শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

রহস্যে মোড়া আমাজনের জঙ্গল

আমাজনের বৃষ্টি অরণ্য প্রকৃতির এক বিস্ময়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিপদসঙ্কুল অরণ্য। আমাজন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘন জঙ্গল। এর বিস্তার পৃথিবীর সমস্ত রেন ফরেস্টের দ্বিগুণ। 

রহস্যে মোড়া আমাজনের জঙ্গল

আমাজনের বৃষ্টি অরণ্য প্রকৃতির এক বিস্ময়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিপদসঙ্কুল অরণ্য। আমাজন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘন জঙ্গল। এর বিস্তার পৃথিবীর সমস্ত রেন ফরেস্টের দ্বিগুণ। যেখানে গোটা পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগে প্রাণী বাস করে এবং কতরকমের যে দুর্লভ পশুপাখি ও সরীসৃপ বাস করে, সে সম্বন্ধে আমরা হয়তো জানিও না। বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিহত করতে অন্যতম ভরসা আমাজনের এই বর্ষা বন। আমাজনের এই অরণ্যাঞ্চল গোটা বিশ্বের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত। এই অরণ্য পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে। আর শোষণ করে নেয় ২৫-৩০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। 
আমাজনের জঙ্গলে ৪০০ বিলিয়নেরও বেশি গাছ আছে। এখানে ১৭ হাজার ভিন্ন প্রজাতির গাছ দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে প্রায় ৪৫ লক্ষ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ২ হাজার প্রজাতির পাখি এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। আমাজন নদীতে ৩ হাজার প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী রয়েছে। এই জঙ্গলে আদিবাসী মানুষজনও বাস করে। এদের সঙ্গে আমাদের বাইরের পৃথিবীর কোনও যোগাযোগ নেই। অনেকটা আমাদের দেশের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ‘জারোয়া’ মানুষদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অনুমান করা হয় ৪০ লক্ষের বেশি মানুষ বসবাস করে আমাজন অরণ্যে। আমাজনের কিছু কিছু অংশ এত ঘন গাছপালায় ঢেকে রয়েছে যে, সেখানে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো পৌঁছতে পারে না। এইসব জায়গায় এত বিষধর প্রাণী বাস করে, যাদের একটি দংশনেই মানুষের মৃত্যু হবে। এখানে পরিস্থিতি এতই প্রতিকূল ও বিপদসঙ্কুল যে, বেঁচে থাকার পক্ষে তা অনুপযোগী। চারদিকটা কেমন যেন গা ছমছম করা রহস্যময় আতঙ্কে ভরা।
আমাজন বৃষ্টি অরণ্যের অবস্থান হল দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে। এই জঙ্গলের আয়তন ৭০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। যা দক্ষিণ আমেরিকার ৯টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। আমাজন জঙ্গলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমাজন নদী। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। আন্দিজ পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে এই নদী উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে মিশেছে। আমাজন বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। আমাজন নামটির পেছনেও রয়েছে এক চমৎকার গল্প। কথিত আছে, ১৫৪২ সালে একজন স্প্যানিশ পর্যটক ফ্রানসিস্কো ডি ওরেললানা এবং তাঁর দলবল এই জঙ্গল ভ্রমণ করার সময় বিভিন্ন জায়গায় ‘তাপুয়াস’ ও অন্য উপজাতিদের সঙ্গে ছোটখাট যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় তিনি লক্ষ করেন পুরুষদের সঙ্গে নারী যোদ্ধারাও লড়াই করছে। তার থেকেই এই জঙ্গলের নাম দেন ‘আমাজন’। এটি একটি গ্রিক শব্দ। প্রাচীন গ্রিক উপকথায় ‘আমাজন’ কথাটির অর্থ হল নারী যোদ্ধা।
এই অরণ্য সৃষ্টি হয়েছিল ইওসিন যুগে। এই যুগ শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে। আমাজনের জঙ্গলে পাওয়া যায় এক ধরনের বিশেষ ফলের গাছ, যার নাম ওরিজো। দেখতে অনেকটা নারকেলের মতো। এর ভেতরে ১৫-২০টা বাদাম থাকে। কাঠবেড়ালিরা এই ফলের শক্ত খোলক ফুটো করে এই বাদাম খায়। রাতের অন্ধকারে এখানে আগুন জ্বালানোরও ব্যবস্থা করে রেখেছে প্রকৃতি। সেজন্য খুঁজে নিতে হবে প্রো-এরো গাছ। এই গাছের গোড়া থেকে বিশেষ ধরনের মোম বা প্রাকৃতিক প্যারাফিন বের হয়। সেখানে অগ্নি সংযোগ করলেই আগুন জ্বলবে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে গেলে খেতে হবে এক অদ্ভুত পিঁপড়ের কামড়। এরা জঙ্গলের বড় বড় গাছের ডালপালায় অনেকটা বাবুই পাখির মতো বাসা তৈরি করে। বাসাগুলির উপর হাত রাখলেই হাজার হাজার খুদে পিঁপড়ের দল হাতের উপর উঠে আসবে। তারপর তাদের অন্য হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে। এইসব পিঁপড়ের শরীরের রসের গন্ধে মশারা কামড়াতে পারে না। 
আমাজন বৃষ্টি অরণ্যের সবচেয়ে বড় এবং উঁচু বৃক্ষের নাম কাপোক। এর উচ্চতা প্রায় ২০০ ফুট এবং কাণ্ডের ব্যাস প্রায় ১০-১২ ফুট। অন্য গাছেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রকাণ্ড মেহগনি গাছ, কোকো গাছ, রবার গাছ, আকাই পাম, ব্রাজিলীয় বাদাম, লুইমবা, আয়রন উড, ট্যাঙ্গারানা ইত্যাদি।
আমাজন বৃষ্টি অরণ্য জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানকার নদীতে প্রচুর সংখ্যক পিরানহা মাছ রয়েছে। এরা আকারে ১০ সেমি পর্যন্ত হয়। প্রায় সাতটি প্রজাতির পিরানহা দেখা যায় আমাজন নদীতে। নরখাদক বলে পিরানহার বদনাম রয়েছে। এই মাছের দাঁত ব্লেডের থেকেও ধারালো আর চোয়াল এতটাই শক্ত ও মজবুত যে মানুষের অঙ্গ অনায়াসে কেটে নিতে সক্ষম। এরা একসঙ্গে দল বেঁধে থাকে এবং শিকার করে। তবে পিরানহা জ্যান্ত মানুষ খেয়েছে এমন কোনও তথ্য এখনও পর্যন্ত নেই। আমাজন নদীর আর একটি ত্রাস হল পাকু মাছ। এই মাছের বিশেষত্ব হল দাঁত অনেকটাই মানুষের দাঁতের মতো। এরা লম্বায় প্রায় সাড়ে তিন ফুট মতো হয় এবং ৪০ কেজি ওজনের হতে পারে। মানুষ এদের খাবার নয়, তবু দূরত্ব বজায় রাখাই ভালো। ক্যান্ডিরু বা পায়ারা একটি ছোট প্রজাতির রক্তপিপাসু মাছ। এদের ভ্যাম্পায়ার ফিশও বলা হয়। এদের মুখের নীচের চোয়ালে ভ্যাম্পায়ারের মতো দুটো বড় বড় দাঁত থাকে। আকারে ৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। প্রধান খাদ্য হল পিরানহা মাছ। পিরানহার থেকেও ভয়ংকর মাছ কারনেনো। এই মাছ শরীরের যেকোনও ছিদ্র দিয়ে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে এবং একেবারে মারণ কামড় দেয়। আমাজন নদীর সবচেয়ে বড় আকারের মাছ অ্যারাপাইমা। এই মাছ লম্বায় ৩ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং ওজনে ২০০ কিলোগ্রামের বেশি হতে পারে। এদের জিভেও দাঁত রয়েছে। আমাজনের নদীতে দেখা মেলে ভয়ংকর এক সাপের। নাম গ্রিন অ্যানাকোন্ডা। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ও ভয়ানক সাপ। নির্বিষ এই সাপটিও নরখাদক নামে পরিচিত। এদের দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়। ওজনে ২৫০-৩০০ কেজিরও বেশি। এই সাপ সাঁতার কাটতে খুব পারদর্শী। শিকারকে মজবুত মাংসপেশির কুণ্ডলীতে জড়িয়ে ধরে দমবন্ধ করে মেরে ফেলে এবং তারপর গিলে ফেলে। সাপের মতো দেখতে অথচ সাপ নয়, এমনই একটি মাছ খোলা জলে ইলেকট্রিক তারের মতো ঘোরাফেরা করে। এরা ক্যাটফিশ প্রজাতির। এই মাছকে ‘ইলেকট্রিক ইল’ বলে। বিপদ বুঝলে এরা ৮৬০ ভোল্টের কারেন্ট ২ মিলি সেকেন্ডের জন্যে ছড়াতে পারে, যা একটি মানুষকে এক ঝটকায় শ্বাসরোধ করে দিতে পারে। আমাজন জঙ্গলে আসা পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে ভয়ের কারণ মশা। এই মশা পীতজ্বর, ম্যালেরিয়ার মতো প্রাণঘাতী জীবাণু মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। আমাজনের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় এক ধরনের বিশালাকার বিষাক্ত হলুদ পা-ওয়ালা বিছে। দৈর্ঘ্য প্রায় ১ ফুট। গহন অরণ্যেই রয়েছে আর এক খুদে বিষধর প্রাণী— ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডারিং মাকড়সা। আকারে ছোট এই মাকড়সাকে ‘ওয়ান্ডারিং স্পাইডার’ বলার কারণ এরা গাছে গাছে জাল বোনার বদলে রাতে জঙ্গলের মাটিতে ঘুরে বেড়ায় শিকারের জন্য। আরও এক ধরনের বিষধর লোমশ মাকড়সা হল ট্যারেন্টুলা। এখানেই পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত ব্যাঙ প্রজাতি বসবাস করে। ছোট এবং হলুদ রঙের অত্যন্ত আকর্ষণীয় ডার্ট ব্যাঙ আমাজনের জঙ্গলে দেখা যায়। বিশ্বের বিষাক্ততম প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম বলা চলে। বিপদ বুঝলেই হলুদ চামড়া থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়। আমাজন জঙ্গলে আর একটি অদ্ভুত জীব হল ক্যাপিবেরা ইঁদুর। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইঁদুর, যা একটি ছোট কুকুরের মতো হতে পারে। সাধারণত হাঙরদের সমুদ্রেই দেখা যায়। কিন্তু আমাজন নদীতে বুল শার্ক-এর দেখা পাওয়া যায়। আমাজনের বৃষ্টি-অরণ্যের কিছুটা অংশ সম্প্রতি দাবানলের প্রভাবে খাঁ খাঁ করছে। দাঁড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল পোড়া গাছ আর মৃত জীবজন্তুর দেহ। পরিবেশবিদরা বলছেন অনেকগুলো বছর লেগে যাবে এই ক্ষত ঢাকতে।