বুধবার, 21 মে 2025
Logo
  • বুধবার, ২১ মে ২০২৫

জালিয়াতির স্বর্গ-শহর

থাইল্যান্ড সীমান্ত। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মোয়ি নদী। ঠিক তার লাগোয়া মায়ানমারের মায়াওডি শহর, কারেন প্রদেশের অন্তর্গত।

জালিয়াতির স্বর্গ-শহর

দেবাঞ্জন দাস: থাইল্যান্ড সীমান্ত। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মোয়ি নদী। ঠিক তার লাগোয়া মায়ানমারের মায়াওডি শহর, কারেন প্রদেশের অন্তর্গত। এই অংশ যেন বরাবরই ‘অপরাধীদের চারণক্ষেত্র’! ‘নে পি ত’র গদিতে আন সান সুকির সরকারই হোক বা বর্তমানে ক্ষমতাসীন জুন্টা সরকার, কারও কখনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না মায়ানমারের এই অংশে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বেআইনি সোনা, ড্রাগস এবং আগ্নেয়াস্ত্র পাচারের মূলকেন্দ্র হয়ে ওঠে মায়াওডি জেলার থাইল্যান্ড সীমান্ত ঘেঁষা লাউকায়িং, কে কে পার্ক, ডংমেই এবং শোয়ে কোককো। এই অপরাধ র‌্যাকেটের নেপথ্য কারিগররা চীনা মাফিয়া ও ‘ওয়ারলর্ড’। মায়ানমারের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীও এই র‌্যাকেটে যুক্ত। আইনশৃঙ্খলা বিহীন এই অংশ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, চীন, আমেরিকা এমনকী ভারতেরও। তবে ২০১৭ সালে চীন থেকে বিতাড়িত কম্বডিয়ার এক নাগরিক সি ঝিজিয়াং অপরাধ মঞ্চে প্রবেশ করা মাত্রই পাল্টে যায় চিত্রপট। আট বছর আগে দুর্গম এই অংশে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল না বললেই চলে। তৎকালীন রাজধানী ইয়াঙ্গন থেকে তিনদিনের বেশি সময় লাগত এখানে পৌঁছতে। মাত্র আট বছরের মধ্যে দুর্গম এই অংশের চেহারা পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে এশিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাথা-যন্ত্রণা। মায়ানমারের কারেন প্রদেশের এই অংশের শোয়ে কোককো শহর এখন আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধীদের ‘সদর দপ্তর’। প্রতি বছর এখান থেকেই সাইবার অপরাধীরা ভারত সহ বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় হাজার হাজার কোটি টাকা।  
লাস ভেগাস বা ম্যাকাও না হলেও, বিলাস-বৈভবে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের ধনী শহরকে টক্কর দিতে পারে ৭৩ হাজার হেক্টর জমির শোয়ে কোককো। গগনচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, ম্যাসাজ পার্লার, ক্যাসিনো আর স্ফূর্তির যাবতীয় উপকরণকে ডালিতে সাজিয়ে এখানে তৈরি হয়েছে ‘ইয়াতাই নিউ সিটি’। রূপকার? গত ২০২২ সাল থেকে ব্যাংককের জেলে বন্দি সি ঝিজিয়াং। আদালতের নির্দেশ পেলেই ঝিজিয়াংকে চীনে প্রত্যর্পণ করবে থাই কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ব্যাংককের জেল থেকে বসেই উত্তরসূরি হি ইংজিয়ং এবং ‘লেফটেন্যান্ট’ ওয়াং ফুগুইকে দিয়ে ঝিজিয়াং চালিয়ে যাচ্ছে অপরাধ সাম্রাজ্য। ব্যাঙ্ক ফ্রড, লিঙ্ক ফ্রড, রোমান্স চ্যাট, অনলাইন শেয়ার ট্রেডিং, সেক্টটরশন, ক্রিপ্টো ইনভেস্টমেন্ট—গত কয়েক বছর ধরে এ রাজ্য তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের যে বা যাঁরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, তার ‘ভরকেন্দ্র’ শোয়ে কোককোই। 
কিন্তু সাইবার অপরাধীরা হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি সহ দেশের স্বীকৃত ১৪ ভাষাতেই প্রতারণার ফাঁদ পাতছে কী করে? তথ্য অনুযায়ী, আইটিতে পড়াশোনা করা বেকার যুবক-যুবতীদের মোটা বেতনের চাকরির টোপ দিয়ে আকৃষ্ট করা হয়। মূল সংস্থা থাইল্যান্ড। ডেটা অ্যানালিস্ট বা সাইবার এক্সপার্ট পদের চাকরি। যাঁরা ফাঁদে পা দেন, এজেন্টরা তাঁদের নিয়ে আসে থাইল্যান্ডে। তারপর চোরাপথে শোয়ে কোককো। শুরু হয় ‘গুলামি’। কার্যত ‘বন্ডেড লেবার’ হিসেবে দিন কাটাতে হয়। হুমকি, মারধর কালশনিকভের মুখে ‘সাইবার প্রতারণা চক্রে’ যুক্ত হতে বাধ্য হন যুবক-যুবতীরা। বেতন ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯০ হাজার টাকা। ওভারটাইমও আছে। থাকা-খাওয়া ফ্রি। চলতি সপ্তাহে গত সোম ও মঙ্গলবার মিলিয়ে এমন ৫৪০ জন ভারতীয় যুবক-যুবতীকে মায়ানমারের ওই ‘অন্ধকূপ’ থেকে উদ্ধার করে দিল্লি ফিরিয়ে এনেছে বিদেশ মন্ত্রক। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দারাও রয়েছে সেই তালিকায়। যাঁদের কেউ কেউ চার-পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছে শোয়ে কোককোর ‘পাতাল জগতে’। আরও কয়েকশো ভারতীয় যুবক-যুবতী এখনও সেখানে আটকে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। চীন ইতিমধ্যেই শোয়ে কোককে আটকে থাকা  নাগরিকদের দেশে ফিরিয়েছে।
জানা গিয়েছে, সমাজমাধ্যমে ওই এজেন্টরা মোটা বেতনের চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়। মোটা বেতনে আকৃষ্ট হয় আইটি প্রশিক্ষিতরা। এরপর মগজধোলাই করে তাঁদের সাইবার অপরাধ জগতে পাঠানোর ভার ঝিজিয়াংয়ের এজেন্টদের। ভারতীয় দূতাবাস শোয়ে কোককোর অপরাধ সাম্রাজ্যের এজেন্ট হিসেবে এদেশের বেশ কয়েকজন বাসিন্দাকে চিহ্নিত করেছে। খোঁজ মিলেছে দুবাইবাসী এজেন্টদেরও। তাদের মধ্যে কয়েকজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এদের বিষয়ে ইতিমধ্যেই দুবাই প্রশাসনের সঙ্গে বিদেশ মন্ত্রক কথা বলেছে। 
কীভাবে চলে ‘চক্র’? সূত্রের খবর, শোয়ে কোককো শহরের নিয়ন্ত্রণ সি ঝিজিয়াংয়ের হংকং বেসড কোম্পানি ‘ইয়াতাই ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানি’র হাতে। শহরটা গড়েছে তারাই। প্রাথমিক বিনিয়োগ হয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলার, পরে তা ৫৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছয়। এই ‘নিউ সিটি’র গোটাটাই তৈরি হয়েছে সাধারণকে প্রতারিত করা অর্থে। এই সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্বে কারেন প্রদেশের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘বর্ডার গার্ড ফোর্স’ (বিজিএফ)-এর কাঁধে। জুন্টা সরকারের সমর্থক বিজিএফ প্রধান সাউ চিট থু’র সঙ্গে ২০১৬ সালে রীতিমতো চুক্তি করে সি ঝিজিয়াং। ‘সাইবার ফ্রড সিটি’ গড়ার জন্য অর্থ, যন্ত্র ও নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করবে ঝিজিয়াং। আর ৬ হাজার মিলিশিয়া বাহিনীর প্রধান সাউ চিট অর্থের বিনিময়ে দেবে নিরাপত্তা।  মাসে ২-৩ বিলিয়ন ডলার ‘প্রোটেকশন মানি’ পায় বিজিএফ। 
এই এলাকাকে চারটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। মূল ফটক সহ বাইরে গোটা এলাকা পাহারা দেয় বিজিএফ। ভিতরের নিরাপত্তায় চাইনিজ মিলিশিয়া এবং মায়ানমার পুলিস। ‘সাইবার অপরাধ চক্র’ পরিচালনার জন্য ৩০টি কোম্পানি রয়েছে। এগুলির সবই ‘শেল’ কোম্পানি। এহেন কোম্পানিগুলির দপ্তর ১৮ থেকে ২০ তলা ভবনে। সর্বোচ্চ তলায় বসেন ঝিজিয়াং নিযুক্ত কোম্পানি হেড। লিফ্টে সেখানে যাওয়ার ছাড়পত্র সবার নেই। সিঁড়িতেও কুকুর নিয়ে সশস্ত্র পাহারা। পরের দু’টি তলায় কোম্পানির সিনিয়র অফিসাররা বসেন। তারপর কয়েক তলায় আবাসন। ৫ এবং ৬ তলায় ‘স্ক্যাম সেন্টার’। নীচের তলায় যৌনতা আর স্ফূর্তির আলয়। এখানেই রয়েছে ‘হাই রুম’ (মাদক বিক্রি ও সেবনের ‘ঠেক’)। প্রতিটি কোম্পানিতে কমপক্ষে ৫০০ কর্মী রয়েছে। স্ফূর্তির এই ঠেকে ‘যৌনদাসী’রা মূলত থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, চীন ও ভিয়েতনামের। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় যুবক-যুবতীদের মূলত সাইবার অপরাধের ফাঁদ পাতার কাজে লাগানো হয়। সেক্সটরশন, রোম্যান্স চ্যাট, ক্রিপ্টো ইনভেস্টমেন্ট, অনলাইন শেয়ার ট্রেডিং—সাধারণ মানুষকে প্রলোভিত করার জন্য শোয়ে কোককোতে আলাদা আলাদা টিম রয়েছে। মেন্টররা তাদের গ্রুমিং করে। টিমে থাকার শর্ত একটাই, সংশ্লিষ্ট দেশ বা রাজ্যের ভাষা তো জানতেই হবে, সঙ্গে বলতে হবে ঝরঝরে ইংরাজি। 
অপরাধ সাম্রাজ্যের কারিগর ঝিজিয়াং আসলে কে? গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে চীনের হুনান প্রদেশে জন্ম। অপরাধে জড়িয়ে ২১-২২ বছরে বিতাড়িত হয় সেখান থেকে। এরপর ফিলিপিন্সে চালু করে অনলাইন জুয়া। বেআইনি লটারি চালানোর দায়ে ২০১৪ সালে চীনের আদালত ঝিজিয়াংকে দণ্ডিত করে। কিন্তু অন্য দেশে থাকায় তাকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। কম্বডিয়ার জুয়ার কারবারে ২০০০ কোটি টাকা (ভারতীয় মুদ্রায়) বিনিয়োগ করে ঝিজিয়াং জুটিয়ে নেয় সেদেশের নাগরিকত্ব। বিশ্বের এক নম্বর সাইবার প্রতারক ‘কোম্পানি’র প্রধানের বিজনেস সেটআপ এখন মায়ানমার ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কমপক্ষে ছ’টি দেশে পৌঁছেছে। জাল ছড়িয়েছে জি জিনপিংয়ের দেশেও। মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠা ঝিজিয়াংকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের দ্বারস্থ হয় বেজিং প্রশাসন। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে  থাইল্যান্ডের ফুকেতে একঝাঁক সুন্দরীবেষ্টিত অবস্থায় এক প্রমোদতরী থেকে গ্রেপ্তার হয় ঝিজিয়াং। ঠাঁই হয় ব্যাংককের জেলে। প্রত্যার্পণ চাইছে চীন। তা ঠেকাতে ভারতীয় মুদ্রায় ৫০০ কোটিরও বেশি খরচ করেছে ঝিজিয়াং। এখন চীনের উপর বেজায় খাপ্পা সে। শাগরেদ ওয়াং ফুগুইয়ের মাধ্যমে জানিয়েছে—‘শোয়ে কোককোকে নিজেদের ‘কলোনি’ বানাতে চেয়েছিল চীন। চাপ দিচ্ছিল সে দেশের স্টেট সিকিউরিটি কন্ট্রোল মিনিস্ট্রি। না মেনে নেওয়ায় বিশ্বাসঘাতক তকমা দিয়ে জেলে পুরেছে।’