শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

বিতর্কের মুঘলনামা

রুক্ষ, ধূসর এবং শুষ্ক কাঁটাঝোপের এই মরুভূমির রাজ্যে কীভাবে যেন ঠাঁই করে নিয়েছে এক টুকরো সবুজ গ্রাম! মারওয়াড়ের সালওয়া সদর থেকে কিছু দূরে এই গ্রামের নাম লুনওয়া।

বিতর্কের মুঘলনামা

সমৃদ্ধ দত্ত: রুক্ষ, ধূসর এবং শুষ্ক কাঁটাঝোপের এই মরুভূমির রাজ্যে কীভাবে যেন ঠাঁই করে নিয়েছে এক টুকরো সবুজ গ্রাম! মারওয়াড়ের সালওয়া সদর থেকে কিছু দূরে এই গ্রামের নাম লুনওয়া। রাজস্থানের ঊষর ভূমির মধ্যে হঠাৎ ঘন তৃণভূমি, ছোট গাছ আর জলের সংস্থান থাকা এই গ্রাম মহারাজা যশবন্ত সিংয়ের খামারবাড়ির পশুপালকদের খুব পছন্দের। কারণ, পোষ্যদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হবে না সামান্য ঘাসপাতা আর জলের জন্য।
১৬৫৫ সাল। মহারাজার এক পশুপালক একপাল প্রাণী নিয়ে ঘুরছে এই গ্রামে। উটই বেশি। তবে অন্য পশুও আছে। তাই প্রয়োজন সবুজ ঘাস, পাতা, জল। কিন্তু গ্রামবাসীরা ক্ষুব্ধ। ক্রুদ্ধ। সন্ত্রস্ত। পশুর দল যে কোনও সময় ফসলের জমিতে ঢুকে পড়ছে। খাচ্ছে যা, তার থেকে বেশি ধ্বংস করছে। কিন্তু কী করা যাবে? এ তো আর নিছক পশুপালক নয়। রাজকর্মচারী। আর সেই দম্ভেই রাজার প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনও তাড়না নেই তাঁদের। অথচ এই মরুদেশে ফসল ফলানো যে কী কষ্টকর! কোনওমতে তা দিয়ে কিছু মাসের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি সম্পন্ন হয়। আর সেখানেও এই বিপদ! নিজেদের ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিচ্ছে গ্রামবাসীরা।
খবর গেল গ্রামের একপ্রান্তে থাকা তুলনামূলক সম্পন্ন এক পরিবারের তরুণের কাছে। মায়ের সঙ্গে থাকে সে। নাম দুর্গাদাস। মায়ের নাম নেতা কাঁওয়ার। ঘরে বসে থাকতে পারল না সেই তরুণ। এসে দেখল, পোষ্য প্রাণীর দল গ্রামের ফসল নষ্ট করলেও সেজন্য অনুতপ্ত নয় দুর্বিনীত পশুপালক। বরং বলছে, এ রাজ্য মহারাজ যশবন্ত সিংয়ের। তাহলে তোদের জমি আবার কী? এই জমিও তো রাজারই। রাজার জমির ফসল, রাজার পোষা পশুপ্রাণী খাচ্ছে। এখানে তোদের অধিকার ফলানো বা প্রতিবাদের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! 
দুর্গাদাস বলল, তোমাকে এই গ্রাম থেকে চলে যেতে হবে। এখানে আর তোমার পশুচারণ চলবে না। আমরা মেনে নেব না এই ক্ষতি। 
একটা বাচ্চা ছেলে তুই। তোর এত সাহস হয় কীভাবে? পশুপালক তৎক্ষণাৎ নিজের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করল দুর্গাদাসকে। এবং ভুল করল। এই পশুপালক চিনতে ভুল করেছে দুর্গাদাসকে। দুর্গাদাস পাল্টা আক্রমণ করল। গ্রামবাসী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখল রাজার প্রতিনিধিকে দুর্গাদাস সংঘর্ষে এতই কাবু করে ফেলল, যে, সেই পশুপালকের মৃত্যু হল। গ্রামবাসীদের মধ্যে ভয়ের এক কম্পন। রাজরোষ আছড়ে পড়বে এবার গ্রামে।
কে এই দুর্গাদাস রাঠোর? তার বাবা আসকারান রাঠোর স্বয়ং মহারাজা যশবন্ত সিংয়ের অন্যতম সেনাপতি। দুর্গাদাসের মা নেতা কাঁওয়ার নিজেই এক বীরাঙ্গনা। আর ভাট্টি উপজাতির এক গোষ্ঠীপতির কন্যা। তাঁর ওই বীরত্বেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন আসকারান। বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের সন্তান দুর্গাদাস। বাবা ও মায়ের বীরত্বের রক্ত দুর্গাদাসের শিরা ধমনীতে। অতএব এই আচরণ স্বাভাবিক। কিন্তু আসকারান সন্তুষ্ট নয় তাঁর এই স্ত্রীর প্রতি। কারণ একটাই। স্ত্রী স্বাধীনচেতা। সে আসকারানের অনুগত গৃহবধূ হয়ে থাকবে না। তাই তাঁকে আর সন্তানকে বস্তুত দূরে রেখেছেন আসকারান। যেন দুয়োরানি ও পুত্র।
যশবন্ত সিংয়ের কানে গেল তাঁর পশুপালককে হত্যা করেছে এক তরুণ। এত সাহস! ধরে আনতে বলা হল দুর্গাদাসকে। দুর্গাদাস অকুতোভয়। সে রাজসভায় এসে বলল, এইসব পশুপালকদের মতো রাজকর্মচারীর জন্যই মহারাজের বদনাম হচ্ছে। আপনার শত্রুরা এর ফলে কিন্তু প্রজাদের সমর্থন পেয়ে যাবে। কারণ এইসব কর্মচারী আপনার অজ্ঞাতে অত্যাচার করছে রাজ্যের সর্বত্র। আমি তাকে শায়েস্তা করে মহারাজারই উপকার করেছি! এভাবে মহারজের সামনে দাঁড়িয়ে এই মন্তব্য করার স্পর্ধায় স্তম্ভিত রাজদরবার। এখনই মৃত্যুদণ্ড অথবা সারাজীবনের কারাগার। কিন্তু দুর্গাদাসের কথা শুনে এবং পিতৃপরিচয় জানার পর যশবন্ত সিং বিস্মিত। আসকারানকে প্রশ্ন করলেন, তোমার পুত্র? ওদের গ্রামে ফেলে রেখেছ কেন? আসকারানের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে যশবন্ত সিং সেই গ্রামের তরুণকে নিজের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করলেন। রূপকথার গল্প বাস্তব হল। দুয়োরানি ও তাঁর পুত্র রাজসম্মান পেলেন। ক্রমেই যশবন্ত সিং, তাঁর পরিবার, রাজত্ব এবং রাজপুত গৌরবের অন্যতম এক রক্ষাকর্তা হয়ে উঠবেন দুর্গাদাস রাঠোর! আওরঙ্গজেবের রোষানল থেকে এই দুর্গাদাস রাঠোরই যশবন্ত সিংয়ের দুই রানি এবং পুত্র অজিত সিংকে রক্ষা করে লাহোর থেকে যোধপুর পৌঁছে দিয়েছিলেন। সে এক অবিস্মরণীয় বীরত্বের কাহিনি।
সেই শুরু। রাজপুতদের সঙ্গে বহু যুদ্ধ করেছেন আওরঙ্গজেব। বহু আক্রমণ-আগ্রাসন দেখিয়েছেন। কিন্তু একটিমাত্র মানুষ, এই দুর্গাদাস রাঠোরকে তিনি কোনওদিন ক্ষমা করতে পারবেন না। কেন? কারণ,  দুর্গাদাস রাঠোরের কৌশলে জীবনের সবথেকে বড় সম্পদ হারিয়েছেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। নিজের আদরের পুত্র মহম্মদ আকবরকে পিতার বিরুদ্ধে চির-বিদ্রোহী করার প্রধান কারিগর এই দুর্গাদাস। কী ঘটেছিল?
রাজপুতদের শায়েস্তা করার জন্য প্রথম থেকেই পুত্র আকবরকে দায়িত্ব দিয়েছেন আওরঙ্গজেব। রাজপুতরা ক্রোধে ফুটছে। কারণ আওরঙ্গজেবের মুঘল বাহিনী মেবার, চিতোর যেখানেই আক্রমণে যাচ্ছে, সেখানেই চলে গণহত্যা, লুণ্ঠন আর মন্দির ধ্বংস। উদয়পুরে ১৭৩টি মন্দির ধ্বংস করা হল। চিতোরে ৬০টি। আওরঙ্গজেবের বাহিনীর সেনাপতিরা যেন তাদের সম্রাটকে খুশি করতে যত না যুদ্ধ করে, তার তুলনায় বেশি মন্দির ধ্বংস করে। হিন্দুদের উপর অত্যাচার করে। এসব খবর যত বেশি সম্রাটকে দেওয়া যাবে, ততই যেন তিনি বেশি খুশি হবেন। সম্রাটের মনোভাব সেনাপতিদের জানা হয়ে গিয়েছে। ১৬৭১ সালে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে সম্রাট আওরঙ্গজেব জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র জমির খাজনা আদায় থেকে হিসেবরক্ষক, সকলে হবে মুসলিম। সুতরাং হিন্দু কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হোক।। পেশকার থেকে দেওয়ান—সকলেই হবে মুসলিম। 
কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও রাজপুত আর মারাঠাদের বশে আনা যাচ্ছে না। আওরঙ্গজেব বিরক্ত। শাহজাদা আকবর করছে কী? রাজপুতদের ধ্বংস করে কেন পূর্ণাঙ্গ দখল করা যাচ্ছে না তাদের রাজপাট! আজমীরের ফৌজদার তাহায়ুর খান আর আকবরের যৌথ বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে। যুদ্ধ চলছে। কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধের পাশাপাশি রাজপুত বাহিনী গোপনে আড়াল থেকে আঘাত হানার যুদ্ধেও পটু। তাই রক্তগঙ্গা বইয়ে দিলেও পরিপূর্ণ জয় আর আনুগত্য যেন অধরা থেকেই যাচ্ছে। 
চিতোরে থাকা মহম্মদ আকবর যখন ভাবছেন আর সাহস হবে না রাজপুতদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর, তখন রাতের অন্ধকারে তাঁর শিবিরে হানা দিল রাজপুত বাহিনী। মুঘল সেনাকে ঘরে ঢুকে হত্যা করে গেল রাজপুতরা! কয়েকদিনের মধ্যে ১০ হাজার গোরু চুরি করে নিয়ে গেল ওই গোপন রাজপুত সেনা। রাজপুতদের এই গোপন সেনার ভয়ে আতঙ্কে এখন আর সন্ধ্যার পর শিবিরের বাইরে পা রাখে না মুঘল সেনা। 
আকবরকে সরাসরি অপদার্থ তকমা দিলেন পিতা আওরঙ্গজেব। তিনি সেনাপতি হাসান আলিকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে আকবরকে বললেন, চিতোরে আর তোমাকে থাকতে হবে না। তোমাকে দিয়ে হবে না। আজমকে পাঠাচ্ছি। আজম অর্থাৎ আকবরের অপর এক ভাই। এটা অপমানজনক। আকবর ভাবলেন, এর অর্থ হল, আমি ব্যর্থ! আর আজম সফল। আর তার অর্থ আরও ভয়ঙ্কর! আলমগীরের পর দিল্লির মসনদে আজম বসবে? তারই ব্যবস্থা হচ্ছে এসব? তাকে ব্যর্থ আখ্যা দিয়ে আসলে সিংহাসনের দাবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
মহম্মদ আকবর মারওয়াড় গেলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে। কিন্তু মনে বিদ্রোহের আঁচ জমছে। তবু তিনি জানেন যে, আমি সম্রাটপুত্র। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। সুতরাং আমাকে বীরত্ব দেখিয়েই প্রমাণ করতে হবে নিজের যোগ্যতা। ১৬৮০ সাল। জুলাই। কার ভরসায় বীরত্ব দেখাবেন আকবর? সেনাপতি তাহায়ুর খানের আচার-আচরণ তো ঠিক স্বাভাবিক নয়! আর একটু এগিয়ে যেতে হবে দেওসুরী গিরিপথ পেরিয়ে কমলমীর। সেখানে মহারানা লুকিয়ে। তাঁকে কব্জা করতে হবে। হত্যা করতে হবে। অথচ তাহায়ুরের যেন কোনও উদ্যোগই নেই। আওরঙ্গজেব আবার নির্দেশ দিলেন পুত্রকে। এখনও চুপ করে বসে আছ কেন? অগ্রসর হতে পারছ না? 
ঠিক সেই সময় বুদ্ধিমান দুর্গাদাস রাঠোর বুঝেছিলেন যে, মুঘল পরিবারে সমীকরণ বদলাচ্ছে। হঠাৎ করে অন্য ভাইদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন সম্রাট। আকবরকে ছোটখাটো বিদ্রোহ দমনে কাজে লাগানো হচ্ছে। আর আকবরের বাহিনীরও সেই জোশ নেই। কেমন যেন ম্রিয়মাণ। দুর্গাদাস সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তৎপর হলেন। আকবরের ভাই মুয়াজ্জমকে তিনি প্ররোচিত করে বলেছিলেন যে, আমাদের সঙ্গে হাত মেলান। আপনাকেই দিল্লির সিংহাসনে বসানোর ব্যবস্থা করব আমরা। গোটা রাজপুতানা সমর্থন দেবে। মুয়াজ্জম সেই ফাঁদে পা দিতে ভয় পান। এবার দুর্গাদাসের লক্ষ্য আকবর। তাঁকেও ঠিক একই কথা বললেন দুর্গাদাস। বললেন, আর কতদিন এভাবে পিতার নির্দেশ পালন করতে করতে পাহাড় জঙ্গল নদীতে ঘুরে বেড়াবেন? সময় তো বয়ে যায়! পিতার সাফল্য বাড়াতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি কার্তুজ আপনার বুকে লাগবে। অথবা তরবাবিরর আঘাত। আপনার জীবন শেষ। কিছুই পাওয়া হল না। তাই আপনি বিদ্রোহ করুন। আপনিই মুঘল সম্রাট! 
আকবরের মনের মতো কথা। ২৩ বছর বয়সে আওরঙ্গজেবের চতুর্থ পুত্র ঘোষণা করলেন যে, আমিই নয়া বাদশাহ! আওরঙ্গজেবকে আমি মানি না। দুর্গাদাস আসলে তার আগেই মুঘল সেনাপতি তাহায়ুর খানকে হাত করেছেন। সুতরাং পুত্র আকবরের নেতৃত্বে থাকা গোটা মুঘল বাহিনী সম্পূর্ণ  ছত্রভঙ্গ হয়ে রাজপুতদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেলল। আওরঙ্গজেব দিশাহারা।  ৭০ হাজার মুঘল সেনা। আর তার সঙ্গে রাজপুত বাহিনী!
কিন্তু আওরঙ্গজেবের কাছেও আছে এক তুরুপের তাস! শিহাব উদ দিন। এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তাঁকে এবার দায়িত্ব দেওয়া হল।
পুত্র এবং পিতা উভয়ে উভয়কে চিঠি লিখছেন। আওরঙ্গজেবের বুক ভেঙে গিয়েছে। তিনি চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন, আমার সঙ্গে এরকম আচরণ কীভাবে করতে পারো তুমি! ফিরে এসো পুত্র! আকবর পাল্টা বাবাকে চিঠিতে বললেন, আপনি নিজের পিতার সঙ্গে কী ব্যবহার করেছিলেন? আপনার সঙ্গে দেখা হবে আমার। তবে সেই সময় আমার হাতে থাকবে তরবারি।
আজমীরের ৮ কিলোমিটার দূরে দেওরাইয়ে আওরঙ্গজেবের শিবির। আর মাত্র দেড়শো কিলোমিটার দূরে আকবর। তিনি যতই অগ্রসর হচ্ছেন, ততই লক্ষ্য করছেন এক অদ্ভুত দৃশ্য। কমছে সেনার সংখ্যা। অবশেষে যখন মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে দুই যুযুধান বাহিনী, পিতা বনাম পুত্র যুদ্ধ যখন শিয়রে, তখন আওরঙ্গজেব চরম কৌশলে কিস্তিমাত করে দিলেন। আকবরের প্রধান শক্তি সেনাপতি তাহায়ুর খানের স্ত্রী ছিলেন আওরঙ্গজেবের অন্যতম সেনাপ্রধান ইনায়েত খানের কন্যা। অতএব পারিবারিক সম্পর্ক। আওরঙ্গজেব ইনায়েত খানকে দিয়ে জামাইকে চিঠি লেখালেন। ইনায়েত লিখলেন, সম্রাটের দলে যোগ দাও। ক্ষমা করা হবে। নচেৎ তোমার পরিবারের প্রত্যেক নারীকে বিবস্ত্র করে বলাৎকার করা হবে। তোমার পুত্রদের বিক্রি করা হবে। আশ্চর্যের বিষয়, নিজের মেয়ে জামাইয়ের বিরুদ্ধেই ইনায়েত খান এরকম চিঠি লিখলেন? কিন্তু এরপর আর তাহায়ুরের কিছু করার থাকে না। এখা঩নেই শেষ নয়। আওরঙ্গজেব কুশলী চতুরতায় পুত্রকে চিঠি লিখে বললেন, চমৎকার কাজ করেছ। আমার সঙ্গে শত্রুতার ভান করে রাজপুতদের সঙ্গে মিথ্যা বন্ধুত্ব করে আমার কাছে তাদের নিয়ে এসেছ। এজন্য তোমার পুরস্কার প্রাপ্য। এই চিঠি এমনভাবে পাঠানো হল, যাতে দুর্গাদাস রাঠোরের হাতে যায় আগে। ঠিক তাই হল। দুর্গাদাস সেই চিঠি পড়ে স্তম্ভিত। তিনি ভাবলেন, এত বড় তঞ্চকতা! দুই বন্ধুর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি। দুর্গাদাস তাহায়ুরের শিবিরে গিয়ে দেখলেন তাহায়ুরও নেই। তাঁর মনে হল, তার মানে সত্যিই এটা চক্রান্ত! রাজপুতদের প্রাণ তিনি এভাবে বাজি রাখতে পারেন না। অতএব আকবরের যাবতীয় ধনসম্পদ দখল করে দুর্গাদাস রাজপুতদের নিয়ে চলে গেলেন নিরাপদ স্থানে। পরদিন ভোরে আকবর দেখলেন তিনি একা।
তবে কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা গেল আওরঙ্গজেবের চালাকি। দুর্গাদাস ভুল বুঝতে পারলেন। এবার আর কোনও অস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। স্থায়ী একটি আস্তানা ও আশ্রয় দেওয়া হবে আকবরকে। দুর্গাদাস রাঠোর মুঘল সেনাদের চোখ এড়িয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে আকবরকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে দিলেন নিরাপদ হস্তে। আকবর আশ্রয় নিলেন মারাঠা শাসক শম্ভাজি মহারাজের কাছে। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের পুত্র। যিনি পিতার মতোই মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন লাগাতার। তবে পিতার মতো বীরত্ব, নৈতকতা, ধর্মচেতনা তাঁর ছিল না। খোদ শিবাজি তাঁর উপর ছিলেন বিরক্ত। তবে শম্ভাজি আওরঙ্গজেবের ভারত তথা দাক্ষিণাত্য জয়ের প্রধান বাধা। শম্ভাজি, দুর্গাদাস এবং আকবর। তিনজন একজোট হলেন। 
কিন্তু তাঁরা কেউই সম্পূর্ণভাবে আওরঙ্গজেবকে পরাস্ত করতে সফল হননি। শম্ভাজির সঙ্গে আকবর একাধিকবার আক্রমণ করেছেন পিতার বাহিনীকে। যুদ্ধ করেছেন মারাঠাদের হয়ে। কিন্তু একসময় তাঁর মোহভঙ্গ হয়। সন্দেহ হয় যে, শম্ভাজি কি আদৌ চান আওরঙ্গজেবকে সরিয়ে তাঁকে মুঘল সম্রাট করতে? এই মোহভঙ্গই তাঁকে ক্রমেই সরিয়ে আনল শম্ভাজির থেকে। কিন্তু যাবেন কোথায়? পিতার বাহিনীও তো তাঁকে পেলে সম্রাটের কাছে হাজির করবে! তখনও তো সাজা একটাই—মৃত্যু! অবশেষে দুর্গাদাস রাঠোর ব্যবস্থা করলেন জাহাজের। পারস্যে রওনা হলেন! আজীবন আর সেই পুত্রের মুখ দেখতে পেলেন না আওরঙ্গজেব।
সুতরাং দুর্গাদাস এবং শম্ভাজি মহারাজের উপর আওরঙ্গজেবের ক্রোধ যে কতটা, সেকথা বলাই বাহুল্য। কারণ এই দু’জন তাঁর পরিবারে ভাঙন ধরিয়েছে। পুত্রকে করেছে বিদ্রোহী। শত্রু। অতএব প্রতিশোধ চা‌ই। শম্ভাজিকে আগে ধ্বংস করতে হবে। প্রতিজ্ঞা করলেন আওরঙ্গজেব। শম্ভাজির অপরিমিত দুর্বিনীত ও বিশৃঙ্খল জীবনের কারণে তাঁর রাজ্য তথা জায়গীরগুলিও ক্রমে দুর্বল হল। সেনাবাহিনী সামন্তরা আর তাঁকে পছন্দ করছে না। যখন তখন বিদ্রোহের বিস্ফোরণ।
এরকম এক বিদ্রোহ দমন করতে শম্ভাজি গিয়েছেন সঙ্গমেশ্বর। বিদ্রোহীদের খতম করে অলকানন্দা আর বরুণা নদীর তীরের কাছে এক প্রাসাদে থাকছেন তিনি। যুদ্ধে সদ্য জয়ী হয়েছেন। অতএব চলছে আমোদ-প্রমোদ। সেই খবর গুপ্তচর মারফত পেলেন আওরঙ্গজেবের মনসবদার মুকররব খান। মাত্র ২ হাজার সেনা নিয়ে নিঃশব্দে হাজির হলেন সঙ্গমেশ্বর। যুদ্ধ একটা হল বটে। তবে সামান্য সময়ের মধ্যেই পরাস্ত শম্ভাজির বাহিনী। মুঘল বাহিনী যখন প্রবেশ করল প্রাসাদে, সুড়ঙ্গে লুকিয়ে পড়লেন শম্ভাজি। মহাশক্তিধর ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের পুত্র শম্ভাজিকে চুলের মুঠি ধরে বের করা হল। হাজির করা হল আওরঙ্গজেবের সামনে। সাধারণ মৃত্যু নয়। প্রথমে ভাঁড়ের মতো পোশাক পরিয়ে শহর ঘোরানো হল শম্ভাজিকে। গাধার টুপি মাথায়। উটের পিঠে চাপানো। আওরঙ্গজেব তারপর নির্দেশ দিলেন মৃত্যুদণ্ডের। শিরশ্ছেদ তো করা হলই। তার আগে একের পর এক অঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে। এভাবেই নির্মম প্রতিশোধ নিলেন আওরঙ্গজেব। সালটা ১৬৮৯। 
কিন্তু তাঁর নিজের ভাগ্যে কী ঘটল? ১৭০৪ সালে পারস্য থেকে খবর এসেছে আকবরের মৃত্যুর। কন্যা জেব-উন-নিসা কারাগারে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। মায়ের পেটের একমাত্র বেঁচে থাকা বোন গওহ-আরা-বেগমও মারা গেলেন। কন্যা ও জামাইয়ের মৃত্যু হল। কিছুদিন অসুস্থতা। আবার সুস্থ হলেন। কিন্তু আচমকা জ্বর এল। আওরঙ্গজেব বুঝতে পারছেন, এবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ১৭০৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল শুক্রবার। আওরঙ্গজেব আল্লাহের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন জুম্মাবারে যেন মৃত্যু হয়। তা-ই হল। 
টুপি সেলাই করে চার টাকা দুই আনা জমিয়েছেন তিনি। কাফনের কাপড় কেনার জন্য। আহমেদনগরে নয়। দিল্লিতে নয়। আগ্রায় নয়। তাঁকে যেন কবর দেওয়া হয় খুলদাবাদে! মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদের সেই সমাধিকে কেন্দ্র করে এবার শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। সঙ্ঘ পরিবারের একাংশ দাবি করেছে, আওরঙ্গজেবের মতো এরকম এক অত্যাচারী, হত্যাকারী এবং হিন্দু বিরোধীকে মহা সমারোহে সমাধিস্থলে শায়িত রেখে, ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের অধীনে ঐতিহ্যপূর্ণ ভবনের সম্মানে কেন রাখা হবে? মারাঠা অস্মিতার ক্রোধ উপচে পড়ছে। কারণ, বীর শম্ভাজিকে যেভাবে আওরঙ্গজেব হত্যা করেছেন, সেটা অসহনীয়।
প্রথমে দাবি উঠেছিল মহারাষ্ট্র থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। তারপর দাবি উঠেছে ধ্বংস করা হোক। খোদ মহারাষ্ট্রের মু্খ্যমন্ত্রী এই অভিমতের অনুসারী। দেশজুড়ে নতুন বিতর্ক চরমে! আওরঙ্গজেবের সমাধি থাকা উচিত নাকি উচিত নয়? হিন্দুত্ববাদী একাধিক সংগঠন ঘোষণা করেছে নতুন কর্মসূচি! দ্বিতীয় বাবরি মসজিদ আন্দোলন! তাহলে কি জন্ম হচ্ছে ফের নতুন ধর্মের রাজনীতি? বাবরের পর আওরঙ্গজেব?
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : সত্যেন্দ্র পাত্র