বুধবার, 25 জুন 2025
Logo
  • বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

ধনৌল্টির পথে প্রান্তরে

উত্তর কাশী থেকে ধনৌল্টি পৌঁছতে রাত্রি হয়ে গেল। ভোরবেলায় ধনৌল্টির হোমস্টেতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম দারুণ এক উজ্জ্বল আলোর সকালবেলা। হোমস্টের ব্যালকনি থেকে দূরে দেখা যাচ্ছে হিমালয়ের নন্দাদেবী রেঞ্জের পর্বতচূড়া।

ধনৌল্টির  পথে প্রান্তরে

উত্তর কাশী থেকে ধনৌল্টি পৌঁছতে রাত্রি হয়ে গেল। ভোরবেলায় ধনৌল্টির হোমস্টেতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম দারুণ এক উজ্জ্বল আলোর সকালবেলা। হোমস্টের ব্যালকনি থেকে দূরে দেখা যাচ্ছে হিমালয়ের নন্দাদেবী রেঞ্জের পর্বতচূড়া। হোমস্টের ঝুলন্ত বারান্দার কাছে ইতিউতি মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। 
উত্তরাখণ্ড রাজ্যের এক অদ্ভুত সুন্দর শৈলশহর ধনৌল্টি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৮৬ মিটার উঁচুতে এক নির্জন শৈলশহর অবস্থিত। এই অপার্থিব সুন্দর শৈলশহর, সূর্যদেবের অকৃত্রিম সোনালি আলো, দূরের ওই নিঃসীম অনন্ত মহাকাশ, তার বুকের মাঝে আশ্চর্যসুন্দর পর্বতশ্রেণি, আর ঘনশ্যামল বৃক্ষ ওক ফার পাইন দেবদারুদের মর্মরিত শাখাপ্রশাখার মাঝখান দিয়ে হিমালয়ের নন্দাদেবী পর্বতশ্রেণির তুষারধবল শৃঙ্গগুলি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শৃঙ্গগুলি যেন একদম হাতের কাছেই, হাত বাড়ালেই ধরতে পাওয়া যাবে। এদিন আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্ণিমা তিথি। রাতে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাবে চারদিক। সেই রূপের মহিমার কথা কল্পনা করতে কর঩তেই বেরিয়ে পড়লাম। 
প্রথমেই গাড়ি করে আমরা পৌঁছে গেলাম কানাতাল। শোনা যায়, কোনও এক সময় এখানের এক পুকুর বা তাল শুকিয়ে গিয়েছিল, সেই থেকে এই জায়গাটির এমন নাম। বর্তমানে এটি ধনৌল্টির কাছে অবস্থিত ছোট্ট নির্জন পাহাড়ি জনপদ। চারদিকে অসংখ্য গাছ, ইতিউতি বন্যপ্রাণী, পাখিদের গানও কানে আসছে। সেই বিশাল বনানীর মধ্যে দিয়ে যখন হাঁটছিলাম, দেখছিলাম মোটা মোটা গাছগুলোর গোটা শরীর জুড়ে শ্যাওলা, কতকালের প্রাচীন গাছ কে জানে! সেই সুবিশাল সুউচ্চ বনস্পতিরা যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। আমরা দুপুরের মধ্যেই সুরকুণ্ডা দেবীর মন্দিরের উদ্দেশে রওনা দিলাম।      
গাড়ির ড্রাইভার দীপু আমাদের সুরকুণ্ডা মন্দিরের সামনে এসে নামিয়ে দিল। সেখানে উঁচু সিঁড়িতে একটা বড় তোরণ করা আছে। তাতে একটি ঘণ্টা ঝুলছে, এবং সেই তোরণের গায়ে দেবনাগরী অক্ষরে লেখা আছে সুরকুণ্ডা মাতা কি মন্দির। আমরা সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মন্দিরের উদ্দেশে উঠতে শুরু করলাম। অনেকে ঘোড়া নিয়ে চলেছেন। মন্দির যাওয়ার পথটা মোটামুটি ভালো, কোথাও কোথাও সিঁড়ি আবার কোথাও কোথাও রাস্তা, মাঝে মাঝে লোহার রেলিং দেখা যাচ্ছে। সেই লোহার রেলিংয়ে প্রচুর বাঁদর বসে আছে। রেলিঙের পিছনে ছোট ছোট গুমটি দোকান, সেই সব দোকানে টুকিটাকি খাবার, ফল, ঠাকুরের ছবি, পূজার সামগ্রী ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। সমতল থেকে এই সুরকুণ্ডা দেবীর মন্দির প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার কিলোমিটার দূর, ২৭৫৬ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। শিলালিপি পড়ে জানলাম এই মন্দিরটি ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম। আমরা ক্রমাগত উপরের দিকে উঠেছি। প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটার পর একটু ক্লান্তিবোধ করছি, কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার দীপু আমাদের দুরন্তগতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, একটুও বসতে দিচ্ছে না। দেখতে দেখতে প্রায় মন্দিরের চূড়ার কাছে এসে উপস্থিত হলাম। পাহাড়ের চূড়ার চারদিকে অসংখ্য মেঘ ভেসে আছে। যখন মেঘ কেটে যাচ্ছে তখন অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। পাহাড়চূড়ায় পৌঁছে মনে পরম প্রশান্তি অনুভব করলাম। মন্দিরটি বেশিরভাগই কাঠ ও ধাতব পাত দিয়ে নির্মিত। মন্দিরের উপরে সুউচ্চ রঙিন চূড়া। দেওয়ালেও নানা রঙের বাহার। মন্দিরের সম্পূর্ণ ইতিহাস এবং পৌরাণিক কাহিনি দেওয়ালে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে।
অতি পবিত্র এই তীর্থভূমি। যেমন তার পুণ্যস্পর্শ ভক্তদের ধন্য করে, তেমনই এত উঁচু থেকে দেখা হিমালয়ের দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করছিল। কিছুক্ষণ বাদে মেঘ কেটে যাওয়ায় এই মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী নন্দাদেবী সহ সব পর্বতশৃঙ্গ দেখতে পেলাম। সে যে কী অসাধারণ এক অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। মন্দিরে প্রণাম জানিয়ে, চারপাশের পরমাশ্চর্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সব কষ্ট, ক্লান্তি ভুলে গেলাম। এই বুঝি পৃথিবীর বুকে একটুখানি স্বর্গ। অনেকটা সময় সেই পর্বতের শীর্ষলোকের থেকে এবার আমাদের নেমে আসার পালা। ততক্ষণে গোধূলি হতে শুরু করেছে। এমনিতেই পাহাড়ে দুপুরের পরেই হঠাৎ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। সেই আলো আঁধারির গোধূলিবেলায় ইকোপার্কের বিশাল বনানীর সুউচ্চ বনস্পতিরা এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করেছে। শতাব্দীপ্রাচীন বৃক্ষের ঘন কৃষ্ণ কাণ্ড থেকে চুঁইয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল, দূরে ডাকছে কত নাম-না-জানা পাখি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ঘন বনানী রাত্রির গহন অন্ধকারে ডুবে যাবে। আমরাও হোমস্টের উদ্দেশে রওনা দিলাম। রাস্তায় যেতে যেতে দেখি ওই বিশাল মহাগগনে কোজাগরী পূর্ণিমার আশ্চর্যসুন্দর চাঁদ উঠেছে। অনুপম চন্দ্রমা প্রকৃতিতে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন গোটা আকাশ জুড়ে। তাঁর ছড়ানো জ্যোৎস্নায় স্নাত হচ্ছে পৃথিবী। ভেসে যাচ্ছে পাহাড়, নদী, বন। অপার্থিব এক রূপের সাক্ষী হয়ে থাকছি আমরা।


সোহম চক্রবর্তী