শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

এ যেন এক এসি কারাগার!

ঘুপচি ঘর। একটাইমাত্র জানালা। সেটাও বাইরে থেকে কালো টেপ দিয়ে আটকানো। তার মধ্যেই ঠাসাঠাসি করে ভরে দেওয়া ছ’জনের জন্য তিনটি বাঙ্ক বেড। এক কোণে ঝুলছে স্পিকার।

এ যেন এক এসি কারাগার!

সৌম্য নিয়োগী: ঘুপচি ঘর। একটাইমাত্র জানালা। সেটাও বাইরে থেকে কালো টেপ দিয়ে আটকানো। তার মধ্যেই ঠাসাঠাসি করে ভরে দেওয়া ছ’জনের জন্য তিনটি বাঙ্ক বেড। এক কোণে ঝুলছে স্পিকার। ঠিক সকাল সাতটায় সেটি তারস্বরে বেজে ওঠে। ঘুম ভেঙে যায় আনন্দ কুমারের। চোখে তখনও সদ্য ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের ঘোর। কে ছিল না সেই স্বপ্নে... মা-বাবা, বউ... সন্তানের আধো আধো বুলি। বাড়ির সামনের কদম গাছটা পর্যন্ত ছিল নাগালে। আচমকা অ্যালার্মের তীক্ষ্ম শব্দ নিমেষে তাঁকে নামিয়ে আনে বাস্তবের মাটিতে... বলা ভালো শোয়ে কোককো শহরের মাটিতে। থাইল্যান্ড সীমান্তে মায়ানমারের এই ছোট্ট অথচ ঝাঁ চকচকে শহরটি গত কয়েক বছর ধরেই তাঁর ঠিকানা। আনন্দ অবশ্য তাঁর নাম নয়। দক্ষিণ ভারতের এক প্রান্তিক এলাকার এই বাসিন্দা কিছুতেই নিজের আসল নাম-ঠিকানা জানাতে চান না। তিনি ভালোই জানেন পরিচয় প্রকাশ করার অর্থ নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনা। তাই শুধু বেডরুম নিয়েই তাঁর আক্ষেপ, ‘এ যেন কারাগার। সেখানে আমি বন্দি সারাজীবনের জন্য। শুধু পার্থক্য একটাই, জেলে পাখাটাও থাকে না। আর এখানে এয়ার কন্ডিশনারের ঠান্ডা হাওয়া পাওয়া যায়।’
আনন্দের মতো অনেকেই কাজ করতে আসেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলিতে। কেউ মায়ানমার-থাইল্যান্ড, কেউ আবার ভারত, এমনকী শস্যশ্যামলা পশ্চিম বাংলা থেকেও। কেউই প্রথমে বুঝতে পারেন না যে, ভালো আয়ের লোভের চক্করে আসলে সাইবার জালিয়াতির কালো দুনিয়ায় পা রাখছেন। অনলাইন জুয়া থেকে জালিয়াতি, সব কিছুর স্বর্গ বলা যায় শোয়ে কোককো শহরটিকে। বছর দেড়েক আগে সেখানে স্ক্যামার হিসেবে কর্মরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয়েছিল আন্তর্জাতিক এক সংবাদ সংস্থা। শিউরে ওঠার মতো সেই কথোপকথন।
রোদ ঝলমলে সকালেও আনন্দের ঘরে আবছা আলো আসে। কিন্তু সেদিকে বেশি তাকানোর মতো হাতে সময় থাকে না। কারণ ঘুম ভাঙলেই বাথরুমে লাইন দিতে হয় আর পাঁচ জনের সঙ্গে। তারপর সকালের জলখাবার। সেটারও সময় কিন্তু ধরা বাঁধা। আনন্দ বলছিলেন, ‘সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ব্রেকফাস্ট টাইম। যদি ঠিক সময়ে না যেতে পারি, তাহলে আর খেতে পাব না।’ প্রায় ৩০০ কর্মী রোজ একই রকমের ঘর থেকে বের হয়ে একটি বড় ডাইনিং হলে জড়ো হন। খাবার বলতে ভাত, ডিম, রুটি এবং কফি। খেতে খেতে কয়েকজন কথা বলেন নিজেদের মধ্যে, তখনই বোঝা যায় কে কোন দেশের। আনন্দের কথায়, ‘বাকি সময় কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। কড়া নির্দেশ। কোম্পানির গুপ্তচর যে কোথায় ঘাপটি মেরে রয়েছে কে জানে! তার উপর সিসিটিভি আর চীনা গার্ড। আমি তো বেডরুমেও ফোনে ছবি তুলতে বা জোরে কথা বলতে সাহস পাই না। যোগাযোগের উপায় বলতে শুধু মেসেজ।’
সেদিনটার কথা মনে পড়ে যায় আনন্দের, যখন তিনি প্রথম পা রাখেন এই কুখ্যাত শোয়ে কোককোর ইয়াতাই বা নিউ সিটিতে। করোনার হানায় আর পাঁচজন আম আদমির মতো তিনিও কাজ হারিয়েছিলেন। তারপর এক পরিচিত দালালের হাত ধরে এই কোম্পানির সঙ্গে পরিচয়। সেটাও অবশ্য খুব সহজ হয়নি। সেই দালাল তাকে থাইল্যান্ড সীমান্তে মায়ানমারের শহর মায়াওডিতে নিয়ে আসে। তারপর ইন্টারভিউয়ের পালা। সেজন্য ৮ হাজার ভাট বা প্রায় ২১ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। যাতায়াতের জন্য পকেট থেকে খসে আরও তিন হাজার টাকা। 
এত মহার্ঘ্য  ইন্টারভিউ কোন চাকরির জন্য? আনন্দ ব্যাখ্যা করেন, ‘এখানে অনেক কোম্পানি আছে। তবে আমি যে সংস্থায় কাজ করি, তার দু’ধরনের ব্যবসা। অনলাইন জালিয়াতি এবং জুয়া। আমি স্ক্যামার হিসেবে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। কিন্তু ইংরেজি কিংবা চীনা ভাষার দক্ষতা ছিল না। তাই আমাকে অনলাইন জুয়ার ডিপোজিট-উইথড্রয়াল বিভাগে পাঠানো হয়েছে।’ সপ্তাহের সাতদিনই কাজ করতে হয়। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। মাঝে ৪৫ মিনিটের লাঞ্চ ব্রেক। তবে রবিবার হাফ ডে। কোনও ওভারটাইম নেই। রাতের খাবার আসে সন্ধ্যা ৬টায়, কোম্পানি চায় তা খেতে খেতেই কর্মীরা কাজ করুক।
এত কঠিন কাজে বেতন কত মেলে? আনন্দ জানিয়েছেন, স্ক্যামার হিসেবে তাঁর পাওয়ার কথা ছিল মাসে ৩০ হাজার ভাট, ভারতের হিসেবে সাড়ে ৭৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে থাকা ও খাওয়ার খরচ ধরা। যদিও এখন সেটা কমে ২৫ হাজার ভাট হয়েছে। মোটামুটি হিসেবে সাড়ে ৬৪ হাজার টাকা। আনন্দের এক বন্ধু আছে। সে অনলাইনে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে টার্গেট ধরে। সে কখনও বন্ধু, কখনও প্রেমিক সেজে কথা বলে নিজের টার্গেটের সঙ্গে। তারপর তাঁকে বোঝায় নিজের কোম্পানির নকল ব্যবসা সম্পর্কে। কোনওমতে টার্গেটকে সেই ব্যবসায় বিনিয়োগ করাতে পারলেই কেল্লাফতে। একবার টাকা জমা হলেই সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সেই ‘ফাইন্ডার’। সেই ‘ফাইন্ডার’ পদের বেতন অবশ্য আরও লোভনীয়। নগদেই মেলে সেই বেতন। তবে এমন জালিয়াতির দুনিয়ায় নিজের কাছে টাকা রাখতে ভরসা পান না আনন্দরা। কোম্পানি তখন তাঁদের অফার দেয়, ওই অর্থ মায়ানমারের মুদ্রা কিয়াটে বদলে বাড়িতে পাঠানো যাবে। সেটাও সেদেশের বৃহত্তম ব্যাঙ্কের মোবাইল ওয়ালেট কেবিজেডপে-র মাধ্যমে। তবে এক্সচেঞ্জ রেট বেশ চড়া।
এতদিনের চাকরিতে একবারই কেবল শোয়ে কোককোর বাইরে যেতে পেরেছিলেন আনন্দ। সেটাও অবশ্য কোম্পানির কাজেই। কারণ, শহরের বাইরে প্রায় ১০০ একর জমিতে গাঁজা চাষ শুরু করেছে আনন্দের সংস্থা। গাঁজা গাছগুলির স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। যদিও সেই কাজে স্বাধীনভাবে যাওয়া যায়নি। কোম্পানির কালো কাচ ঢাকা গাড়িই নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের। এই জেলখানা থেকে কবে বেরতে পারবেন, জানেন না আনন্দ। চুক্তির শর্ত বেশ কড়া। নির্দিষ্ট সময়ের আগে চাকরি ছাড়লে, চুক্তির টাকা শোধ দিতে হবে তাঁকেই। অনেকটা পণবন্দি থাকা মতো ব্যাপার। আনন্দের চাকরির এখনও ছ’মাস বাকি। তার আগে চাকরি ছাড়লে এই ছ’মাসের বেতন দিতে হবে তাঁকে। অর্থাৎ, প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা। আর পালাতে গিয়ে ধরা পড়লে অমানুষিক মারধর করা হয়। এমনকী সে গুমখুনও হয়ে যেতে পারে।
যদিও ইয়াতাই ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা এমন অত্যাচারের কথা স্বীকার করে না। বরং কেউ শারীরিক নির্যাতন করলে কর্মীদের অভিযান জানানোর ব্যাপারে নির্দেশিকাও দিয়েছিল। কিন্তু কেউ অভিযোগ করার সাহসই দেখাতে পারেনি।
রাত ১০টায়, আরেকটি অ্যালার্ম বাজে। কাজ শেষ করে ঘরে আসেন সকলে। স্নানের জন্য লাইন দেন। কেউ ফোনে নিচুস্বরে কথা বলেন। বাকিরা সোজা বিছানায়। আর তো মাত্র আট-ন’ঘণ্টা। তারপর বেজে উঠবে আরও একটা অ্যালার্ম!