বৃহস্পতিবার, 17 জুলাই 2025
Logo
  • বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মেখে

কী সুন্দর মায়াময় এই বিশাল পৃথিবী! সুনীল সাগর থেকে উত্তুঙ্গ পর্বতমালা, ঊষর মরুভূমি থেকে গহীন অরণ্য, গগনচুম্বী অট্টালিকার নগরী থেকে প্রাচীন জনপদ—সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে অপার সৌন্দর্য। তারই সন্ধানে ছুটে বেড়ায় ভ্রমণ পিয়াসী মন। তাই তো পাখির ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মেখে উড়ে চলা। দলবদ্ধভাবে কিংবা একা।

ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মেখে

হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চল প্রদেশে পাহাড়ের বুকে গড়ে উঠেছে ক্যান্ডি শহর। এটি শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজধানী তথা এ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এ শহরে যেমন রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন স্থাপত্য, তেমনই রয়েছে নয়নাভিরাম হ্রদের গায়ে আধুনিক হোটেল, রেস্তরাঁ প্রভৃতি। তবে পান্না সবুজ পাহাড় ঘেরা ক্যান্ডি শহর সর্বাধিক বিখ্যাত তাঁর বুদ্ধ মন্দিরের জন্য। সারা পৃথিবীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র তীর্থক্ষেত্র এটি। কলম্বো থেকে ক্যান্ডির দূরত্ব সড়ক পথে দেড়শো কিলোমিটার। খাতায় কলমের হিসাবে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগার কথা হলেও বাস্তবে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা। কখনওবা তারও বেশি। এর কারণ, পাহাড়ি অঞ্চলের অপরিসর রাস্তা এবং যানজট। তবে প্রকৃতি এখানে অকৃপণ বলে চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাত্রাপথের বিলম্ব, গাড়ির থেমে থেমে চলা মানিয়ে নেওয়া যায়।
হাতি গ্রাম পিন্নাওয়ালা থেকে ক্যান্ডির দূরত্ব চল্লিশ কিলোমিটার। পিন্নাওয়ালার ওয়া নদীতে হাতিদের স্নান দেখতে দেখতেই বৃষ্টি নেমেছিল। যখন ক্যান্ডির উদ্দেশে রওনা হলাম, তখনও বৃষ্টি হয়েই চলেছে। পাহাড়ি রাস্তা, পাকদণ্ডীর দু’পাশে বর্ষণসিক্ত সবুজ বনানী। তার মাথায় খেলা করছে মেঘরাশি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম চোখে পড়ছে। এ রাস্তাও যেন অনেকটা দার্জিলিং-কালিম্পং যাওয়ার রাস্তাকেই মনে করিয়ে দেয়। কোথাও পাহাড়ের গা থেকে ঝোরা বা ছোট ঝর্ণাও নেমে এসে পথ ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমার গাড়ির চালকের মুখে শুনলাম সমুদ্রতট থেকে বেশ দূরে হলেও ক’দিন ধরে নাকি মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ে চলেছে ওখানে। যাত্রাপথে প্রায়ই চুলের কাঁটার মতো বাঁক। সেখানে এসে কিছু সময়ের জন্য থমকে যাচ্ছে গাড়ি। আগের গাড়িকে এগিয়ে যেতে দেওয়ার জন্য বা বিপরীত দিক থেকে আশা গাড়িকে নীচে নামার রাস্তা করে দেবার জন্য। বর্ষণমুখর সিংহল পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ভাবছিলাম, যে মন্দির আমি দর্শন করতে যাচ্ছি তার মাহাত্ম্যের কথা, ইতিহাসের কথা, আমাদের দেশের সঙ্গে, আমাদের বাংলার প্রাচীন এক জনপদের সঙ্গে সেটির সম্পর্কের কথা।
ক্যান্ডি মন্দিরের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। মহাপরিনির্বাণ ঘটল ভগবান বুদ্ধর। কুশীনগরের রাজকাননে তাঁর নশ্বর শরীর সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হওয়ার আগেই প্রবল বর্ষণে নিভে গেল চিতার আগুন। তাঁর দেহের কয়েকটি অস্থিকে তখনও সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে নিতে পারেনি অগ্নি। সেইসব পবিত্র অস্থির অধিকার নিয়ে উপস্থিত রাজন্যবর্গ ও সঙ্ঘের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হলে সম্রাট অজাতশত্রু সেই অস্থি সকল সংগ্রহ করে বিবাদের নিষ্পত্তি ঘটান এবং সেগুলি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান তার ওপর স্তূপ নির্মাণ করবেন বলেন। সবাই সে স্থান ত্যাগ করার পর এক বুদ্ধ শিষ্য চিতা থেকে পবিত্র ভস্মকণা সংগ্রহ করতে গিয়ে তার ভিতর থেকে খুঁজে পান একটি দন্ত। ভগবান বুদ্ধর বাঁ দিকের ছেদক দন্ত। এই দন্তর অধিকার নিয়ে রাজন্যবর্গর মধ্যে নতুন করে সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে—এ কথা ভেবে বুদ্ধ শিষ্য সেই পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন বহন করে বৈশালী নগরী ত্যাগ করে এসে উপস্থিত হন সে সময় কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত এক স্থানে। সেখানে তিনি এক মন্দির স্থাপন করে পবিত্র দন্ত ধাতুটি স্থাপন করেন। জায়গাটির নামকরণ করা হয় দন্তপুর। যা আজকে পশ্চিমবঙ্গের দাঁতন নামে পরিচিত। তারপর প্রায় সহস্র বছর অতিক্রান্ত হয়। সবার অলক্ষে ক্ষুদ্র মন্দিরে রয়ে গিয়েছিল সেই পবিত্র শেষ চিহ্ন। হাজার বছর আগে কলিঙ্গর রাজা ছিলেন গুহশিব। ততদিনে সম্রাট অজাতশত্রু, সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্য মুছে গিয়েছে এ দেশের মাটি থেকে। মহাকালের রথচক্র স্থলে হারিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। সনাতন ধর্ম মতে, মৃতের অস্থি অপবিত্র বস্তু হিসাবে চিহ্নিত হতো। তাই প্রথমে রাজা গুহশিব ওই দন্তটিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হন। কিন্তু পালি গ্রন্থে কথিত তিনি ওই পবিত্র দন্তের অলৌকিক ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে যে কার্য থেকে বিরত হন এবং ভগবান বুদ্ধর মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত হয়ে নিজে ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ গ্রহণ করেন। কিন্তু রাজন্যবর্গ এরপরও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন ওই দন্ত ধাতুটিকে ধ্বংস করার জন্য। বারবার দন্তনগরী আক্রমণের শিকার হতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় রাজা গুহশিব সে সব আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত অস্মক রাজ্যের সেনাদের কাছে পরাজিত হন এবং নিহত হন। মৃত্যুর আগে রাজা গুহশিব তাঁর কন্যা হেমমালা ও জামাতা দণ্ডকুমারকে নির্দেশ দিয়ে যান ওই পবিত্র দন্ত ধাতুকে লঙ্কাদ্বীপে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কারণ সিংহল নৃপতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তিনিই রক্ষা করতে পারবেন ওই পবিত্র শেষ চিহ্নকে। অম্মক রাজ্যের সেনারা এসে দন্তনগরী ও দন্তমন্দির ধ্বংস করে ঠিকই কিন্তু তার আগেই রাজা গুহশিবের নির্দেশ মতো দণ্ডকুমার ও হেমমালা ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশ ধারণ করে ওই পবিত্র দন্ত নিয়ে দন্তপুর ত্যাগ করেন। প্রচণ্ড কষ্ট স্বীকার করে তাঁরা একদিন উপস্থিত হন তাম্রলিপ্ত বন্দরে। নিজেদের পরিচয় গোপন করে দন্তটিকে লুকিয়ে নিয়ে তাঁরা এক বাণিজ্য তরীতে উঠে যাত্রা করেন সিংহল দ্বীপের উদ্দেশে। তাঁদের যাত্রা পথেও নানা বাধা বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সকল ঝড় অতিক্রম করে পৌঁছতে সমর্থ হন গন্তব্যে। পবিত্র দন্ত ধাতুটিকে তাঁরা সমর্পণ করেন সে সময়ের বৌদ্ধ নৃপতি মহাদিসেনের হাতে। শেষ হয় ভগবান বুদ্ধর শেষ চিহ্নর হাজার বছরের পথ পরিক্রমা। ভগবান বুদ্ধর ওই পবিত্র স্মৃতি চিহ্ন আজও সংরক্ষিত আছে ক্যান্ডি মন্দিরে। যার পোশাকি নাম ‘শ্রী দলদা মালিগাঁও টুথ রেনিক টেম্পল’। ভগবান বুদ্ধর নশ্বর শরীরের চিহ্ন ক্যান্ডির এই বুদ্ধ মন্দিরে সংরক্ষিত আছে বলেই এই 
প্রাচীন মন্দির বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান তীর্থক্ষেত্র এবং ইতিহাস গবেষকদের কাছেও একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
বর্ষণসিক্ত পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আর দন্তধাতুর ইতিহাস স্মরণ করতে করতেই চলছিলাম আমি। কিন্তু গাড়ি যত ওপরে উঠতে লাগল বর্ষণ তত বাড়তে লাগল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। পাহাড়ি পথে গাড়ির উইন্ড শিল্ডের দশ হাত দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমার হাত ঘড়িতে ইতিমধ্যে বিকাল চারটে বেজে গেছে। যতটুকু জানি পাঁচটার পর মন্দিরের প্রবেশ তোরণ বন্ধ হয়ে যায় বাইরের লোক বা পর্যটকদের জন্য। আমার গাড়ির চালককে কখন সেখানে পৌঁছব তা জিজ্ঞেস করাতে সেও নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারল না। সে শুধু বলল, ‘দেখছেন তো রাস্তার অবস্থা!’
তবে কি আমি ক্যান্ডি মন্দিরে প্রবেশ করতে পারব না। অত দূর এসে আমাকে ফিরে যেতে হবে? আশঙ্কার মেঘ জমতে শুরু করল আমার মনে। কিন্তু ভগবান বুদ্ধ কৃপা করলেন হয়তো। মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ হওয়ার আগেই আমি শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছে যেতে সমর্থ হলাম। আরও এক আশ্চর্যের ব্যাপার প্রবেশদ্বারে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টিও থেমে গেল। ছোট মন্দির আকৃতির শ্বেত শুভ্র প্রবেশ তোরণ। বেশ কয়েক একর জায়গা নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ। তার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছে শ্বেতশুভ্র দন্ত মন্দির। আর তাকে ঘিরে নানা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কাঠের কারুকাজ করা শেডওলা বিশাল বিশাল প্রার্থনা স্থল, উপমন্দির, বৌদ্ধ শ্রমণদের বাসস্থান, দলদা মন্দিরের প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদি। মেঘ কেটে গিয়ে বেলা শেষের ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়েছে প্রাঙ্গণে। সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নানা দেশ থেকে আগত বৌদ্ধ পুণ্যার্থী, পর্যটক ও শ্রমণের দল। তবে দন্ত মন্দিরের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা অধিকাংশই শুভ্র বস্ত্র পরিধান করেন। এ প্রসঙ্গে একটা কথা জেনে রাখা প্রয়োজন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্লিভলেস ও শর্টপ্যান্ট পরে ক্যান্ডি মন্দিরে প্রবেশ করা নিষেধ। আর পোশাকে এমন কোনও ছবি থাকা চলবে না, যা মন্দিরের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মূল মন্দিরের ভিতর অবশ্যই খালি পায়ে প্রবেশ করতে হবে। পায়ে মোজা রাখাও চলবে না।
সিকিউরিটি কর্মী আমাকে তাঁর কক্ষে অপেক্ষা করতে বলে খানিক সময়ের জন্য অন্যত্র চলে গেলেন। ফিরে এসে জানালেন ক্যান্ডি মন্দিরের মুখ্য আধিকারিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শ্রীঅনুরা বন্দরা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী। অতঃপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল সন্ন্যাসীর কক্ষে। প্রাচীন তালপাতার পুঁথি আর নানান গ্রন্থে পরিপূর্ণ সেই কক্ষ। আমার মতো অনাহূত অতিথির প্রতি বৃদ্ধ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তথা ক্যান্ডি মন্দিরের প্রধান প্রশাসনিক আধিকারিকের সৌজন্য ভোলার নয়। সন্ন্যাসী সিংহলি হলেও তিনি ইংরেজি বলতে ও বুঝতে পারেন। এমনকী হিন্দিও। কাজেই কথা বলতে অসুবিধা হল না। আমার লেখা বইটি তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন ক্যান্ডি মন্দিরের গ্রন্থাগারের জন্য। বহু দেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও গবেষকরা বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ পাঠ করতে আসেন সেখানে। প্রতি উপহার স্বরূপ তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন ক্যান্ডি মন্দিরের মুখপত্রের কয়েকটি সংখ্যা। সিংহলি ভাষায় লেখা হলেও যা আমার কাছে রয়ে যাবে ক্যান্ডি মন্দিরের স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে। সন্ন্যাসী অনুরা বন্দরাকে আমি আমার কৃতজ্ঞতা আর প্রণাম জানিয়ে সে কক্ষ ত্যাগ করে এগলাম অনতি দূরে অবস্থিত ক্যান্ডির মূল মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য। যেখানে রক্ষিত আছে ভগবান বুদ্ধর স্মৃতি চিহ্ন। মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে দর্শনার্থীদের টিকিট কাটতে হয়। ভারতীয় মুদ্রায় হিসেব করলে টিকিটের দাম আনুমানিক দুশো টাকা। কিন্তু সন্ন্যাসী অনুরার বদান্যতায় আমার কোনও টিকিটের প্রয়োজন হল না। আমার পথপ্রদর্শকের সঙ্গে প্রবেশ করলাম মন্দিরের ভিতর।
আমার সঙ্গী বৌদ্ধভিক্ষু আমাকে ক্যান্ডি মন্দিরের বিষয়ে বলতে বলতে নিয়ে চললেন। এ মন্দিরের প্রাচীনতম যে অংশটি আছে তা নির্মিত হয় সিংহল সম্রাট তৃতীয় বিক্রমবাহের রাজত্বকালে ত্রয়োদশ শতকে। সিংহলে ভগবান বুদ্ধর শেষ চিহ্ন প্রথমে যে মন্দিরে রক্ষিত ছিল। বিক্রমবাহ সে মন্দির থেকে পবিত্র দন্তটিকে এ মন্দিরে এনে স্থাপন করেন। সে সময় এ স্থানের নাম ছিল যেঙ্কাদাগালাপুরা। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক এ মন্দির ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের’ শিরোপা লাভ করেছে। আমার পথপ্রদর্শকের কথা শুনতে শুনতে আর চারপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। মন্দিরের বাইরের শ্বেতপাথর মোড়া অংশটি নবীন। যে কারণে বাইরে থেকে সাদা বলে মনে হয় এ মন্দিরকে। বিভিন্ন বুদ্ধ মূর্তি রাখা আছে এ স্থানে। তাদের অধিকাংশই শ্বেত পাথরের তৈরি। এর ভিতরের অংশটি পাথরের তৈরি। কালচে বেলেপাথর। মন্দিরের এ অংশের বয়স আনুমানিক চার-পাঁচশো বছর। পাথরের স্তম্ভ খিলান সবই নানা ধরনের অলঙ্করণ ও চিত্র শোভিত। মাথার ওপর থেকে ঝুলছে বৌদ্ধমন্ত্র লেখা পতাকা বা থাংকা। তবে তিব্বতি বৌদ্ধ মন্দিরের সঙ্গে এ মন্দিরের পার্থক্য হল এখানে কোনও ভয় ধরানো ড্রাগন মূর্তি নেই। যা আছে তা হল স্নিগ্ধ শান্ত বুদ্ধ মূর্তি বা নরনারীর মূর্তি। মন্দিরের এ অংশ দেখা শেষ করে আমরা এক সময় উপস্থিত হলাম মন্দিরের প্রাচীনতম স্থানে। সেখানে রয়েছে কাঠ ও পাথর নির্মিত একটি গর্ভগৃহ বা কক্ষ। সেটিই আসলে প্রাচীন দন্তমন্দির, সেখানে রক্ষিত আছে ভগবান বুদ্ধর পবিত্র দন্ত। জায়গাটায় আলো খানিকটা কম। ধূপের সুগন্ধ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। যে স্থানে উপস্থিত হলে প্রথম যে ব্যাপারটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল চারপাশে সাজিয়ে রাখা আছে অসংখ্য হাতির দাঁত। হস্তী দন্ত দিয়ে সাজানো আছে মন্দিরের চারপাশ, যার ভিতর রক্ষিত আছে ভগবান বুদ্ধর দাঁত—তাঁর শেষ চিহ্ন! গর্ভ মন্দিরে তোরণদ্বারের দু’পাশে যে হাতির দাঁত দুটো প্রহরীর মতো স্থাপন করা আছে আকৃতিতে তা মানুষের চেয়েও বড়। এতবড় হাতির দাঁত আমি ইতিপূর্বে কোনও মন্দির বা মিউজিয়ামে দেখিনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা ও ধনী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ওইসব বহুমূল্য হাতির দাঁত উৎসর্গ করেছেন ভগবান বুদ্ধর পবিত্র দন্তর উদ্দেশে। দন্ত একটি শুভ্র বস্তু বলেই সম্ভবত এ মন্দিরে শুভ্র ভাবের এত আধিক্য। গর্ভ মন্দিরের চারপাশে ধাতু ও পাথর নির্মিত নানান প্রাচীন সামগ্রীও রাখা আছে। কিছু সময় গর্ভগৃহর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে যেন আমার মন ভরে উঠল। দন্ত মন্দিরের গর্ভগৃহর চারপাশ প্রদক্ষিণ করিয়ে পথপ্রদর্শক আমাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন কাছেই এক কক্ষে। নানা প্রাচীন মূর্তি, হাতির দাঁত, মন্দিরকে দেওয়া নানা বহুমূল্য দানসামগ্রী রয়েছে সেখানে। তবে সে কক্ষর ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সে স্থান দেখা শেষ হলে আমি গিয়ে উপস্থিত হলাম ক্যান্ডি মন্দিরের পশ্চাৎভাগে অবস্থিত মিউজিয়ামে। তার সামনে বিশালাকৃতির একটি বুদ্ধমূর্তি আছে। মিউজিয়াম দেখার পর আমার ক্যান্ডি মন্দির দেখা শেষ হল। সঙ্গী বৌদ্ধ ভিক্ষুর থেকে বিদায় নিয়ে ভগবান বুদ্ধর পবিত্র চিহ্নর উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ ত্যাগ করলাম।
পাহাড়ের যে ধাপে মন্দির তার কিছুটা নীচেই ক্যান্ডি লেক অবস্থিত। সিংহলের বিখ্যাত স্বাদু জলের হ্রদ—ক্যান্ডি হ্রদ। মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে যখন সেই হ্রদের পাড়ে গিয়ে নামলাম অতক্ষণে সূর্য অস্ত গিয়েছে। তার লাল আভাটুকু শুধু ছড়িয়ে আছে পাহাড়ের মাথায়। পর্যটকের দলও রওনা হয়েছে ঘরে ফেরার জন্য। হ্রদের ওপরে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতশুভ্র ক্যান্ডি মন্দির। তার আবছা ছায়া এসে পড়েছে হ্রদের জলে। একসময় সেই হ্রদের জল গাঢ় হয়ে এল। বিন্দু বিন্দু আলো জেগে উঠতে লাগল ক্যান্ডি মন্দিরে। সন্ধ্যারতির প্রস্তুতি শুরু হয়েছে সেখানে। এক বুক প্রশান্তি নিয়ে আমি যখন হ্রদের পাড় ছেড়ে ফেরার জন্য রওনা হলাম, তখন ক্যান্ডি মন্দির থেকে ভেসে আসছে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ ধ্বনি।


ছবি সৌজন্যে: সুখেন্দুকুমার সিনহা 
ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য

রাশিফল