষ তিথিতে মন্দিরে নানা উপচারে পুজো হয়। অনেক ভক্ত সেখানে উপস্থিত থাকেন। এ সব ঠিক আছে। কিন্তু বিগ্রহকে নিয়ে রথে চড়িয়ে ভ্রমণের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? আমরা সম্ভাব্য কিছু কারণ খোঁজার চেষ্টা করি।
প্রথমত, যে দেবতার উপাসনা করা হয়, সেই দেবতাকে আরও নানা ভাবে সম্ভোগ ও বিলাসের ইচ্ছা থেকে এই বিচিত্র উৎসবের সূচনা। প্রাণের প্রিয় দেবদেবীকে তাঁর ভক্তরা নানাভাবে আস্বাদন করে আনন্দ পেতে চায়।
দ্বিতীয়ত, বিশেষ দিনে বা তিথিতে মন্দিরে ভক্তের সমাগম হয়। অনেকরকম পুজোর বিধি ইত্যাদি থাকে ঠিকই, কিন্তু তা দৈনন্দিন পুজোর খানিকটা বর্ধিত রূপ। মানুষের স্বাভাবিক মনের ভাব হল একই জিনিস দীর্ঘদিন গ্রহণ না করা। কিছুটা বৈচিত্র্য সাধারণ মন আশা করে। তাই একঘেয়েমি ও মনের অবসাদ কাটাতে কিছুটা পরিবর্তন স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে এই রথযাত্রার প্রচলন একটি অতি উজ্জ্বল বৈচিত্র্যপূর্ণ সংযোজন, সন্দেহ নেই।
তৃতীয়ত, প্রাত্যহিক পুজো বা বিশেষ দিনে অনুষ্ঠানের থেকে একটা পৃথক চমৎকারিত্ব ও জাঁকজকমের ব্যাপার নিশ্চয়ই এখানে রয়েছে। বহু মানুষকে আকর্ষণ করার পক্ষে এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিশ্চয়ই রয়েছে।
চতুর্থত, রথযাত্রার মধ্যে ব্যষ্টির আনন্দ যাতে সমষ্টি আনন্দে পর্যবসিত হয়, তার একটা প্রয়াস লক্ষ করা যায়। মুষ্টিমেয় মানুষ বা যারা ভক্ত নয়, সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তা ছাড়া জগন্নাথ শব্দের অর্থও তো তাই। জগতের নাথ তিনি। সকলকে যুক্ত করতে না পারলে তা সার্বজনীন হয় কী করে? সমাজের অভিজাত থেকে নিম্নবর্ণ সকলের এখানে অংশগ্রহণের অধিকার। রাজাধিরাজ থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ দীন দরিদ্র, অন্ত্যজ সকলের অধিকার সমান এখানে। উৎসবের আনন্দ সকলে সমান ভাগে ভাগ করে নিতে পারে।
ভক্ত এমনকী অভক্তেরও কোনও বাধা নেই এই আনন্দ উৎসবে। তাই ক্ষুদ্র স্বার্থপরতার সংকীর্ণ গণ্ডীকে ভেঙে ফেলার ইচ্ছা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে জাগ্রত ছিল। রথযাত্রা সেই সীমানা ভঙ্গের সচেতন প্রয়াস বলে মনে হয়। আমাদের পূর্ব পুরুষগণ যে সমাজে ধর্মের বিশেষ অধিকারের অবসান চাইতেন, সকলকে নিয়ে মিলিত সমাজের কথা ভাবতেন এটি তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। ধর্মকে কেন্দ্র করে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার চিন্তা পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়েছে কি না ভেবে দেখার বিষয়।
অবশেষে বলি ধর্মকে সার্বজনীন করে তুলতে না পারলে, তার দ্বারা সকলের উপকার হয় না। কিছু মানুষের সাহায্য হয়তো হতে পারে কিন্তু সকলের জন্য চাই। সকলের অংশগ্রহণ ও ধর্মের সরলীকরণ। আধুনিক যুগে আমরা সব কিছু প্রযুক্তি যা মানুষের কাছে আসছে তার মধ্যে একটা কথা প্রায়শই শোনা যায়, তা হল ইউজার ফ্রেন্ডলি ভাবলে অবাক হতে হয় আমাদের পূর্বপুরুষগণ কত আধুনিক মনের ছিলেন। রথ হল ভ্রাম্যমাণ মন্দির। যে মন্দির ছিল অচল, যে দেব বিগ্রহ ছিল স্থানু, সেই মন্দির ও দেবতা যেন হাজির হয়েছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে।
যে জীব সংসার মায়ায় বদ্ধ হয়ে নিজের জীবনের সামনে দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে, সেখানে তো দেবতাকে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের ঘুম ভাঙাতে। রবীন্দ্রনাথ তাই তো বলছেন—‘যদি এ আমার হৃদয় দুয়ার, বন্ধ রহে গো কভু/ দ্বার ভেঙ্গে তুমি এসো মোর প্রাণে, ফিরিয়া যেও না কভু।’
কামনা বাসনায় বদ্ধ আমি তো দুয়ার বন্ধ করে রাখবই। কিন্তু তা বলে তুমি যেন ফিরে যেও না। তুমি আমার প্রাণে এসো।
ফলে এই ভ্রাম্যমাণ মন্দির ও দেবতাকে দর্শন করে ধন্য হও। উৎসবের আনন্দে শামিল হও। রথকে স্পর্শ করার জন্য, একটু দর্শনের জন্য মানুষের কী প্রবল আগ্রহ উৎসাহ। কেবল রথস্থ দেবতাকে ভক্তি ভরে দর্শন করলেই জন্ম-মৃত্যুর এই চক্র থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
এখন মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেবল রথে ভগবানকে দর্শন করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। এটা কি সত্যি হতে পারে? এত সহজে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে লাভ? তা হলে তো লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই প্রসঙ্গে শ্রীমা সারদা দেবী বলেছেন— ‘যখন পুরীতে জগন্নাথ দর্শন করি, এত লোকে জগন্নাথদর্শন করছে দেখে আনন্দে কাঁদলুম, ভাবলুম – আহা বেশ, এত লোক মুক্ত হয়ে যাবে! শেষে দেখি যে না, যারা বাসনাশূন্য সেই এক-আধটি মুক্ত হবে। এমন ভক্তি, এমন নির্বাসনা হলে নিশ্চয়ই হয়।’
রথযাত্রার তাৎপর্য কী?
প্রকৃত পক্ষে এই রথ ও রথস্থ দেবতা প্রতীকী। স্থূল থেকে সূক্ষ্ম– দেহ থেকে আত্মার গতি হল রথের যাত্রা পথ। মানুষের সমগ্র জীবন হল যাত্রা। সীমা থেকে অসীমে যাত্রা। জীবভূত থেকে ব্রহ্মভূতে যাত্রা। চরৈবেতি চরৈবেতি। যখন জীবনের সেই সত্যকে তুমি লাভ করবে, কেবল তখনই তোমার জীবন রথের যাত্রা শেষ। সাময়িক বিশ্রামের জন্য মাসির বাড়ি। আবার পুনর্যাত্রা।
এর মাধ্যমে বেদান্তের গভীর দার্শনিক ভাবনাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে — ‘আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু’। এই দেহ হল রথ আর ভেতরে রয়েছেন আত্মা। অর্থাৎ দেহরূপ রথে ভগবানকে বসাও। দেহের মধ্যে আত্মাকে দর্শন কর। এই অভিজ্ঞতার আনন্দই প্রকৃত রথযাত্রার আনন্দ। ভক্তদের ব্যাকুল প্রার্থনা— ‘জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে’।