শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

ওজোন গ্যাসের রক্ষাকবচ

বায়ুমণ্ডল আমাদের পৃথিবীকে ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে। পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে বায়ুমণ্ডলের গুরুত্ব লিখে শেষ করা যাবে না। এই বায়ুমণ্ডলের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ওজোন স্তর। এই স্তরই সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি বা আল্ট্রাভায়োলেট রে (ইউভি)-র ক্ষতিকারক অংশ শুষে নেয়। 

ওজোন গ্যাসের রক্ষাকবচ

বায়ুমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওজোন স্তর। এই স্তরই সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি শুষে নেয়। তা নাহলে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছত। ফলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যেত।

স্বরূপ কুলভী: বায়ুমণ্ডল আমাদের পৃথিবীকে ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে। পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে বায়ুমণ্ডলের গুরুত্ব লিখে শেষ করা যাবে না। এই বায়ুমণ্ডলের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ওজোন স্তর। এই স্তরই সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি বা আল্ট্রাভায়োলেট রে (ইউভি)-র ক্ষতিকারক অংশ শুষে নেয়। তা নাহলে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৌঁছত। এতে মানুষের ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যেত। বিভিন্ন প্রাণীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ত। তেমন হলে নানা ধরনের রোগ বাসা বাঁধত। ফলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যেত। তাছাড়া ফসলের ফলনেও প্রভাব পড়ত।  ছোট্ট বন্ধুরা, তাহলে বুঝতেই পারছ, ওজোন স্তর কীভাবে আগলে রেখেছে আমাদের। এখন প্রশ্ন হল, এই ওজোন স্তর কোথায় থাকে? কীভাবে গড়ে উঠল এই স্তর।
তার আগে বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। পৃথিবীর চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান। একেই বায়ুমণ্ডল বলা হয়। তবে এই বায়ুমণ্ডল কি সবসময় ছিল? আমাদের পৃথিবীর বয়স মোটামুটি ৪৬০ কোটি বছর। সৃষ্টির সময় পৃথিবী গলিত অবস্থায় ছিল। এর চারদিকে তখনও সামান্য বায়ুমণ্ডল ছিল। তারপর পৃথিবী যখন ঠান্ডা হতে শুরু করল, তখন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে বের হওয়া গ্যাসগুলি গিয়ে বায়ুমণ্ডল তৈরি করল। কিন্তু এই বায়ুমণ্ডল কিন্তু এখনকার মতো ছিল না। সেখানে হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেশি ছিল। যুগ যুগ ধরে পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় এসেছে বায়ুমণ্ডল। পৃথিবী থেকে যত উপরের দিকে ওঠা যাবে, ততই বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন অংশে উষ্ণতার তারতম্য দেখা যায়। এজন্য বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলকে ছ’টি স্তরে ভাগ করেছেন। সেগুলি হল— ট্রপোস্ফিয়ার, ট্র্যাটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার, থার্মোস্ফিয়ার, এক্সোস্ফিয়ার, ম্যাগনেটোস্ফিয়ার। এরমধ্যে একদম নীচের স্তর হল ট্রপোস্ফিয়ার। তার ওপরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। এরই একটা অংশ হল ওজোন স্তর। আর থার্মোস্ফিয়ারের নীচের অংশটি আয়নোস্ফিয়ার। বেতার তরঙ্গ এই স্তরে প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে।
পৃথিবীর উপরের ১০ থেকে ৫০ কিলোমিটারের অংশের নামই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। এর মধ্যে ১৫-৩০ কিলোমিটার অংশ হল ওজোন স্তর। এই ওজোন কী? ওজোন হল একটি গ্যাস, যা অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ অক্সিজেনেরই প্রকার ভেদ। বাতাস থেকে প্রশ্বাসের সঙ্গে আমরা অক্সিজেন নিই। একটি অক্সিজেনের অণু দু’টি পরমাণু দিয়ে তৈরি হয়। তাই এর রাসায়নিক সংকেত হল O2।  কিন্তু ওজোন বিষাক্ত গ্যাস। এটি অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু নিয়ে তৈরি। তাই এর রাসায়নিক সংকেত হল O3। বাতাসে খুব বেশি ওজোন থাকলে, তা ফুসফুসের পক্ষে একেবারেই ভালো নয়। 
যাইহোক, এখন প্রশ্ন হল, বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তর কীভাবে গঠিত হল? ওজোন গ্যাস কিন্তু খুব ছটফটে। মানে অত্যন্ত সক্রিয়। যা সহজেই অন্য পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। উষ্ণতা বেড়ে গেলে বা ঘনত্ব বেশি হলেই তা ভেঙে যায়। একটা অক্সিজেন পরমাণু ছেড়ে অক্সিজেনে পরিণত হয়। বাকি একটা পরমাণু কোথায় যায়? ওই পরমাণু অন্য কোনও পদার্থ বা জৈব পদার্থের সঙ্গে খুব দ্রুত বিক্রিয়া করে। বায়ুমণ্ডলের ট্র্যাটোস্ফিয়ার অংশে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ওজোন স্তরে ভাঙা গড়ার কাজ নিরন্তর চলছে। এই রশ্মির প্রভাবে অক্সিজেন অণু ভেঙে যায়। কিন্তু এরফলে যে অক্সিজেন পরমাণু তৈরি হয়, তা খুব বেশি সময় আলাদা থাকতে পারে না। তিনটি অক্সিজেন পরমাণু মিশে তৈরি হয় ওজোন। এই ওজোন অণুও খুব বেশি স্থিতিশীল নয়। সেটাও ওই রশ্মির প্রভাবে ভেঙে যায়। এর অক্সিজেন অণু সঙ্গে সঙ্গে অন্য অক্সিজেনের ভাঙা অণুর সঙ্গে হাত মেলায়। তখন আবার তৈরি হয় ওজোন। 
পৃথিবীর জন্মের সময় কিন্তু ওজোন স্তর ছিল না। যুগ যুগ ধরে পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকের পৃথিবী গড়ে উঠেছে। বহু কোটি বছর পর পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রাণের হাত ধরেই ওজোন স্তর গড়ে ওঠে। আর মজার ব্যাপার হল, এই ওজোন স্তরই পৃথিবীতে প্রাণ রক্ষা করে চলেছে।  ওজোন তৈরির জন্য দরকার অক্সিজেন। কিন্তু আমাদের গ্রহে একসময় অক্সিজেন ছিল না।  তাই পৃথিবীর ওজোন স্তরের রক্ষাকবচও ছিল না। তখন অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে চলে আসত। তাই পৃথিবীর স্থলভাগে সেভাবে কোনও প্রাণী আসেনি। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয় বহু বহু কোটি বছর পর।  বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীতে অক্সিজেন এসেছিল জল থেকে। দু’টি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু মিশে তৈরি হয় জল। তাই জলের অণু ভাঙলেই অক্সিজেন মিলবে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন এসেছিল নীলচে-সবুজ একটা এককোষী ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। এই স্বভোজী প্রাণ জলের অণু ভেঙে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন তৈরি করতে শুরু করে। কারণ, এই আদি কোষ দিয়ে তৈরি প্রাণ সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করতে পারত। সূর্যের আলো, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জল ব্যবহার করে গাছপালার খাবার তৈরির প্রক্রিয়াকে বলে সালোকসংশ্লেষ। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় অক্সিজেন। আর এভাবেই সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে যে অক্সিজেন তৈরি হচ্ছিল, সেগুলিই ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলে জমা হতে থাকে। এভাবে জমতে জমতে বেশ কিছুটা অক্সিজেন তৈরি হয়। এখন বায়ুমণ্ডলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ অক্সিজেন। একটা সময় এল ধীরে ধীরে যে অক্সিজেন জমল, তার পরিমাণ এখনকার তুলনায় ১০ শতাংশের মতো। তখন বায়ুমণ্ডলের ওপরের দিকে কিছু অক্সিজেন অণু (O2) সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে ভেঙে যায়। অক্সিজেন অণুর দুটো পরমাণু যখন ভেঙে আলাদা হয়ে গেল, তখন একটি করে পরমাণু অন্য কিছু অক্সিজেন অণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে ফেলে তিন পরমাণুবিশিষ্ট অক্সিজেন অণু। মানে ওজোন (O3) গ্যাস। এভাবে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ওজোন স্তর। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা পায় পৃথিবী। আর এই বর্মের হাত ধরে বিভিন্ন রকমের পরভোজী প্রাণ তৈরি হল। তারপর স্থলভাগেও গাছপালার জন্ম হয়। আর সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আরও বেশি অক্সিজেন তৈরি হতে থাকে। তাহলেই ভাব, ওজোন স্তরের বর্ম না থাকলে প্রাণের বৈচিত্র্য কি থাকত?