শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

সন্ন্যাসী

সন্ন্যাসীর জীবনের উদ্দেশ্য — নিজ কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে বহুর কল্যাণ — ‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়’। পাঠক স্মৃতিকথা কেন পড়বে? নিজের কল্যাণের জন্যতো বটেই। শাস্ত্রই বলেছেন — সাধুর জীবনকথা শোনাও মঙ্গল — “শ্রবণ মঙ্গলং …”; “…ক্ষণমিহ সজ্জন সংগতিরেকা ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা।” 

সন্ন্যাসী

সন্ন্যাসীর জীবনের উদ্দেশ্য — নিজ কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে বহুর কল্যাণ — ‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়’। পাঠক স্মৃতিকথা কেন পড়বে? নিজের কল্যাণের জন্যতো বটেই। শাস্ত্রই বলেছেন — সাধুর জীবনকথা শোনাও মঙ্গল — “শ্রবণ মঙ্গলং …”; “…ক্ষণমিহ সজ্জন সংগতিরেকা ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা।” — সাধুসঙ্গ ক্ষণকালের জন্য হলেও তা সংসার-সাগর উত্তীর্ণ হবার নৌকা স্বরূপ (— শঙ্করাচার্য্য)। কারণ, সন্ন্যাসীর দিব্য জন্ম-কর্ম, সাধনা-সিদ্ধি অপরের জন্য উৎসর্গীকৃত। স্মৃতিকথা সততই সুখের-আনন্দের, শিক্ষার-দীক্ষার, জীবন সমস্যা সমাধানের নিদান। ‘স্মৃতিকথা’র কোন ভূমিকা বা ভণিতা হয় না। কিন্তু এই প্রসঙ্গে সেই ‘সর্বভূতেষু দেবী’ স্মৃতিতে যা জাগিয়ে দিলেন — তা প্রকাশ না করে পারলাম না। এতে অনেকেই হয়তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখ ঘোরাবেন, (ভাববেন কোথা থেকে কোথা!), কিন্তু ‘কলম হাতুড়ে’ নিরুপায়!
লেখকের এই সকল স্মৃতিকথা বা স্মৃত জীবনের দর্শন কথা অন্যের কাছে পরিগণিত হয় বা হবে শ্রুতিকথা বা শ্রুত জীবনের কথা রূপে। তখন সে এই জীবনের কথা প্রসঙ্গে অপরাপর বন্ধুদের বলবে “(অমুকের সম্বন্ধে) আমি শুনেছি, আমি পড়েছি” … ইত্যাদি। আর লেখক লিখছে এই বলে — “আমি তাঁকে প্রত্যক্ষ দেখেছি (অবশ্য আমার মনের-চশমার পরিপ্রেক্ষিতে), আমি তাঁর সঙ্গ করেছি …” ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে ঠাকুরের কথা — “পড়ার চেয়ে শোনা ভাল, শোনার চেয়ে দেখা ভাল।” কারণ দর্শনেই সর্বসংশয়ের নিবৃত্তি। সে যাই হোক, এই ‘স্মৃতিকথা’ ও শ্রুতি বা ‘শ্রুতিকথা’ নিয়ে আমরা যদি আমাদের অধ্যাত্মরাজ্যের গোড়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখব — শ্রুতি বা ‘শ্রুতিকথা’ (বা শ্রুতিশাস্ত্র) হল বেদ-উপনিষদের কথা। তখনকার সত্যদ্রষ্টা মুনি-ঋষিদের অনুভূতি-উপলব্ধি-দর্শনাদির কথা। এগুলো তাঁরা মন্ত্ররূপে প্রত্যক্ষ দর্শন করেছেন। তখন লেখার কোন Script আবিষ্কার হয়নি বা কেউ লেখেনি। তখনকার দিনে এগুলো শ্রুতিধরদের মুখে মুখে ফিরত — লোকসমাজে প্রচারিত হতো — অমুক ঋষি এই এই অনুভূতি-দর্শনাদি করেছিলেন … তমুক ঋষি এই এই উপলব্ধি করেছেন …এঁর কাহিনী এই এই … ওঁর কাহিনী এই এই ইত্যাদি।
পরবর্তীকালে এই সকল শ্রুতি বা শ্রুতিকথা বা শ্রুতিশাস্ত্রের ভিত্তিতে স্মৃতিকথা বা পুরাণ শাস্ত্র (গীতা, ভাগবত, তন্ত্র প্রভৃতি) রচনা করেছেন মুনিরা (মননকারী ঋষিরা) এবং সঙ্গে সঙ্গে সাধন-জীবনের ইতিহাস হিসাবে ব্যাস-বাল্মীকি প্রভৃতি মুনি-ঋষি দ্বারা নানান পৌরাণিক শাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছে। এসকল শাস্ত্র কখনই শ্রুতিশাস্ত্রকে অতিক্রম করে নয়। তার অনেক পরে ঐতিহাসিক মুনি-ঋষি (বুদ্ধ-শঙ্কর-যীশু …) প্রভৃতির দ্বারা এদের ভাষ্য-টীকা-টিপ্পনী প্রভৃতি রচিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নানান শাস্ত্র, সম্প্রদায় ও ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। শ্রুতিশাস্ত্রকে আশ্রয়-অবলম্বন-আদর্শ করে যে শাস্ত্র তাই স্মৃতি বা পৌরাণিক শাস্ত্র। স্মৃতিশাস্ত্রকে আশ্রয়-অবলম্বন-আদর্শ করে যে জীবন তাই স্মৃতি বা পৌরাণিক জীবন। এতসব বলার অর্থ — সর্বশেষ সর্বাধুনিক সত্যদ্রষ্টা ঋষি-মুনি পরম্পুরুষ পুরাণপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ; পরমাপ্রকৃতি, পুরাণপ্রকৃতি মা সারদা এবং ব্রহ্মজ্ঞ স্বামী বিবেকানন্দ এসেছেন। এখন এঁদের যাঁরা প্রত্যক্ষ দেখেছেন, এঁর কথা প্রত্যক্ষ শুনেছেন, এঁর সম্বন্ধে তাঁদের রচিত স্মৃতিমর্ম গ্রন্থাবলিই আমাদের কাছে স্মৃতিশাস্ত্র। কথামৃত, লীলাপ্রসঙ্গ, পুঁথি তাঁর সন্তানদের কথিত স্মৃতিকথা … ইত্যাদি। প্রত্যক্ষ এই শ্রুতি-জীবনকে আশ্রয়, অবলম্বন, আদর্শ করে যাঁরা জীবন গঠন করে নানান উপলব্ধি-অনুভূতি করেছেন, করে চলেছেন, যুগ পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের নানান বাস্তব সমস্যার সমাধান করে নতুন পথ দেখাচ্ছেন।
রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির প্রকাশিত ‘স্মৃতিকথায় তথাগতানন্দ’ থেকে