বৃহস্পতিবার, 17 জুলাই 2025
Logo
  • বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

ভাস্কো-দা-গামার সমাধি

ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জলপথের আবিষ্কর্তা তিনি। কোচিতে তাঁর সমাধি দেখে এসে লিখলেন অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

ভাস্কো-দা-গামার সমাধি

ইতিহাস বইতে ভাস্কো-দা-গামার কথা আমরা সবাই পড়েছি। ভাস্কো-দা-গামা ছিলেন ভূ-পর্যটক। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন পর্তুগালের সাইনেসের বাসিন্দা। তাঁর নেশা ছিল দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো। আর এইভাবেই বিভিন্ন দেশে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পৌঁছন ভারতবর্ষে। পর্তুগালের লিসবন থেকে সমুদ্রপথে আতলান্তিক ও ভারত মহাসাগর পেরিয়ে তিনি এসে পৌঁছন ভারতের পশ্চিম উপকূলে। কেরলের কোঝিকোড় বা কালিকট বন্দরে। লিসবন থেকে ভারতে পৌঁছতে তাঁর সময় লেগেছিল প্রায় দু’বছর। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় তিনি ১৪৯৮ সালের ২০ মে তারিখে কালিকট বন্দরে আসেন। ইউরোপ থেকে ভারতে আসার এই সমুদ্রপথটি তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি।
কালিকট বা কোঝিকোড় বন্দরটি কেরলের কোচিতে অবস্থিত। ভাস্কো-দা-গামা এখানে আসার পর তৎকালীন কোচি রাজার সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি করেন। ভাস্কো-দা-গামার উদ্যোগে কোচিতে একটি দুর্গও তৈরি হয়। পর্তুগিজ সম্রাট ইমানুয়েলের নামানুসারে এই দুর্গের নামকরণ করা হয় ফোর্ট ইমানুয়েল। দুর্গ থাকার জন্য এই অঞ্চলটির নাম হয় ফোর্ট কোচি। এই ফোর্ট কোচি অঞ্চলে একটি বাড়ি আছে, যা ‘ভাস্কো-হাউস’ নামে পরিচিত। ভাস্কো-হাউস হল এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো পর্তুগিজ বাড়ি। এই ভাস্কো-হাউসের কাছে একটি ইউরোপীয় গির্জা আছে। সেটির নাম সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ। এই গির্জাটি ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইউরোপীয় গির্জাগুলির অন্যতম এটি।  
এবার আসি ভাস্কো-দা-গামার সমাধির কথায়। ১৫২৪ সালে তৃতীয় বার ভারত ভ্রমণের সময় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভাস্কো-দা-গামার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর ভাস্কো-দা-গামাকে ফোর্ট কোচির সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চে সমাধিস্থ করা হয়। সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ এবং চার্চের ভেতরে থাকা ভাস্কো-দা-গামার সমাধি কোচির অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ভাস্কো-দা-গামার সমাধি দেখতে হলে কোচি থেকে সড়কপথে ফোর্ট কোচির সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চে আসতে হবে। অথবা বাস, ট্রেন বা মেট্রোরেল চেপে এরনাকুলাম পর্যন্ত এসে সেখান থেকে জলপথে ফোর্ট কোচিতে পৌঁছতে হবে। জলপথে ফোর্ট কোচিতে আসতে হলে এরনাকুলাম জেটি থেকে ওয়াটার-মেট্রো, মানে আমরা যাকে লঞ্চ বলি, তাতে চেপে আসতে হয়। লঞ্চের ভাড়া মাত্র ৬ টাকা।
শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশে বড় বড় সবুজ গাছে ঘেরা সাদা রঙের সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ভাস্কো-দা-গামার সমাধিটি চার্চের ভেতর রয়েছে বলে ঢোকার সময় বাইরে জুতো খুলে রাখতে হয়। সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চের ভিতরটি বেশ মনোরম। চার্চের ভিতরে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত ঝুলছে একটি বিশাল লম্বা টানা পাখা। একটু এগলেই ডান পাশে পাথরে ঢাকা ভাস্কো-দা-গামার সমাধি। কবরের পাথরের চারপাশ কাঠ দিয়ে বাঁধানো। কেউ যাতে কবরে হাত দিতে না পারে তার জন্য এর চার ধার লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা রয়েছে। সমাধির পাশের দেওয়ালে জানলার ওপর রাখা আছে ভাস্কো-দা-গামার একটি প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতির পাশের দেওয়ালে আছে একটি বহু পুরনো প্রস্তর ফলক। তাতে খোদাই করা আছে ভাস্কো-দা-গামা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য। সমাধি আর প্রস্তর ফলকের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে মনে হয় যেন সেই পর্তুগিজ আমলেই ফিরে গিয়েছি।
চার্চের বাইরে বেরিয়ে এলে দেখা যায়, চার্চকে ঘিরে যে সব গাছ রয়েছে তার তলায় বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দু’-তিনটি বেঞ্চ পাতা আছে। সেই বেঞ্চে বসে চার্চের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন ভারী হয়ে যায়। পর্তুগিজ শাসনের স্মৃতি বিজড়িত সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চের ভেতর ভাস্কো-দা-গামার দেহটি এখন আর নেই। সমাধিস্থ করার ১৪ বছর পর ১৫৩৮ সালে ভাস্কো-দা-গামার পুত্র পাদ্রে-দা-সিলভা-দা-গামা তাঁর পিতার দেহ কবর থেকে তুলে লিসবনে নিয়ে চলে যান। ফোর্ট কোচির সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চে রয়ে যায় ভাস্কো-দা-গামার কবরে ঢাকা দেওয়া পাথর আর তাঁর স্মৃতি।

রাশিফল