উপমহাদেশের অশান্তিতে লাভ কার?
রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ক’দিন আগেই একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘ভারত এবং চীনের মধ্যে টেনশন বজায় রাখার জন্য পশ্চিমি দুনিয়া লাগাতার খোঁচা দিয়ে চলেছে।’

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
মে ২০, ২০২৫
শান্তনু দত্তগুপ্ত: রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ক’দিন আগেই একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘ভারত এবং চীনের মধ্যে টেনশন বজায় রাখার জন্য পশ্চিমি দুনিয়া লাগাতার খোঁচা দিয়ে চলেছে।’ পশ্চিমি দুনিয়া বলতে তিনি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেছেন, তাতে কোনও সংশয় নেই। পহেলগাঁও হামলা, অপারেশন সিন্দুর, আচমকা আমেরিকার হস্তক্ষেপ এবং সব ঠান্ডা হয়ে যাওয়া... এই ঘটনাক্রমে রাশিয়ার বিবৃতি নতুন জল্পনার জন্ম দিল? নাকি নয়া সমীকরণের? সময় বলবে। কিন্তু একটা বিষয় পুতিনের দেশ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আর তা হল, ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে লাগাতার অশান্তি লেগে থাকার পিছনে অন্দরের তুলনায় বাহিরের ভূমিকা বেশি। রাজনীতির ভাষায় বহিরাগত ইন্ধন। একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে আমরা হয়তো এখন পাকিস্তান সীমান্তের কথাই ভাবছি। কিন্তু অঙ্ক অতটাও সহজ নয়। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই মুহূর্তে ভারত কার্যত চক্রব্যূহের মাঝখানে বসে আছে। পশ্চিমে পাকিস্তান, উত্তরে চীন, পূর্বে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশ। এবং সবদিক থেকেই কোনও না কোনওভাবে খোঁচাখুঁচি চলছে। মুর্শিদাবাদের অশান্তির ক্ষেত্রে বহিরাগত ইন্ধন যে ছিল, সেটা উচ্চ পর্যায়ের রিপোর্টেই স্পষ্ট। বিষয়টা রাজনৈতিক হলে বিজেপি কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারকে ছেড়ে কথা বলত না! মোদি প্রশাসনের কাছেও সমীকরণটা পরিষ্কার— সীমান্তের ওপার থেকেই ইন্ধন ছিল। মুর্শিদাবাদের হাঙ্গামা আকারে বড় হয়ে গিয়েছিল বলে তা খবরের শিরোনামে এসেছে। এমন বহু অশান্তি কিন্তু ছোট ছোট পকেটে চলছে। দেশের পশ্চিম থেকে পূর্ব সীমান্তে। কিন্তু তা মোমবাতির মতোই সামান্য জ্বলার পর নিভিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে প্রশাসন। আগ্নেয়গিরির আকার নিতে দেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে বিহারের চম্পারণও রয়েছে। সেখানে ইন্ধন আসছে নেপাল সীমান্ত বরাবর। অর্থাৎ, পশ্চিমে কাশ্মীর, পাঞ্জাব, গুজরাত। পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ। উত্তরে বিহার। এছাড়া গোটা দুনিয়া জেনে গিয়েছে, ভারতে ধর্মের নামে বিভাজন তৈরি করা সহজ ব্যাপার। আমরা যদি অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়েই জেরবার থাকি, তাহলে কৌশলগত অবস্থান বাড়ানো কিংবা অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে শান দেওয়ার মতো কাজ করতে পারব না। আর তখন প্রায় দেড়শো কোটির জনসংখ্যা সত্ত্বেও অর্থনীতি গতি পাবে না। শিল্প থমকে থাকবে। মাথাপিছু আয় তলানিতে চলে যাবে। বিপুল সংখ্যক জনগণকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য-বাসস্থানের জোগান দিতে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে জোর বাড়াতে হবে। আর বার্ষিক বাজেটের সিংহভাগই খরচ হয়ে যাবে সেই খাতে। তারপরও কিন্তু ভারত থেমে নেই। তিন সীমান্ত থেকে ‘বন্দি’ হয়ে যাওয়ার পরও বিকল্প রাস্তা খুঁজে চলেছে নয়াদিল্লি। তারই ফল হল মায়ানমারের সিতওয়ে বন্দরকে কেন্দ্র করে উত্তর-পূর্ব ভারত পর্যন্ত বিকল্প রাস্তা তৈরি করা।
মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে, উত্তরবঙ্গ তথা শিলিগুড়ি করিডর থাকা সত্ত্বেও এই ঘুরপথ কেন? কলকাতা বন্দর থেকে পূর্বে বাংলাদেশকে এড়িয়ে মায়ানমারের সিতওয়ে বন্দর পর্যন্ত পৌঁছনো, সেখান থেকে কালাদান নদীপথে উত্তর দিকে পালেতওয়া, তারপর সড়কের মাধ্যমে আগরতলা, শিলচর বা ইম্ফল। প্রশ্ন হল, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মাত্র ২৪ কিলোমিটারের চিকেন নেক পেরিয়ে সড়কপথে ভারতের এই অংশে পৌঁছনো যায়, সেখানে মায়ানমার ঘুরে কেন? উত্তরটা এক্ষেত্রে কূটনৈতিক। কলকাতা থেকে মায়ানমারের দক্ষিণ প্রান্ত, আর সেখান থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত। পুরো এলাকায় ভারতের নিয়ন্ত্রণ মজবুত হয়ে গেলে বাংলাদেশকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা সম্ভব। উপরন্তু বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মঙ্গলা বন্দরে চীন যে ‘উন্নয়নমূলক’ কাজকর্ম করছে, সেটাও সরাসরি চলে আসবে ভারতের নজরের সামনে। সমীকরণ আরও একটা রয়েছে— সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের উপর, চট্টগ্রামের নীচে এবং কক্সবাজারের কোনাকুনি। সেখানে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘উন্নয়নে’র ছড়াছড়ি। নিন্দুকে বলে এই দ্বীপেই আমেরিকা তাদের সেনা ঘাঁটি তৈরির কাজকর্ম চালাচ্ছে। সরকারিভাবে অবশ্য তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু বিশ্বের ‘বড়দা’র যে এই দ্বীপ এবং বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিস্তর আগ্রহ আছে, তা ফাঁস হয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনার একটি চিঠিতেই। তিনি লিখেছিলেন, সেন্ট মার্টিন এবং বঙ্গোপসাগরের দখল যদি আমেরিকার হাতে তুলে দিতাম, তাহলে আমাকে এভাবে ক্ষমতাছাড়া হতে হতো না। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ অবশ্য দাবি করেছেন, মা এমন কিছু বলেননি। তাঁকে ব্যালান্স বজায় রাখতে হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই কানাঘুষো আন্তর্জাতিক মহলের কানাগলিতেও রয়েছে। পশ্চিমি শক্তির কাছে নতজানু হননি হাসিনা। তাহলে কে হবেন? মহম্মদ ইউনুস? নিন্দুকে তেমনটাও বলে। সেই কারণইে ইদানীং বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় আমেরিকা এবং চীনেরই ভাষা শোনা যায়। এমন একটা পরিস্থিতিতে বিকল্প পথ বের করা ছাড়া ভারতের কাছে অন্য উপায় ছিল না। জলপথে কলকাতা থেকে সিতওয়ে, আর মায়ানমারের মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত পর্যন্ত সড়কপথ শেষ হয়ে গেলে চীন এবং আমেরিকা— দুই মহা শক্তিধর দেশের কর্মকাণ্ডই চলে আসবে ভারতের স্ক্যানারে। উপরন্তু বাংলাদেশ সমঝে থাকবে। এক্ষেত্রে ভারতের সমস্যা একটাই— মায়ানমারের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সামরিক জুন্টা সরকারের অধীনে এখন মায়ানমারের মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ অঞ্চল পড়ে আছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ, সর্বত্রই মাথাচাড়া দিয়েছে সরকার বিরোধী শক্তিরা। কোনও কোনও অংশে তারা নিজেদের ‘শাসন’ ঘোষণাও করে দিয়েছে। এমনই একটি অংশ রাখাইন প্রদেশ। বাংলাদেশের দক্ষিণের ফালির পাশ থেকে শুরু এবং লম্বাটে ভৌগোলিক আকৃতির। রোহিঙ্গা এবং আরাকান আর্মির রণভূমি। অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার পর এই গোটা অংশটাই কার্যত চলে গিয়েছে আরাকান আর্মির দখলে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই রাখাইনেই অবস্থান সিতওয়ে বন্দরের। এখন রাখাইনের এইটুকুই জুন্টার অধীনে রয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে তারা। আক্রমণ হলে সমুদ্রপথ ছাড়া পালানোর জায়গা নেই। কারণ উত্তরের স্থলভূমি পুরোটাই আরাকানের দখলে। সেটা বুঝে বহুদিন ধরেই আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতা চালিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। অসমর্থিত সূত্রের খবর, এই মিশনে ভারত সাফল্যের মুখও দেখেছে। আর সেটাই চাপে ফেলছে বাংলাদেশকে। রাখাইন এবং তার ঠিক উত্তরের চীনল্যান্ড (মায়ানমারের আর এক রাজ্য) যদি ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, চীনকে বন্দর ‘উপহার’ দিয়েও বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে লাভের লাভ কিছু করতে পারবে না। মনে রাখতে হবে, এই রুট কিন্তু নতুন নয়। স্বাধীনতার আগে কলকাতা থেকে মায়ানমার পর্যন্ত এই জলপথেই ব্যবসা করত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অবিভক্ত বাংলা থেকে সোজা দিল্লি, পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে রেশম পৌঁছে যেত পশ্চিম এশিয়া। ইউরোপেও। এটাই সিল্করুট। পাকিস্তানের সঙ্গে টানাপোড়েন সিল্করুটে ছেদ ঘটিয়েছে। ওবিওআরের মাধ্যমে অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে সেই সিল্করুটই ধরে নিতে চাইছে চীন। আর ভারত তাই একদিকে মায়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত রেলপথ নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। আর অন্যদিকে এশিয়া-আফ্রিকা গ্রোথ করিডর তৈরিতে তেড়েফুঁড়ে নেমেছে। এক্ষেত্রে ভারতের পাশে আছে জাপানও। এই বাণিজ্যপথ পুরোদস্তুর কার্যকর হয়ে গেলে আফ্রিকা থেকে সরাসরি মুম্বই এবং জাপান পর্যন্ত জলপথে সংযোগ স্থাপন হয়ে যাবে। এখানেই শেষ নয়। আফ্রিকার মরিশাসের আগালিগাতেও ভারত কিন্তু নীরবে সেনা বেস বানিয়ে ফেলেছে। নজর রয়েছে জিবুতিতেও। কারণ, এই ছোট্ট দেশটি গাল্ফ অব এডেন এবং লোহিত সাগরের ঠিক মাঝখানে থাকায় এর স্ট্র্যাটেজিক পজিশন মারাত্মক। আমেরিকা, চীন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি... প্রত্যেক শক্তিশালী দেশ এখানে সেনা ঘাঁটি বানিয়ে রেখেছে। আফ্রিকার পূর্ব প্রান্তে ঘাঁটি তৈরিটা তাই ভারতের আর একটা মাস্টারস্ট্রোক। একটু নজর করলে দেখা যাবে, চীন সড়ক বা জলপথে যতদূরই জাল বিস্তার করেছে, সেখানেই পৌঁছে গিয়েছে ভারত। কোনও চ্যালেঞ্জ জানানো নয়। অথচ বার্তা পৌঁছে দেওয়া, আমিও আছি। চ্যালেঞ্জ কিন্তু চীনও আর ভারতকে ছুড়ছে না! ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্কযুদ্ধ শুরু করার পর চীনের বিদেশমন্ত্রীর বার্তাটা মনে করতে হবে— ভারতীয় হাতি আর চীনের ড্রাগনের মিলিত শক্তি দেখানোর সময় এসে গিয়েছে।
আমেরিকা তথা পশ্চিমি দুনিয়া এটাকেই ভয় পাচ্ছে। পাওয়া উচিতও। আমেরিকার অর্থনীতি ৩০ লক্ষ কোটি ডলারের। সেখানে চীন এখনই প্রায় ২০ লক্ষ কোটি ডলার। ভারতের সঙ্গে মিলে গেলে এই যৌথ শক্তি যে গোটা দুনিয়াকে পিছনে ফেলে দিতে পারে, সেটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নেই। চীন ব্যবসাটা বোঝে। তাই দু’দেশে টেনশন যতই বাড়ুক না কেন, তাকে কখনওই যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যন্ত গড়াতে দেয় না বেজিং। ভারতের মতো বড় এবং ওপেন মার্কেট তারা পাবে না। তাই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রজেক্টে ভারতকে পাশে না পেলেও চীন খুব একটা হাঁকডাক করেনি। সামান্য নাইট ল্যাম্প হোক, খেলনা, বা মোবাইল ফোন... এত বড় মার্কেট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই। এখন পর্যন্ত একটি বিষয়েই ভারতের সঙ্গে তাদের বিরোধ। আর তা হল, স্ট্র্যাটেজিক পজিশন। দু’জনের কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। অবশ্য করার মতো পরিস্থিতিও চীন সরকার রাখেনি। কখনও তারা লাদাখের ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে। কখনও আবার অরুণাচল প্রদেশের নামকরণ করছে। ম্যাপ বদলে দিচ্ছে। ফলে ভারতের ক্ষোভের সঙ্গত কারণ আছে। আর এই ফাটলকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাজে লাগাচ্ছে বলে ইঙ্গিত করেছে রাশিয়া। তাই বার্তাটা স্পষ্ট— উপমহাদেশে যতদিন অশান্তি থাকবে, ততই ‘বড়দা’র জন্য ভালো। ঘুঁটি? পাকিস্তান আর বাংলাদেশ তো আছেই! ‘অফেরতযোগ্য’ ঋণটুকু শুধু দিতে হবে। ঝাঁঝ বেড়ে গেলে মাঝখানে ঢুকে হেডস্যারের মতো থামিয়ে দেবে। নাম কিনবে। আর ব্যবসাটা পুরোদস্তুর বজায় রাখবে।
ভারত এবং চীন—দুই দেশের সঙ্গেই কিন্তু রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক। তারা চাইবেই, এই দুই দেশ কাছাকাছি আসুক। আর যদি ভারত, চীন ও রাশিয়া এক ছাতার তলায় চলে আসে? অর্থনীতি থেকে প্রতিরক্ষা— শাসন করবে এই অক্ষই। সেটা কি হতে দেওয়া যায়? তাই অশান্তি জিন্দাবাদ। অভ্যন্তরীণ বিবাদ দীর্ঘজীবী হোক। আর সন্ত্রাসও বেঁচে থাকুক!
রাশিফল
-
আজকের রাশিফল
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
অমৃত কথা
-
ধ্যান
- post_by বর্তমান
- জুন 14, 2025
এখনকার দর
-
রুপোর দাম
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
সোনার দাম
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
ইউরো
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
ডলার
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
পাউন্ড
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
নিফটি ব্যাঙ্ক
- post_by Admin
- জুন 13, 2025
-
নিফটি ৫০
- post_by Admin
- জুন 13, 2025