শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

ভূস্বর্গ ভয়ংকর

পহেলগাঁও হামলাই প্রমাণ যে, জঙ্গিরা প্ল্যান বদল করছে। তারা আর সেনা কনভয় অথবা আর্মি ক্যাম্প টার্গেট করছে না। আইএসআই, লস্কর, জয়েশের নতুন মন্ত্র এখন, সরাসরি সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করা হোক।

ভূস্বর্গ ভয়ংকর

সমৃদ্ধ দত্ত: ঘুম থেকে উঠে ওজু করে নামাজের জন্য প্রতিদিনের মতো নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছলেন খলিল আহমেদ। নামাজে মনোনিবেশের আগেই হঠাৎ চোখ পড়ল হুজুর-ই-খাসের দিকে, যেখানে রাখা থাকে মোই-ই-মুকদ্দস! অর্থাৎ হজরত মহম্মদের পবিত্র কেশ। রুপো দিয়ে তৈরি ছোট্ট দরজার তালা ভাঙা কেন? খলিলের চোখটা কুঁচকে গেল! ভিতরে রয়েছে একটি ক্ষুদ্র আয়তাকার লকার। তিনটি চাবি, নম্বর মিলিয়ে খুলতে হয়। শ্রীনগরের হজরতবাল মসজিদের খাদিম খলিল আহমেদ বিস্ময় এবং আতঙ্কে স্তব্ধ। কারণ, মহামূল্যবান পবিত্র লকারও ভাঙা! তার মধ্যে থাকা কাঠের বাক্স নেই। ইসলামের পবিত্রতম স্মারক হজরত মহম্মদের কেশ চুরি করেছে কেউ? এও কি সম্ভব? খলিলের হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে হাঁটু। মাটিতে বসে পড়ার উপক্রম। কিন্তু ভেঙে পড়লে তো হবে না। খলিল সেই অবস্থায় দৌড়লেন দরগার প্রধান ট্রাস্টির কাছে। কাছেই তাঁর বাড়ি। সেই আবদুর রহমান বান্দের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই সংবাদ শোনার আগে তাঁর মৃত্যু হল না কেন! এই ভয়ঙ্কর ঘটনা কীসের ইঙ্গিত? কেয়ামতের? এখন কী করব আমরা? দু’জনে অসহায়ের মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ১৯৬৩। ২৭ ডিসেম্বর। ভোর।
শরীর ভালো নয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর। চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে তাঁর মানসিক শক্তি যেন তলানিতে। এরকম বিশ্বাসঘাতকতা! আর দেশের মধ্যেও তো তাঁর মর্যাদা আজকাল যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ। বিরোধীরা পর্যন্ত সংসদে এনেছে অনাস্থা প্রস্তাব। নেহরুর বিরুদ্ধে অনাস্থা! তিনি ভাবতেই পারেননি। এই পরিস্থিতিতে ইনটেলিজেন্স চিফ ভোলানাথ মল্লিকের ফোন। নেহরু যেন বুঝে উঠতে পারছেন না কী বলবেন! 
‘স্যার, হজরতবাল থেকে পবিত্র কেশ মিসিং। সিএম (চিফ মিনিস্টার) আমাদের হেল্প চাইছেন। প্রচণ্ড ঝামেলা হচ্ছে ভ্যালিতে। মস্ক ঘিরে পাবলিক অ্যান্টি ইন্ডিয়া স্লোগান দিচ্ছে!’
নেহরু জানেন এই মল্লিকের মতো স্পাই মাস্টার আর নেই তাঁর কাছে। আর মল্লিক কাশ্মীর স্পেশালিস্ট। তিনি কয়েক মূহূর্ত ভেবে বললেন, ‘তুমি নিজেই যাও। ওরা ট্যাকল করতে পারবে না।’ মল্লিক তৎক্ষণাৎ রওনা হলেন। ততক্ষণে পাকিস্তানজুড়ে প্রচার তুঙ্গে, হিন্দুত্ববাদী ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে পয়গম্বরের স্মৃতিধন্য ওই পবিত্রতম স্মারক সরিয়েছে। শুধু প্রচার নয়, প্ররোচনা। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান সেই সরকারি প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হিন্দু নিধন শুরু করল। শুরু হল প্রবল দাঙ্গা। মূলত পাকিস্তানে আবার হিন্দু বিতাড়ন চালু হয়ে গেল হত্যা, অগ্নিকাণ্ড এবং ধর্ষণের মাধ্যমে। 
৪ জানুয়ারি। ১৯৬৪। উঁচু প্রশাসনিক ভবনের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আইবি প্রধান ভোলানাথ মল্লিক। হাতে একটি বাক্স। সামনে রাস্তায় অগণিত জনতা। সকলেই উত্তেজিত। মল্লিক বললেন, ‘আমরা খুঁজে পেয়েছি পবিত্র কেশ। এই বাক্স এখনও বন্ধ। কেউ খোলার সাহস দেখায়নি। আমরা খুলব না। মওলানা, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা এসে খুলবেন, মতামত দেবেন। ততদিন মসজিদে হুজুর-ই-খাসেই থাকবে বাক্সটি।
বাক্স খোলা হবে ৬ ফেব্রুয়ারি। জনতা যেন আছড়ে পড়ল হজরবতবালের সামনে। কাশ্মীরের বাইরে থেকেও এসেছে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিম। 
জনতা জানতে চাইছে, ইয়েহি অ্যায় আসলি মোই-ই-মুকদ্দস ইসকি জামানত কেয়া হ্যায়? জামানত, অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্যতা কী?
সকলের সামনে সন্তর্পণে খোলা হল সেই বাক্স। খুললেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় আবদুল রহিম, মীরাক শাহের মতো ব্যক্তিত্ব। তাঁরা কী বলবেন? প্রায় দমবন্ধ পরিস্থিতি! অবশেষে তাঁদের মুখ থেকে বেরিয়ে এল বহু কাঙ্ক্ষিত শব্দ—‘হক!’ অর্থাৎ, হ্যাঁ এটাই সত্য! হজরতবাল থেকে উধাও হওয়া পবিত্র কেশ সত্যি পাওয়া গেল। 
পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ততদিনে সফল। সেই ছিল প্রথম পরীক্ষা। সাম্প্রদায়িক প্রচারের মাধ্যমে দাঙ্গা লাগানো এবং ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে ভারত সরকারের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করা। পবিত্র কেশ আবার স্বস্থানে রক্ষিত হল। কিন্তু অশান্তি আর থামল না। বীজ রয়েই গেল। ঠিক পরের বছর হল যুদ্ধ। ভারতে উস্কানি আর প্ররোচনা দিয়ে যে দাঙ্গা কিংবা অশান্তি তৈরি সম্ভব হচ্ছে এই বার্তা পেয়ে গেল পাকিস্তান। সেই শুরু হল আইএসআইয়ের ‘প্লট K’। মিশন কাশ্মীর! 
  
 সরাসরি যুদ্ধে পরপর দু’বার পরাস্ত হয়ে পাকিস্তান বুঝল অন্য পথ নিতে হবে। আমানুল্লা খান এবং মকবুল ভাট পড়াশোনা করেছে শ্রীনগরে। তারপর চলে গিয়েছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে। দু’জনেরই লক্ষ্য ভারত থেকে কাশ্মীরকে বের করে আনা। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে একটি ফ্রন্ট তৈরি করল তারা। ‘আজাদ কাশ্মীর প্লেবিসাইট ফ্রন্ট’, যার লক্ষ্য ও প্রচার একটাই। কাশ্মীরে গণভোট! কাশ্মীরবাসীই বলুক, তারা কী চায়!
ফ্রন্টের সভাপতি আব্দুল খালেক আনসারি। আর সাধারণ সম্পাদক আমানুল্লা খান। পাবলিসিটি সেক্রেটারি মকবুল ভাট। ভাট এতদিন ধরে সাংবাদিকতা করেছে। সুতরাং, সে জানে কীভাবে প্রোপাগান্ডা করা যায় এবং কাশ্মীরের কোন কোন স্থানে এই প্রচারের জেরে যুবকদের কাছে টানা সম্ভব। ১৯৬৫ সালের ২২ এপ্রিল, সকলের অলক্ষ্যে লাইন অব কন্ট্রোল পেরিয়ে কাশ্মীরের সুচেতগড়ে হাজির হল তিনজনে। সেখানে ভূস্বর্গের মাটি হাতে নিয়ে শপথগ্রহণ করল যে, কাশ্মীরকে একদিন আজাদি দেব। সেজন্য গণভোটের পাশাপাশি গড়ে তোলা হবে সশস্ত্র একটি বাহিনী। কাশ্মীর কি আমাদের সঙ্গে আছে? সেখানে উপস্থিত সাকুল্যে ৫০ জন স্থানীয় কাশ্মীরি চিৎকার করল, ‘হ্যাঁ আছি!’ মকবুলরা ভাবল, গোটা কাশ্মীরই এখন তাদের সঙ্গে। 
কিন্তু তিন মাসের মধ্যে মোহভঙ্গ হল। তারা বুঝল, সেরকম কোনও রিক্রুটমেন্ট হচ্ছে না। আর্মড রেভল্যুশনে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকী গণভোটেও বিশেষ উৎসাহ নেই। নিরামিষ আন্দোলনে আগ্রহ দেখাল না পাকিস্তানের আইএসআই। তারা চায় অ্যাকশন। হতাশ মকবুল ও আমানুল্লা আবার নতুন সংগঠন তৈরি করল, ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ)। সেটা ১৯৬৫ সালের আগস্ট। আর্মড উইংয়ের সভাপতি মেজর আমানুল্লা। আজাদ কাশ্মীর ফোর্সের প্রাক্তন সেনা। তার কাজ হবে অন্তর্ঘাত, সামরিক অভিযান এবং ট্রেনিং। পলিটিক্যাল এবং ফিনান্সিয়াল উইংয়ের প্রধান আমানুল্লা খান ও মীর আবদুল কায়ুম। তাদের কাজ ভারত বিরোধী প্রোপাগান্ডা, অর্থ সংগ্রহ এবং রিক্রুটমেন্ট। আর কোঅর্ডিনেটর মকবুল ভাট। 
প্রথম ১০ মাস গেল ট্রেনিং এবং রিক্রুটমেন্টে। ১৯৬৬ সালের ১০ জুন দু’টি টিম ক্রস করল লাইন অব কন্ট্রোল। প্রথম গ্রুপে মকবুল ভাটের নেতৃত্বে গিলগিটের এক ছাত্র তাহির আওরঙ্গজেব, জম্মুর ব্যবসায়ী  মীর আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার কালা খান। তাদের লক্ষ্য কাশ্মীরে এনএলএফের স্লিপার সেল তৈরি করা। আর নতুন সদস্য নিয়োগ। দ্বিতীয় গ্রুপের নেতৃত্বে মেজর আমানুল্লা। টিমের বেস স্টেশন হল কুপওয়ারা। সেখানে গেরিলা আক্রমণ করা হবে। 
সেপ্টেম্বর মাসেই প্রথম বড়সড় সাফল্য।  ভারতীয় সেনাবাহিনির চিন্তা বাড়াল এনএলএফ। সিআইডি পুলিস ইনসপেক্টর অমর চাঁদ শ্রীনগরে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে আচমকা অপহৃত হলেন। চারজন যুবক তাঁকে রাস্তায় বন্দুক দেখিয়ে আচমকা তুলে নিল একটি ছোট ম্যাটাডর সদৃশ পণ্যবাহী গাড়িতে। গাড়ি চলেছে অনন্তনাগের দিকে। আচমকা একটি বড় ট্রাক সামনে। কয়েক মিনিটের জন্য দাঁড়াতেই, অমর চাঁদ এক ঝটকায় একজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে নিজেই গাড়ির দরজা খুলে ঝাঁপ দিলেন রাস্তায়। তৎক্ষণাৎ তাঁর শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দিল গুলি। সেই শুরু হল কাশ্মীর ইস্যুতে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা! কিন্তু অপহরণকারীরা পালাতে পারল না। হান্দওয়ারার কুনিয়াল গ্রামে গাড়িটিকে ঘিরে ধরল কাশ্মীর পুলিস। শুরু হল গুলির লড়াই। পুলিস বাহিনীর সঙ্গে পারবে কেন মাত্র তিনজন জঙ্গি? অতএব মকুবল ভাট আর মীর আহমেদ গ্রেপ্তার। কালা খান খতম! আমানুল্লা খান কুপওয়ারা থেকে দ্রুত পালিয়ে গেল পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে। কারণ, তার সঙ্গীরা হয় মৃত, নয় ধরা পড়েছে। কিন্তু তাদের মাটি থেকে এক দঙ্গল যুবককে কাশ্মীরে নিয়ে গিয়ে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া অথবা ভারতীয় পুলিসের হাতে তুলে দেওয়াকে ‘ধোঁকা’ ভাবল পাকিস্তান। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মেজর আমানুল্লা দেখল, তাকে ইন্ডিয়ান এজেন্ট আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করাল আইএসআই। গিলগিট জেলে বন্দি হয়ে গেল সে। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সন্ত্রাস বিপ্লব কি সমাপ্ত? ধোঁয়াশা তৈরি হল। 
১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি। গোটা দিল্লি প্রশাসন এবং সরকারি মন্ত্রীরা যখন রাজঘাটে এবং সংসদে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভায় জড়ো হয়েছেন, ঠিক তখন সংবাদ এল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফকার ফ্রেন্ডশিপ প্লেন হাইজ্যাকের। ২৬ জন যাত্রী নিয়ে বিমানটি শ্রীনগর থেকে যাচ্ছিল জম্মু-সাতওয়ারি এয়ারপোর্ট। বিমানের নাম গঙ্গা। 
ক্যাপ্টেন কাচরুকে জঙ্গি হাশিম কুরেশি এবং আসরফ কুরেশি বলল, ‘জম্মু নয়। সোজা লাহোর চলো।’ একজনের হাতে একটি পিস্তল, যা আসলে খেলনা। আর অন্যজনের হাতে গ্রেনেড, যা আসল। লাহোর এয়ারপোর্টে নেমে হাশিম কুরেশি আসরফকে বলল, ‘তুমি থাকো এয়ারক্র্যাফ্টের মধ্যে। আমি গিয়ে পাকিস্তান অথরিটির মাধ্যমে ইন্ডিয়ার সঙ্গে নেগোশিয়েট করছি।’ দাবি কী? ভারতের জেলে আটক ৩৬ জন এনএলএফ সদস্যকে মুক্তি দিতে হবে। 
প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলবে না হাশিম। অবশেষে বাধ্য হয়ে ভুট্টো এলেন। কিন্তু ততক্ষণে ভারত প্রচার করে দিয়েছে যে, পাকিস্তানের মদতে ভারতের নিরীহ যাত্রীদের সমেত বিমান অপহরণ করা হয়েছে। সেই বিমান তখনও লাহোর এয়ারপোর্টে। বিদেশি রাষ্ট্রগুলি প্রবল চাপ দিচ্ছে পাকিস্তানকে। ভুট্টো মহাবিপদে। তিনি বললেন, সব যাত্রীকে মুক্ত করা হোক। সকলকে সড়কপথে পৌঁছে দেব অমৃতসর। কারও কোনও ক্ষতি হবে না। তাই হল। কিন্তু হাশিম কুরেশি বিমানটিকে ভারতে ফিরতে দেবে না। পাকিস্তান সেনাকে সে বাধ্য করল বিমানে আগুন ধরিয়ে দিতে। ভারতকে শিক্ষা দেওয়া হবে।
ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নতুন নায়কের নাম হাশিম কুরেশি। কিন্তু পাকিস্তানের আইএসআই হঠাৎ খবর পাচ্ছে, সবটাই আইওয়াশ! ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ প্রধান আর এন কাও এই প্ল্যানের পিছনে। কুরেশি আসলে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েছিল। সেখানেই তাকে ডাবল এজেন্ট বানিয়ে ফেলেছেন আর এন কাও। আর পাকিস্তানকে দুনিয়াজুড়ে বদনাম করার জন্য এই হাইজ্যাকিং প্ল্যান। কুরেশিকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করল পাকিস্তান। দিল্লি অবশ্য তার আগেই ভারতের আকাশসীমা ও এয়ারপোর্ট পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার সেনা পাঠিয়ে শেখ মুজিবকে শায়েস্তা করার পথ বন্ধ। 
মাত্র ১১ মাসের মধ্যেই আবার চরম শিক্ষা পেল পাকিস্তান। এবার ভেঙেই দেওয়া হল তাদের। তৈরি হল নতুন দেশ, বাংলাদেশ। যে পাকিস্তান ১৯৪৭ থেকে চাইছে কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে, তারা দেখল ভারতই কৌশলে পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়েছে। 
১৯৭৭ সালে আইএসআই দু’টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। এক, আমানুল্লা খান, মকবুল ভাটকে দিয়ে ভারতের কাশ্মীরে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সংগঠন গঠন করা। জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট। দুই, পূর্ব পাকিস্তান ছিন্ন হওয়ার ক্রোধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক প্রতিজ্ঞা করলেন একটি নতুন মিশনের। আগে ছিল ‘প্লট কে’। অর্থাৎ মিশন কাশ্মীর। এবার নতুন প্রজেক্টের নাম ‘মিশন কে টু’। কাশ্মীর-খালিস্তান! এই কাজের জন্য জিয়াউল হকের অন্যতম প্রধান বাজি, এক ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক। সেই শিক্ষককে নিয়োগ করা হল কাউন্সিল অন ইসলামিক স্টাডিজের প্রধান হিসেবে। শিক্ষকের নাম হাফিজ সইদ! ১৯৮৭ সালে সেই হাফিজ, আবদুল্লা আজম এবং অধ্যাপক জাফর ইকবাল সর্দার একজোট হয়ে তৈরি করল এক নবতম  সংগঠন, মার্কাজ দাওয়া-উল ইরশাদ! যার নতুন শাখা ওই বছরেই তৈরি হল, লস্কর-ই-তোইবা! লক্ষ্য, ভারতের ‘বরবাদি’! মুফতি মহম্মদ সইদের কন্যা রুবাইয়াৎ সইদকে মেডিক্যাল কলেজ থেকে ফেরার পথে কিডন্যাপ করার প্ল্যান যে সংগঠনের প্রথম সাফল্য। শুরু হল কাশ্মীরে সন্ত্রাস! 
  
প্লট এবং প্ল্যান সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। এতকাল ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, অমরনাথ যাত্রা ভণ্ডুল করার জন্য বহুবার বিক্ষিপ্তভাবে যাত্রাপথে আক্রমণ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী, আধাসেনা, তীর্থযাত্রী, কাশ্মীরের বাসিন্দারা তাতে নিহত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে সেই ফর্ম্যাট পালটে গেল। প্রধানত টার্গেট করা হল সিকিউরিটি এজেন্সিকে। পাঠানকোট এয়ারফোর্সের বেসস্টেশনে, উরি সেনাশিবিরে, পুলওয়ামার সেনা কনভয়ে হামলা যার প্রমাণ। টার্গেট ছিল সেনাবাহিনী অথবা আধা সামরিক ফোর্স। এসব ফোর্সকে টার্গেট করা যথেষ্ট ঝুঁকির। কারণ, তৎক্ষণাৎ পাল্টা অ্যাকশনও হবে। সুতরাং আক্রমণ করে রক্ষা পাওয়া যাবে, এমনও নয়। হয় পাকড়াও হওয়া কিংবা এনকাউন্টারে মৃত্যু।  
পহেলগাঁওয়ের আক্রমণ তাই প্রমাণ দিচ্ছে জঙ্গিদের প্ল্যান বদলের। তারা আর সেনা কনভয় অথবা আর্মি ক্যাম্প টার্গেট করছে না। আইএসআই, লস্কর-ই-তোইবা, জয়েশ-ই-মহম্মদের নতুন যে মন্ত্র, সেটি হল, সরাসরি সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করা হোক। অর্থাৎ হিজবুল মুজাহিদিন এবং হুজি যেমন করত। ট্রেনে সিরিয়াল ব্লাস্ট। জনবহুল স্থানে বিস্ফোরণ। লস্কর এবং জয়েশ এই ফর্ম্যাটে সবথেকে ঘৃণ্যতম সন্ত্রাস করেছিল ২৬/১১ মুম্বই হামলার সময়। তারা চিহ্নিত করেছিল এমন কিছু স্থান, যেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াত এবং জমায়েত। রেলস্টেশন, হোটেল, রেস্তরাঁ, হাসপাতাল। অতএব মৃত্যুও হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু সেই মুম্বই হামলার সঙ্গে পহেলগাঁও হামলার পার্থক্য একটাই। এখানে জঙ্গিরা এমন একটি সন্ত্রাসী ছক কষেছে, যাতে সরাসরি পুলিস, সেনা, আধা সেনার সঙ্গে কোনও  সংঘর্ষের সম্ভাবনাই না থাকে। অর্থাৎ নিশ্চিন্তে এসে ধীরে সুস্থে নিরীহ সাধারণ ভারতবাসীকে সময় নিয়ে নিয়ে হত্যা করা এবং সময় নিয়েই ধীরে ধীরে গা ঢাকা দেওয়া। কেন? কারণ, বৈসরণ উপত্যকায় প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দু’হাজার পর্যটক আসে। অথচ নিরাপত্তা বাহিনীর স্থায়ী পোস্ট নেই। একদিকে সরু পায়ে হেঁটে অথবা ঘোড়ায় চেপে চলার প্রবেশ ও প্রস্থানপথ। অন্যদিকে ঘন জঙ্গল। অন্তত ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট লাগবে নিকটবর্তী নিরাপত্তাবাহিনীর পৌঁছতে। আর গণহত্যা ঘটাতে কতক্ষণ লেগেছে? ২০ মিনিটের আশপাশে।
কী ঘটেছিল? হাসিম মুসা এবং আলি ভাই হল লস্করের প্রক্সি সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টে’র সদস্য। মুসা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর এবং আলি ভাই ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেই ঢুকে পড়েছিল কাশ্মীরে। তাদের স্থানীয় স্লিপার সেল সদস্য ছিল আদিল হুসেন। মুসার অপারেশনের জোন ছিল বদগাঁও। আর আলির এরিয়া দাঁচিগাঁও ফরেস্ট। দাঁচিগাও ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে সোজা ত্রাল পৌঁছনো যায়। আর সেখান থেকে পহেলগাঁও। 
আদিল হুসেন পাকিস্তানে গিয়ে ছিল ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত, মোট চার বছর। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মুজফ্ফরাবাদে সে নিয়েছে ট্রেনিং। মাসুদ আজহারের ভাই ট্রেনিং দিয়েছে। তার সঙ্গী ছিল আরও ১৯ জন। জয়েশের ট্রেনিংয়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, কে কতক্ষণ হাঁটতে এবং দৌঁড়তে পারে। সঙ্গে সাঁতারও। আর ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা। কাশ্মীরে সন্ত্রাস করে পালানোর সময় এই চারটি বিষয়ে স্পেশালিস্ট হতেই হবে। 
এই দলে ছিল আরও তিনজন। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে গান্ধেরবালের গগনগিরে ছ’জন বহিরাগত শ্রমিক এবং এক ডাক্তারকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ড ছিল তাদের প্রথম টার্গেট। এরপর বারামুলার বুটা পাথরি। এই হত্যাকাণ্ডগুলির বৈশিষ্ট্য হল, কাশ্মীরে কর্মসূত্রে আসা বহিরাগতদের হত্যা করা। সেটি ছিল পরীক্ষা। অর্থাৎ তার প্রতিক্রিয়া কী হয় দেখা। জঙ্গিদের মাস্টারমাইন্ড চাইছিল যে, কাশ্মীরিদের উপর দায় চাপুক যে, তারা চায় না রাজ্যের বাইরে থেকে কেউ এসে উপত্যকায় কাজ করুক। তাই বহিরাগতদের হত্যা করা হচ্ছে। এভাবে কাশ্মীরিদের উপর ভারতবাসীর রাগ বাড়ুক। একটি ধারণা তৈরি হোক যে, সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অবলুপ্তির কারণে কাশ্মীরিদের প্রবল ক্রোধ এবং ঘৃণা ভারতবাসীর উপর। এই প্রবণতা যত বাড়বে, ততই আবার কাশ্মীরবাসীরা দূরে সরে যাবে ভারতের থেকে। এবং তারপর আবার শুরু করা যাবে আজাদ কাশ্মীরের স্লোগান এবং আবেগ। 
পহেলগাঁওয়ের অ্যাটাক এই প্রবণতার নবতম অধ্যায়। মাথায় ক্যামেরা আটকে লাইভ রেকর্ডিং করতে করতে হত্যা করা হয়েছে পর্যটকদের। সুশীল নাথানিয়াল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তাঁর মাথায় এম ফোর রা‌঩ইফেল ঠেকিয়ে বলা হয়েছে, প্যালেস্টাইনে কী হয়েছে জানো তো? সুশীল মাথা নাড়তেই তাঁকে গুলি করা হয়, মাথাতেই। তারপর মৃতদেহের সঙ্গে সেলফি তোলে জঙ্গিরা। ভরত ভূষণের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে একজন জঙ্গি বলেছে, ‘আমাদের ভাইয়েরা বিশ্বজুড়ে মরছে, আর তোমরা এখানে ফূর্তি করছ? নাম কী?’ ভরত ভূষণ যেই বলেছেন, ভরত! সঙ্গে সঙ্গে গুলি। টেররিস্টরা দু’টি ভাগে দাঁড় করায় পর্যটকদের। যারা কলমা পড়তে পেরেছে অন্তত একটি বাক্যও, তাদের প্রাণভিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আর যারা কলমা পড়তে পারেনি, তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। 
এতকাল ভারতবাসীকে খুন করত সন্ত্রাসবাদীরা। সেই বার্তাও দেওয়া হতো জঙ্গিদের পক্ষ থেকে। এই প্রথম স্পষ্ট করে বার্তা দেওয়া হল, হিন্দুদের হত্যা করা হবে। এবং নিরস্ত্র নিরীহদের।  
ভারতীয় হিন্দুরা সারাক্ষণ যাতে আতঙ্কিত থাকে! আর ভারতীয় মুসলমানরা যাতে ভিলেন হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।  
পাকিস্তানের নতুন প্লট, ভারতে গৃহযুদ্ধ হোক? 


-গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
-সহযোগিতায় : বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী