বুধবার, 21 মে 2025
Logo
  • বুধবার, ২১ মে ২০২৫

মিয়াজাকির জিবলি

গত কয়েক দিনে চেনা মানুষের ‘কার্টুন অবতার’ দেখতে দেখতে অবাক হয়েছ নিশ্চয়ই! ফুটবল খেলোয়াড় মেসি থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, মায় তোমাদের পাশের বাড়ির কাকু-কাকিমাও ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে ফেলেছেন নিজের কার্টুন ছবি!

মিয়াজাকির জিবলি

গত কয়েক দিনে চেনা মানুষের ‘কার্টুন অবতার’ দেখতে দেখতে অবাক হয়েছ নিশ্চয়ই! ফুটবল খেলোয়াড় মেসি থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, মায় তোমাদের পাশের বাড়ির কাকু-কাকিমাও ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে ফেলেছেন নিজের কার্টুন ছবি! যার নাম ‘জিবলি আর্ট’। ওপেন এআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান জানিয়েছেন, চ্যাটজিপিটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে নানা রকম ভাবনাচিন্তা করছিলেন তাঁরা। সেই সময়েই জিবলি আর্টের কথা তাঁদের মাথায় আসে। ওই প্রযুক্তি প্রকাশ্যে আনার পরেই চাহিদা তুঙ্গে ওঠে চ্যাটজিপিটির। মুহূর্মুহু আবদার। একমুহূর্ত বিশ্রাম নেওয়ার জো নেই! কেউ গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে তোলা ছবি দিচ্ছেন, তো কেউ পুকুরপাড়ে বা পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে তোলা শখের সেলফি পাঠাচ্ছেন। ‘জিবলি’র কায়দায় কার্টুন ছবি বানিয়ে দিতে হবে!
কিন্তু যা নিয়ে এত মাতামাতি, সেই ‘জিবলি’ আসলে কী? কোথা থেকে পেল তার অমন বিদঘুটে নাম? সেই নামের অর্থই বা কী? কেন এবং কীভাবে জনপ্রিয় হল জিবলি শিল্প? জিবলি নামের নানা রকম অর্থ হয়। নানা দেশে এর ব্যবহারও রয়েছে। তবে জিবলি শব্দটির সবচেয়ে পুরনো উল্লেখ মেলে আরব দেশে। আরবি শব্দ ‘জিবলি’ ব্যবহার করা হয় সাহারা মরুভূমির উত্তপ্ত এবং শুষ্ক হাওয়াকে বোঝানোর জন্য। জিবলি স্টুডিওর তিন প্রতিষ্ঠাতার প্রধান যিনি, সেই জাপানি অ্যানিমেশন শিল্পী এবং চলচ্চিত্রকার হায়াও মিয়াজাকি অবশ্য ওই নাম বেছে নিয়েছিলেন ইতালির একটি বিমানের নাম থেকে। ওই বিমান ছিল সাহারা মরুভূমিতে ইতালির নজরদারি চালানোর জন্য। সেই বিমানের নামও ছিল জিবলি (ইতালীয় উচ্চারণে গিবলি)। বিমান নিয়ে আগ্রহী মিয়াজাকি সেই নাম শুনেছিলেন। নামের মানে জেনে আরও ভালো লেগেছিল তাঁর। নিজের স্টুডিও তৈরি করার সময় তাই বেছে নিয়েছিলেন সেই নামই। জাপানি উচ্চারণে যা হয়েছিল জিবলি।
এবার চল, জিবলি স্টুডিওর খোঁজে আমরা পিছিয়ে যাই সেই ১৯৮৫ সালে। জাপানের টোকিও শহর। কিংবদন্তি শিল্পী, অ্যানিমেটর ও পরিচালক হায়াও মিয়াজাকি, ইসাও তাকাহাতা এবং প্রযোজক তোশিও সুজুকির হাত ধরে যাত্রা শুরু করে জিবলি স্টুডিও। মূলত অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণের উদ্দেশে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিয়াজাকি ও এই জিবলি স্টুডিওর অ্যানিমেশন ছবিগুলি একেবারে স্বকীয় একটি স্টাইলের জন্ম দেয়। সাধারণ চলচ্চিত্র, মানে আমরা যাকে লাইভ অ্যাকশন সিনেমা বলি, তার সঙ্গে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের মূল পার্থক্য হল— অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের সব কিছুই শিল্পী ও পরিচালকের কল্পনা থেকে সৃষ্ট ও নির্মিত। গাছের পাতা থেকে চোখের পাতা— সব কিছুই শিল্পী এবং পরিচালকের হাতে নির্মাণ হয়। ঠিক সেই নির্মাণের উৎকর্ষে মিয়াজাকি এবং তাঁর পরিচালিত জিবলি স্টুডিওর শিল্পীরা মিলে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন। ছবির চরিত্র থেকে জগৎ নির্মাণে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত দুনিয়া। নিখুঁত ডিটেইলিং, উজ্জ্বল জলরং অথবা অ্যাক্রেলিক রং, হাতে আঁকা অ্যানিমেশন, গভীর আবেগপূর্ণ গল্পধারা এবং সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দেয়। এই নির্দিষ্ট ভিজ্যুয়াল আর্ট-ই ক্রমশ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায় জিবলি আর্ট নামে। খামখেয়ালি কল্পনায় আঁকা সেই সমস্ত ছবি থেকে ফুটে বেরত অজানা সুখানুভূতি। সম্ভবত সেই বিষয়টিই দর্শকদের মন টানে।
গত ৩৮ বছরে হাতেগোনা ২২টি ছবি তৈরি করেছে জিবলি স্টুডিও। টেলিভিশনের জন্য বানিয়েছে ৩টি ছবি। আর সেই সব ছবির প্রত্যেকটিই অ্যানিমেশন দুনিয়ায় বিখ্যাত। জাপানের যে প্রথম দশটি ছবি আজও ব্যবসা দেয় এবং সর্বকালের সেরা ব্যবসা করেছে, তার মধ্যে চারটিই জিবলি স্টুডিওতে তৈরি। মিয়াজাকির নির্দেশনায় এবং জিবলি আর্ট ও অ্যানিমেশন স্টাইলে নির্মিত ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’, ‘মাই নেবার টোটোরো’, ‘প্রিন্সেস মনোনোকের’, ‘আঋটি’, ‘পোনিও’-র মতো বিখ্যাত ছবিগুলি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের ইতিহাস ক্রমশ পাল্টাতে থাকে। ওয়াল্ট ডিজনি অংশীদারির প্রস্তাব দেয় জিবলি স্টুডিওকে।
জিবলির ছবি অস্কার, গোল্ডেন বিয়ার, বাফটা, গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারও জিতেছে একাধিক বার। ২০২৪ সালের সেরা অ্যানিমেশন ছবির শিরোপা উঠেছে জিবলি স্টুডিওরই তৈরি ‘দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন’ ছবির মাথায়। জিবলির তৈরি ছবি ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ হল প্রথম ‘নন-ইংলিশ’ অ্যানিমেশন ছবি, যা মূল বিভাগে অস্কার জেতে। ২০২১ সালে জিবলির জনপ্রিয়তা দেখে টোকিওতে জিবলি মিউজিয়ামও তৈরি হয়। জিবলির দৌলতে মিয়াজাকি ২০২৪ সালে এশিয়ার ‘নোবেল প্রাইজ’ অর্থাৎ র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারও পান।
প্রশ্ন একটাই, এআই কি পারবে মিয়াজাকির সেই জনপ্রিয়তা ছুঁতে?
এর উত্তর খোঁজার আগে চলো মিয়াজাকির মতো ছবি আঁকি...।
—নিজস্ব প্রতিনিধি